১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭, মঙ্গলবার, ১০:২৭

চালের দামে রেকর্ড নিম্নআয়ের মানুষের নাভিশ্বাস

বিশ্বে মোটা চালের দাম এখন সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশে। একই সঙ্গে দেশীয় বাজারেও অতীতের সব রেকর্ড ভেঙেছে এই চালের দাম। রাজধানীর বাজারে মোটা চালের খুচরা দর উঠেছে ৫০ থেকে ৫৫ টাকায়। আর মধ্যবিত্তের কাছে জনপ্রিয় মিনিকেট চাল প্রতি কেজি ৬৪ থেকে ৬৮ টাকায় উঠেছে। ভালো মানের নাজিরশাইল চাল বিক্রি হচ্ছে ৭০ টাকার ওপরে। এদিকে চালের মূল্য বৃদ্ধির কারণে নাভিশ্বাস উঠেছে নিম্নআয়ের মানুষের।

২০০৭ এবং ২০০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে মোটা চালের কেজি ৪০ টাকা এবং সরু চালের কেজি ৫৬ টাকা হয়েছিল। বর্তমানে চালের বাজারে যে টালমাটাল অবস্থা তা আর কখনও হয়নি।
সার্বিকভাবে এই অঞ্চলের ধান উৎপাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে এখন বাংলাদেশেই মোটা চালের দাম সবচেয়ে বেশি। চাল-গমের দামবিষয়ক দৈনিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে খাদ্য মন্ত্রণালয়। তাতে বলা হয়েছে, বর্তমানে বিশ্বে সবচেয়ে সস্তায় চাল বিক্রি করছে পাকিস্তান। সেখানে চালের দাম পড়ে প্রতি কেজি ৩৩ টাকা ৪৫ পয়সা। প্রতিবেশী দেশ ভারতে প্রতি কেজি চালের দাম ৩৭ টাকা ০৯ পয়সা, থাইল্যান্ডে ৩৬ টাকা ৩৬ পয়সা ও ভিয়েতনামে ৩৫ টাকা ৭১ পয়সা। এর মধ্যে পাকিস্তান ও ভিয়েতনামে চালের দাম কমেছে। এর বাইরে বিশ্বের সর্ববৃহৎ চাল উৎপাদনকারী দেশ চীন ও ইন্দোনেশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্র চাল উৎপাদন করলেও তারা তা আন্তর্জাতিক বাজারে বিক্রি করে না। উল্টো তারা কিছু চাল আমদানি করে থাকে। এই হিসেবে সবচেয়ে বেশি দামে বাংলাদেশেই চাল বিক্রি হচ্ছে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) ‘এগ্রি মার্কেট’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত এক বছরে ভিয়েতনাম ও পাকিস্তান ছাড়া বিশ্বের মোটা চাল বিক্রয়কারী সব দেশে চালের দাম বেড়েছে। থাইল্যান্ডে ৩.২৯ শতাংশ, ভারতে ৩.১৪ শতাংশ ও রাশিয়ায় প্রায় ১ শতাংশ বেড়েছে। এফএওর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছরের তুলনায় এ বছর বিশ্বে চালের উৎপাদন ৬ লাখ টন কমবে। ২০১৬-১৭ সালে বিশ্বে চাল উৎপাদন হয়েছিল ১৭ কোটি ১৩ লাখ টন। এই অর্থবছরে তা কমে ১৭ কোটি ৭ লাখ টন হতে পারে।
সরকারের বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, চালের দাম বেশি বেড়েছে গত ৬ মাসে। দাম বাড়তে বাড়তে এখন সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। গত জানুয়ারিতে মোটা চালের (স্বর্ণা এবং পারিজা) কেজি ছিল ৪০ টাকা। ফেব্রুয়ারিতে তা বেড়ে হয় ৪২ টাকা। এরপর মার্চে ৪৪ টাকা, এপ্রিলে ৪৬ টাকা এবং মে মাসে এসে হয় ৪৭ থেকে ৪৮ টাকা। আর জুন মাসে সেটি বেড়ে হয়েছে ৫০ টাকা। অথচ গত বছরের জুনেও এক কেজি মোটা চাল মিলেছে মাত্র ৩০ থেকে ৩২ টাকায়।

