১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭, মঙ্গলবার, ১০:৩২

আইনের প্রয়োগ নেই তাই চালের মজুদদারি

নিত্যপণ্য নিয়ন্ত্রণ আইনের পাশাপাশি কম্পিটিশন অ্যাক্ট কার্যকরের তাগিদ

চালের দাম বাড়লেই খোঁজ পড়ে মজুদবিরোধী আইনের। সংকট শুরু হওয়ায় আইনটি নিয়ে আবারও নাড়াচাড়া শুরু হয়েছে। দেশের বিভিন্ন চালকলে অভিযান চালানো হচ্ছে। অথচ সংশ্লিষ্ট আইনটি ছয় বছর আগে সংশোধন হলেও এর কোনো প্রয়োগ দেখা যায়নি। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা আইনটিকে সব সময় প্রয়োগের তাগিদ দিচ্ছেন। এতে মজুদবিরোধী মনোভাব গড়ে উঠবে এবং মজুদ করলে শাস্তি থেকে রেহাই মিলবে না—এ বার্তা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে পৌঁছে যাবে।

বর্তমানে দেশে মোটা চালের বাজারদর রেকর্ড গড়েছে। ৫০ টাকা কেজির নিচে কোনো মোটা চাল নেই। খাদ্যগুদামে পর্যাপ্ত চাল না থাকায় খোলাবাজারে বিক্রি করে (ওএমএস) সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না। আতপ চাল দিয়ে ওএমএস করার কারণে ক্রেতাদের চাহিদা নেই। এ কারণে আগামী অগ্রহায়ণ মাসে নতুন ধান ওঠার আগ পর্যন্ত দাম কমবে না।
বরং আশ্বিনের পুরো সময় এবং কার্তিকেও চালের বাজার চড়া থাকতে পারে। এ কারণে সরকারের ভেতরও চরম অস্বস্তি বিরাজ করছে। এ অবস্থায় অবৈধ মজুদকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) চিঠি দেওয়া হয়েছে। এই চিঠির পরও প্রায় প্রতিদিন ডিসি ও এসপিদের সঙ্গে চালের মজুদ পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলছেন সরকারের একাধিক মন্ত্রী। মজুদকারীদের সরকার কোনো ছাড় দেবে না—এই বার্তা পেয়ে জেলা প্রশাসনও বিভিন্ন গুদামে অভিযান চালাচ্ছে।
‘কন্ট্রোল অব এসেনশিয়াল কমোডিটিজ অ্যাক্ট’ আইনটি ১৯৫৬ সালের হলেও সংকটের সময়ে আইনটি বারবার সংশোধন করা হয়েছে। সর্বশেষ ২০১১ সালে এটি সংশোধন করা হয়। এতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন তৎকালীন খাদ্যমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের মতো মজুদপ্রবণ দেশে আইনটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি শুধু সংকটের সময় ব্যবহার না করে সব সময় এর চর্চা করলে মজুদবিরোধী মনোভাব গড়ে উঠবে। তবে আইনটি প্রয়োগ করতে হবে খুব সাবধানে। কারণ অনেক সময় হিতে বিপরীত হতে পারে। ’

এসেনশিয়াল কমোডিটিজ অ্যাক্টে আমদানিকারক, পাইকারি ব্যবসায়ী, খুচরা ব্যবসায়ী ও চালকল মালিকদের খাদ্যশস্য মজুদের সর্বোচ্চ পরিমাণ ও মেয়াদ নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। লাইসেন্স ছাড়া কোনো ব্যবসায়ী এক টনের ওপর খাদ্যশস্য মজুদ করতে পারবেন না। চাল বা ধান পাইকারি পর্যায়ে সর্বোচ্চ ৩০০ টন ৩০ দিনের জন্য মজুদ করা যাবে। খুচরা পর্যায়ে ১৫ টন ধান বা চাল ১৫ দিন রাখা যাবে। ব্যবসায়ীরা আমদানীকৃত পণ্যের শতভাগ ৩০ দিন ধরে রাখতে পারবেন। তাঁরা ৫০ ভাগ পণ্য ৪০ দিন এবং ২৫ ভাগ ৫০ দিন মজুদ করতে পারবেন। মালিক পর্যায়ে চালকলের ধরন অনুযায়ী মজুদ করার পরিমাণ বেঁধে দেওয়া আছে। অটোমেটিক, মেজর এবং হাসকিং মিল পাক্ষিক ছাঁটাইয়ের পাঁচ গুণ মজুদ করতে পারে এবং এ মজুদের মেয়াদ ৩০ দিন। পাক্ষিক ছাঁটাই ক্ষমতার দুই গুণ চাল ১৫ দিনের জন্য মজুদ করতে পারবে অটোমেটিক ও মেজর চালকল। হাসকিং চালকল সর্বোচ্চ ১০০ টন চাল ১৫ দিনের জন্য মজুদ করতে পারবে। আমদানিকারক ও পাইকারি বিক্রেতা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বিক্রি করতে না পারলে তা মেয়াদ শেষ হওয়ার তিন দিনের মধ্যে সরকারকে জানাবে।

