১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭, মঙ্গলবার, ১০:২৪

যথাসময়ে শিশুদের বই পাওয়ায় শঙ্কা

পাঠ্যবই মুদ্রাকররা হঠাৎ ধর্মঘটে

টেন্ডারের শর্ত অনুযায়ী কার্যাদেশ প্রদানসহ বিভিন্ন দাবিতে ধর্মঘট ডেকেছেন বিনা মূল্যের পাঠ্যবই সরবরাহকারীরা। সোমবার থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য পাঠ্যবই মুদ্রণ, বাঁধাই ও সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছেন তারা। চলতি বছরের পাঠ্যবই মুদ্রণ প্রক্রিয়ায় এমনিতেই ধীরগতি চলছে। এখনও অর্ধেকের মতো বইয়ের টেন্ডারই শেষ হয়নি। এমন পরিস্থিতিতে মুদ্রণকারীদের এ ধর্মঘটে আগামী বছরের বিনা মূল্যের পাঠ্যবই যথাসময়ে পৌঁছানো নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হল বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ধর্মঘটের বিষয়টি নিশ্চিত করে মুদ্রণ শিল্প সমিতির সভাপতি তোফায়েল খান সোমবার যুগান্তরকে বলেন, এনসিটিবি নিজেই নিজের শর্ত ও আইন-কানুন মানে না। তারা চায় বই ছাপার কাজটি ব্যর্থ হোক। এ কারণে নানা ধরনের বেআইনি কাজ করছে। তার প্রতিবাদে আমরা আজ বইয়ের মুদ্রণসহ সব ধরনের কাজ বন্ধ করে দিয়েছি। সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত আমাদের এ অবস্থান অব্যাহত থাকবে। বিনা মূল্যের পাঠ্যবই মুদ্রণের সার্বিক কাজ পরিচালিত হচ্ছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) থেকে। সংস্থাটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা মুদ্রণকারীদের এ ধর্মঘটকে রাষ্ট্র ও জাতীয় চেতনাবিরোধী কাজ হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, তাদের কার্যক্রম রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যাচ্ছে। মুদ্রণকারীরা নিজেদের স্বার্থে বিভিন্ন বিষয়ে বেআইনি দাবি ও শর্ত দিয়েছেন। সরকারি ক্রয় আইন (পিপিআর) অনুযায়ী তা মানা যায় না। তারপরও তা বিবেচনার লক্ষ্যে ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে আলাপ-আলোচনা চলছে। কিন্তু এরপরও জিম্মি করতে চাচ্ছেন তারা। রাষ্ট্রকে জিম্মি করলে তা রাষ্ট্র অবশ্যই দেখবে। বিনা মূল্যে বিতরণের জন্য সরকার এবার ৫টি টেন্ডারে ভাগ করে ৩৫ কোটি ১৩ লাখ ২৬ হাজার ২০৭টি বই মুদ্রণ কাজ করাচ্ছে। এর মধ্যে নবম শ্রেণীর ১২টি পাঠ্যবই ‘সুখপাঠ্যকরণ’ নাম দিয়ে সংশোধন করে নতুনরূপে তৈরি করা হচ্ছে। এগুলো হল : বাংলা, ইংরেজি, পদার্থ, রসায়ন, জীববিদ্যা, উচ্চতর গণিত, বিজ্ঞান, বাংলাদেশের ইতিহাস ও সভ্যতা, অর্থনীতি, বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয় হিসাববিজ্ঞান ইত্যাদি। জানা গেছে, এসব বইয়ের টেন্ডার প্রক্রিয়া এখনও শেষ হয়নি।
মাধ্যমিক স্তরের বাকি বইসহ দাখিল ও ইবতেদায়ি স্তরের বই নিয়ে আলাদা টেন্ডার দেয়া হয়েছে। এসব বইয়ের মুদ্রণ ও সরবরাহ কাজ চলছিল। কিন্তু এগুলোর মুদ্রণ, বাঁধাই ও সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। কয়েকদিন আগে প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যবইয়ের মুদ্রণকাজ শুরু হয়েছে। তবে এখনও সরবরাহ শুরু হয়নি। প্রি-প্রাইমারি বইয়ের টেন্ডার এখনও শেষ হয়নি। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বইয়ের টেন্ডারও এখন পর্যন্ত দেয়া হয়নি।