টিসিবির তথ্য বলছে, গত এক বছরের ব্যবধানে মোটা চালের দাম বেড়েছে ৫০.৭২ শতাংশ। আর মাসিক মূল্যের ভিত্তিতে মোটা চালের দাম বেড়েছে ১৮.১৮ শতাংশ। গত বছর সেপ্টেম্বরে মোটা চালের কেজিপ্রতি দাম ছিল ৩৩ থেকে ৩৬ টাকা। আর বর্তমানে এই মানের চাল কেজিপ্রতি বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৫৪ টাকা দরে। আর এক সপ্তাহে কেজিতে দাম বেড়েছে ৭ থেকে ৯ টাকা। টিসিবির তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে সরু চাল কেজিপ্রতি বিক্রি হচ্ছে ৬২ থেকে ৬৮ টাকা। গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে এই মানের চালের দাম ছিল ৪৫ থেকে ৫৫ টাকা। এখন উত্তম মানের নাজির ও মিনিকেট ৬৫ থেকে ৬৮ টাকা। এক সপ্তাহে কেজিতে দাম বেড়েছে ১০ টাকা। আর বর্তমানে সাধারণ মানের নাজির ও মিনিকেট ৬২ থেকে ৬৬ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গত বছর এই মানের চালের কেজি ছিল ৪৫ থেকে ৪৮ টাকায়। এক সপ্তাহে কেজিতে দাম বেড়েছে ১০ টাকা। পাইজাম ও লতা উত্তম মানের ৫৮ থেকে ৬০ টাকা। আর সাধারণ মানের ৫৫ থেকে ৫৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গত বছর এই মানের চালের কেজি ছিল ৪০ থেকে ৪২ টাকায়। এক সপ্তাহে কেজিতে দাম বেড়েছে ১০ টাকা। এদিকে স্বর্ণা ও চায়ন ইরি মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৫৪ টাকায়। সংস্থাটির তথ্য মতে, মাসের ব্যবধানে সরু চালের দাম বেড়েছে ১৬.০৭ শতাংশ। এছাড়া সাধারণ মানের নাজিরশাইল ও মিনিকেট ১৭.৫৯, উত্তম মানের নাজিরশাইল ও মিনিকেট ১৪.৬৬, সাধারণ মানের পাইজাম ও লতা চাল ১৮.৫৬, উত্তম মানের পাইজাম ও লতা চাল ১৮.৯৫, স্বর্ণা ও চায়না ইরি চালের দাম বেড়েছে ১৮.১৮ শতাংশ।

কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের তথ্য মতে, ঢাকার বাজারে মোটা চালের পাইকারি মূল্য প্রতি কেজি ৪৮ থেকে ৫০ টাকা। খুচরা মূল্য প্রতি কেজি ৫০ থেকে ৫২ টাকা। সপ্তাহের ব্যবধানে এই মানের চালের দাম বেড়েছে প্রায় ১৪ শতাংশ। অন্যদিকে পাইকারিতে সরু চাল বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৬৬ টাকায়। আর খুচরায় বিক্রি হচ্ছে ৬২ থেকে ৭০ টাকায়। সপ্তাহের ব্যবধানে এই মানের চালের দাম বেড়েছে প্রায় ১১ শতাংশ।
খাদ্যনীতি নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (ইফপ্রি) হিসাবে, এর আগে ২০১৬ সালের অক্টোবরে দেশের মধ্যে প্রতি কেজি চালের দর ৩৮ টাকায় উঠেছিল। ২০০৮ সালে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে প্রতি কেজি চাল ছিল ৩৬ টাকা। এরপর ২০০৯ সালে ধানের বাম্পার ফলনের পর দেশে চালের দাম কমতে থাকে। ২০১২ সালে প্রতি কেজি চাল ২৬ টাকায় নেমে আসে। ২০১৪ সালে চালের দর আবারও বাড়তে থাকে। ২০১৪ সালে ৩০ এবং ২০১৫ সালে ৩৩ টাকায় ওঠে চালের দর। ২০১৬ সালে মোটা চালের দর ৩৪ টাকায় বিক্রি হয়েছে। বর্তমানে মোটা চালের দর ৫০ টাকার ওপরে উঠেছে।
এদিকে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ সালে দেশে মোটা চালের জাতীয় খুচরা গড় দাম ছিল কেজিপ্রতি প্রায় ২৬ টাকা। পরের দুই বছর তা যথাক্রমে ৩০ ও ৩৩ টাকা ছিল। ২০১৫ সালে মোটা চালের গড় দাম ছিল কেজিপ্রতি ২৮ টাকা ৬৭ পয়সা।
ইফপ্রির ২০১৫ সালের জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশের মানুষের গড়ে খাদ্যশক্তির (ক্যালরি) ৬৫ শতাংশ আসে চাল বা ভাত থেকে। আর প্রতিদিন তারা খাবারের পেছনে যে অর্থ ব্যয় করে, তার ২৭ শতাংশ যায় চাল কিনতে। সংস্থাটির পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী দাম বাড়লে গরিব মানুষ ভাত খাওয়া কমিয়ে দেয়।