সাবেক খাদ্যসচিব আব্দুল লতিফ মণ্ডল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নিত্যপণ্য নিয়ন্ত্রণ আইন কেন এত দিন প্রয়োগ করা হয়নি, তা আমার বিস্ময়কর লাগছে। আইনটি বাস্তবায়ন না করার জন্যই আজকের অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের সমস্যা হচ্ছে, সরকারের মন্ত্রীরা ব্যবসায়ীদের দ্বারা উপকৃত হন। এ কারণে তাঁরা হার্ডলাইনে যেতে চান না। রাজনৈতিক দলগুলোও উপকৃত হয়। মজুদদারদের বিরুদ্ধে হার্ডলাইনে যাওয়া ছাড়া সরকারের সামনে আর কোনো বিকল্প নেই। কারণ বোরো মৌসুমে এক কোটি ৯১ হাজার টন উৎপাদনের টার্গেট ছিল। ২০ লাখ টনও যদি নষ্ট হয়, তাহলে আরো এক কোটি ৭১ লাখ টন চাল কোথায় গেল? এ চাল মজুদদারদের কাছে রয়েছে। নিত্যপণ্য নিয়ন্ত্রণ আইন প্রয়োগ করে এই মজুদদারি ভাঙতে হবে। তবে আইন প্রয়োগে খুব সাবধান হতে হবে। কারণ প্রকৃত ব্যবসায়ী যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হন। তাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হলে ব্যবসায়ীরা চাল গোপন আস্তানায় লুকিয়ে ফেলবেন। তখন সরকার বিপদে পড়বে। নিত্যপণ্য নিয়ন্ত্রণ আইনের সঙ্গে কম্পিটিশন অ্যাক্ট বা প্রতিযোগিতা আইনটিও প্রয়োগ করা দরকার। এ দুটি আইন প্রয়োগ করলে সিন্ডিকেট ভেঙে যাবে। ’

খাদ্য অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তার কাছে মজুদবিরোধী আইন বা নিত্যপণ্য নিয়ন্ত্রণ আইন প্রয়োগ না করার কারণ জানতে চাইলে তিনি নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, আইনটি প্রয়োগ করা খুবই রিস্কি। কারণ সব পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে রাজনৈতিক দলের নেতাদের যোগাযোগ রয়েছে। এটাই প্রধান অন্তরায়। তা ছাড়া আইনটি প্রয়োগ করতে হলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা থাকতে হবে, যা খাদ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের নেই। এ কারণে প্রশাসনের ম্যাজিস্ট্রেটদের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। তা ছাড়া এর সঙ্গে পুলিশও জড়িত। এ কারণে সব পক্ষকে এক করে অভিযান চালানো দুরূহ। আইনটি স্বাভাবিকভাবে কার্যকর করার আরো একটি বাধা হলো খাদ্য আদালত। দেশের সব জেলায় খাদ্য আদালত গঠন করতে হবে। এ আদালত না থাকাটাও একটি বড় সমস্যা। খাদ্য আদালত আইনটি আদালতের নির্দেশনায় ইংরেজি থেকে বাংলায় করার জন্য খাদ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এতে আরো কিছু সংযোজন-বিয়োজন হতে পারে।

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2017/09/19/544351