সূত্রগুলো জানায়, শুধু টেন্ডার প্রক্রিয়াতেই বেহাল দশা নয়, টেন্ডার কার্যক্রমে নানা অনিয়ম-দুর্নীতিরও অভিযোগ উঠেছে। এ নিয়ে দাতা সংস্থা বিশ্বব্যাংক, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে অভিযোগ জমা পড়েছে। টেন্ডার প্রক্রিয়ার এসব অনিয়মে এনসিটিবির একজন মাত্র ব্যক্তির জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে। ওই ব্যক্তি একই সঙ্গে এনসিটিবির উৎপাদন ও বিতরণ শাখায় যখন কর্মরত ছিলেন তখন এ ঘটনা ঘটে বলে দাবি মুদ্রণকারীদের।
মুদ্রণ শিল্প সমিতি সূত্র জানায়, উল্লিখিত বইয়ের কাজের মধ্যে কাগজসহ একটি টেন্ডারে ৩৩০ লটে এবং কাগজ ছাড়া ২২০ লটে দুই টেন্ডারে ইবতেদায়ি, দাখিল, সহপাঠ, ব্যাকরণ ও মাধ্যমিকের একাংশ বই ছাপা হচ্ছে। এই দুই টেন্ডারের কার্যাদেশ দেয়ার ক্ষেত্রে নানা অনিয়মের অভিযোগ আছে। কালো তালিকার এবং কালো তালিকাভুক্ত হতে পারে এমন প্রতিষ্ঠানকে অনিয়ম করে কাজ দেয়া হয়েছে। ২০১৫ সালে লামিয়া নামে একটি প্রতিষ্ঠান বইয়ের মুদ্রণকাজ নিয়ে কাগজ সংক্রান্ত কেলেঙ্কারির দায়ে কালো তালিকাভুক্ত হয়। গত বছর নিজের স্ত্রীকে মালিক বানিয়ে একই স্থানে একই মেশিনে প্লাসিড প্রিন্টার্স নামে কাজ নেয়। বিভিন্ন অপরাধে এ প্রতিষ্ঠানও ফের চিহ্নিত হয়ে জরিমানার শিকার হয়। এরপর একই ঠিকানায় এ বছরও রেজা প্রিন্টার্স নামে কাজ পেয়েছে বলে জানা গেছে। এ ছাড়া সর্বনিম্ন দরদাতাকে কাজ না দেয়া, ঠিকানামতো প্রেস না থাকা প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়াসহ নানাভাবে টেন্ডার শর্ত পূরণ না করা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান কাজ পেয়েছে।

মুদ্রণ শিল্প সমিতির সভাপতি বলেন, মোট ৩৫টি প্রতিষ্ঠান কাজ নিয়ে অন্যের ছাপাখানায় বই ছাপাচ্ছে। এনসিটিবিরই পরিদর্শন প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। কিন্তু টেন্ডার শর্ত লঙ্ঘন করা প্রতিষ্ঠানগুলোকে এনসিটিবি ‘সুখপাঠ্যকরণের’ টেন্ডারে কাজ দিতে চাচ্ছে। আমরা এর প্রতিবাদ করেও প্রতিকার পাচ্ছি না।
এ ব্যাপারে এনসিটিবি চেয়ারম্যানের দাবি, এখন পর্যন্ত এই টেন্ডারের মূল্যায়ন কাজই শেষ হয়নি। সেখানে কাকে কাজ দেয়া হচ্ছে, সেটা তারা আগাম কী করে বলে? নাম প্রকাশ না করে একজন মুদ্রাকর বলেন, নানা অভিযোগের কারণে বিশ্বব্যাংক থেকে প্রাথমিকের ২টি লটের কাজের অনাপত্তি আটকে দিয়েছিল।

এদিকে জটিলতার পেছনে প্রাথমিকের বইও আছে। এবার গতানুগতিক বস্তাবন্দির পরিবর্তে প্যাকেট করে বই সরবরাহের শর্ত আছে টেন্ডারে। মুদ্রাকররা বলছেন, এতে সময়ক্ষেপণ হচ্ছে। বই ছাপা ও বাঁধাইয়ের পর আমরা প্যাকেজ করি। এনসিটিবির কর্মকর্তা এলে তা ভেঙে একবার দেখাই। উপজেলায় বই পৌঁছানোর পর ফের প্যাকেট ভাঙতে হয়। এভাবে বারবার প্যাকেট করায় অতিরিক্ত খরচ পড়ে যাচ্ছে। মুদ্রাকররা আরও জানান, প্রাথমিকের বইয়ের কাজ ৪২ দিনে শেষ করার কার্যাদেশ দিয়ে বইয়ের সিডি দিয়েছিল এনসিটিবি। কিন্তু প্রেসে গিয়ে সিডি খুলে দেখা যায়, প্রাথমিকের নয়, ইবতেদায়ি স্তরের বইয়ের সিডি। এরপর এনসিটিবি ভুল সিডি ফেরত নেয়। এরপর নতুন সিডি দেয়ার আগে যে ক’দিন চলে গেছে, তা বাড়িয়ে দিতে অনুরোধ করা হয়। কিন্তু এনসিটিবি ৯ দিন কম দিয়েছে। কিন্তু এনসিটিবির এই ভুলের খেসারত দিতে হবে মুদ্রাকরদের। শেষদিকে জরিমানার শিকার হতে হবে। মুদ্রণ শিল্প সমিতির সভাপতি তোফায়েল খান বলেন, এভাবে বেশকিছু সমস্যা ও এনসিটিবির বেআইনি কাজ আছে। সেগুলো সমাধানে এক সপ্তাহের আলটিমেটাম দেয়া হয়েছিল। সময় পার হয়েছে সোমবার। এরপর আমরা ধর্মঘটের ডাক দিয়েছি।

এ ব্যাপারে এনসিটিবির চেয়ারম্যান বলেন, প্রাথমিকের বই নতুন প্যাকেটে দেয়ার শর্ত মেনেই মুদ্রাকররা কাজ নিয়েছেন। এখন খরচ কমানোসহ ব্যক্তিস্বার্থে তারা বেআইনি কথা বলছেন। প্রাথমিকের যে সময় নষ্ট হয়েছে তা বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। আর প্রাথমিকের বইয়ের প্যাকেজিংয়ের বিষয়ে আমরা প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের (ডিপিই) সঙ্গে কথা বলছি। তারা দাবি মানলে আমরা মুদ্রাকরদের জানিয়ে দেব। কিন্তু তারা এখন যা করছে বলে আপনার কাছে শুনলাম তা রাষ্ট্রবিরোধী কাজ।

https://www.jugantor.com/first-page/2017/09/19/156673