এদিকে ভোক্তাদের অধিকার নিয়ে কাজ করা কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) এক প্রতিবেদনে বলা হয়, দুই কোটির বেশি মানুষ তাদের আয়ের ৭০ শতাংশ চাল কিনতে খরচ করে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দেশে ৩ কোটি ৪৯ লাখ ৬৮ হাজার টন চাল উৎপাদিত হয়েছে, যা আগের বছরের চেয়ে ২ লাখ ৫৮ হাজার টন বেশি। উৎপাদন বৃদ্ধির পরও মৌসুম শেষে এসে মিনিকেট ও আটাশ চালের সরবরাহে টান পড়েছে, এ দুটি চাল বোরোতে উৎপাদিত হয়।

ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, কয়েক মাস ধরে মোটা চালসহ অন্য চালের দাম বেড়েই চলেছে। চিকন চালের তুলনায় মোটা চালের দাম বেশি বেড়েছে। তিনি বলেন, বাজারে মোটা চালের বর্তমান দাম প্রতি কেজি ৪৯ থেকে ৫৫ টাকা। তিনি বলেন, চালের দাম বৃদ্ধির বিষয়ে সরকার একেক সময় একেক রকম কথা বলছে। সবকিছুকে পুঁজি করে মধ্যস্বত্বভোগী, মিলার, আড়তদার মিলে দাম দিন দিন বাড়িয়ে চলছে। তিনি বলেন, রাজধানীর পাইকারি বাজার থেকে খুচরা বাজারে পণ্যের দামের অনেক ব্যবধান। এ জন্য সরকারের বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করা প্রয়োজন।

এদিকে চালের আকস্মিক এ মূল্যবৃদ্ধিতে নাভিশ্বাস উঠেছে সাধারণ মানুষের। এ খাদ্য দ্রব্যের দাম এখন নাগালের বাহিরে চলে যাচ্ছে। নিম্ন আয়ের এবং দিনমজুরদের এখন নির্ভর করতে হচ্ছে চালের পরিবর্তে আটা-ময়দার ওপর। চালের দাম বাড়ায় মধ্যবিত্তদের হতাশা ক্রমশ বেড়েই চলছে। চায়ের দোকানদার মানিক মিয়া বলেন, এখন চাল কিনতে গেলে ভয় লাগে। বাজারে যেয়ে প্রথম চাল কিনি তারপর যে টাকা থাকে তা দিয়ে বাকি খরচ করি। আমার পরিবারের প্রতিদিন জন্য ৫ কেজি চাল লাগে। চায়ের দোকান করে যে টাকা আয় হয় তাতেই সংসার চলে না এখন তো আরো বিপদ।
নিরাপত্তা রক্ষী খালেকুর রহমান সবুজ বলেন, বাজারে ৫৫ টাকার নিচে চাল নেই, ভাত না খেলেও হয় না। দশ হাজার টাকা বেতনের চাকরি দিয়ে ৫ জনের সংসার কেমন করে চলে?

কাওরান বাজার থেকে কলা কিনে বিভিন্ন দোকানে সরবরাহ করেন রফিকুল ইসলাম (৭০)। চালের দামের কথা উঠতেই তিনি কিছুটা অসহায়ের মতো জানান, তার ছেলে রিকশা চালায়। সেই রিকশার টাকাতেই চলছে ৭ জনের সংসার। ছেলেকে সাহায্য করতে এই বয়সে কলা সরবরাহের কাজ করেন। সারাদিনে আয় হয় মাত্র ২০০ থেকে ২৫০ টাকা। এই টাকা জমিয়ে ঘর ভাড়া দেন ছেলেকে সাহায্য করার জন্য। কিন্তু ইদানীং সেই টাকা জমছে না। কারণ চাল কিনতে হিমশিম খাচ্ছে তার ছেলে। তাই অন্য খরচ করতে হয় ঘর ভাড়ার টাকা দিয়ে। মাস শেষে ঘর ভাড়া দিবেন কি দিয়ে সেই চিন্তা তার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে সব সময়। ফুসকা বিক্রেতা রশিদ বলেন, যে চাল খাওয়া যায় না, গন্ধ হয় সেই চাল এখন কিনতে পারছি না। আবার বাড়িওয়ালা এই মাস থেকে চালের দাম বেশি এই কথা বলে ২০০ টাকা ঘর ভাড়া বাড়িয়ে দিল। বিপদে আছি ভাই, এমনিতেই সংসার চলছে না তার উপর চালের দাম বেশি, ঘর ভাড়াও বাড়লো।
রাজধানীর নীলক্ষেতের বাসিন্দা নাহিদ হাসান বলেন, চালের দাম যে পর্যায়ে গেছে, এইভাবে চলতে থাকলে তো সাধারণ মানুষ কিছুদিন পর ভাত খাওয়া ছেড়ে দিবে। এক কেজি মোটা চালও যদি ৫০ টাকা দিয়ে কিনতে হয়, তাহলে অন্যান্য খাবার সরঞ্জাম কিনবো কিভাবে?

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=83675