১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭, সোমবার, ২:৩৭

টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদন

অর্থপাচার ও অবৈধ অর্থ প্রবেশ বেড়েছে

বিদেশে অর্থপাচার ও দেশের ভেতরে অবৈধভাবে অর্থ প্রবেশের হার ১২০ শতাংশ বেড়েছে। প্রয়োজনীয় আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ থেকে বাইরে ও বাইরে থেকে দেশের ভেতরে অর্থপাচারের পরিমাণ ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। অর্থপাচার রোধে নিয়ন্ত্রক ও তদারকি প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতার ঘাটতি চিহ্নিত করা যায়। বাংলাদেশে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণমূলক কার্যক্রম প্রত্যাশিত পর্যায়ের নয়। বড় ধরনের অর্থপাচারের সাথে জড়িতদের আমরা কোনোভাবে আইনের আওতায় আনতে পারিনি। উল্টো বড় দুর্নীতিবাজদের সুরক্ষা দেয়া হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। তারা বলছে, টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট ১৬ : অর্জনের জন্য প্রয়োজন, আইনের বিভিন্ন সংস্কার, প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে দুর্নীতি রোধ ও স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা বৃদ্ধি, দুর্নীতির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রকাশের জন্য দুর্নীতিগ্রস্ত জনপ্রতিনিধি, উচ্চ পদের সরকারি কর্মচারী ও অন্যদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ও দৃশ্যমান ব্যবস্থা নিতে হবে। আর টিআইবির চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, আমাদের দেশে সার্বিকভাবে বিচারহীনতার সংস্কৃতি রয়েই গেছে। পাশাপাশি রয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) আয়োজিত ‘টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট ১৬ : দুর্নীতি প্রতিরোধ ও সুশাসন সংশ্লিষ্ট লক্ষ্যের ওপর বাংলাদেশের প্রস্তুতি, বাস্তবতা ও চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে গতকাল রোববার এসব তথ্য জানানো হয়। সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির প্রতিবেদনটি তুলে ধরেন, সংস্থার সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার শাহজাদা এম আকরাম। অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য রাখেন : টিআইবির চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল ও নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। সার্বিকভাবে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টের (এসডিজি) বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য ২৪১টি সূচকের মধ্যে সরকারের কাছে ৭০টি সূচকের ওপর সম্পূর্ণ এবং ১০৮টি সূচকের ওপর আংশিক তথ্য রয়েছে। ৬৩টি সূচকের ওপর সরকারি কোনো তথ্য নেই।

টিআইবি বলছে, টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট ১৬ : অর্জনে দুর্নীতি প্রতিরোধ এবং সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। অন্তর্ভুক্তি এসডিজি ১৬-এর লক্ষ্যগুলোর প্রায় সবগুলোর ক্ষেত্রে কিছু কিছু ঘাটতি সত্ত্বেও বাংলাদেশে আইন, নীতি ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রস্তুতি যথেষ্ট পরিপুষ্ট। তবে কোনো কোনো আইনের দুর্বলতা রয়েছে। আবার কোনো কোনো আইনের অপব্যবহার লক্ষ করা যায়। দলীয় বিবেচনায় আইনের প্রয়োগ হয় বলে দেখা যায়। বিভিন্ন উদ্যোগ সত্ত্বেও বাংলাদেশে দুর্নীতি ও ঘুষ, অর্থপাচার, মৌলিক স্বাধীনতার ব্যত্যয় ও মানবাধিকার লঙ্ঘন অব্যাহত রয়েছে। জাতীয় শুদ্ধাচার কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো প্রত্যাশিত পর্যায়ে কার্যকর নয়। আর কার্যকর না হওয়ার পেছনে দলীয় রাজনীতির প্রভাব, কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা, নির্বাহী বিভাগ এবং প্রশাসনের আধিপত্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানেই জনগণের কাছে জবাবদিহিতার কোনো কাঠামো নেই। পাশাপাশি এসব প্রতিষ্ঠানে অভ্যন্তরীণ জবাবদিহিতার ব্যবস্থাও দুর্বল। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০০৬-এর ৫৭ ধারার অপব্যবহার এবং গণমাধ্যমবিষয়ক কয়েকটি খসড়া আইন ও নীতিমালার মাধ্যমে মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ ও বাধানিষেধ বৃদ্ধির আশঙ্কাজনক প্রবণতা দেখা যায়।

গবেষণার পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, বিভিন্ন পর্যায়ে সরকারি কর্মচারী নিয়োগে দুর্নীতি হচ্ছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কার্যকরিতাও প্রত্যাশিত পর্যায়ের নয়। গত ১০ বছরে দেশে অপরাধের হার প্রায় অপরিবর্তিত রয়েছে। এসব সংস্থার বিরুদ্ধে বিচারবহির্ভূত হত্যা, বিনাবিচারে আটকে রাখা ও গুমের অভিযোগ থাকলেও বিচারবহির্ভূত হত্যা সম্পর্কে পরিসংখ্যান প্রকাশ করা হয় না। গবেষণায় আরো দেখা যায়, সক্ষমতার সীমাবদ্ধতার কারণে মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক সব সরকারি প্রতিষ্ঠানের নিরীক্ষা প্রতি বছর সম্পন্ন করতে পারে না। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ও তথ্য কমিশনের অনিষ্পন্ন অভিযোগের জট রয়েছে। প্রতিষ্ঠান দু’টিতে কমিশনারদের নিয়োগপ্রক্রিয়া অস্বচ্ছ। বাংলাদেশের কিছু গণমাধ্যম এবং নাগরিক সমাজ ও এনজিও খাত অনেক ক্ষেত্রে প্রভাবান্বিত। আইনে বিদ্যমান ঘাটতির কারণে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কার্যকরিতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে গবেষণায় চিহ্নিত করা হয়েছে। এ ছাড়া দলীয় রাজনৈতিকসহ বিভিন্ন পর্যায়ে নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাব বিস্তার এবং বাজেট ও প্রশাসনিক জনবলের জন্য সরকারের ওপর নির্ভরশীলতার ফলে অনেক প্রতিষ্ঠানের কার্যকরিতা প্রত্যাশিত পর্যায়ে নেই বলে পরিলক্ষিত হয়েছে।

সুলতানা কমাল বলেন, রাষ্ট্র ও আইনের চোখে দেশের সব নাগরিক সমান। কিন্তু এটা আমরা করতে পারিনি। আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোতে স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতার অভাব রয়েছে। এখানে দুই কোটি ৫০ লাখ শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে। তিনি বলেন, ‘টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জনের লক্ষ্যে নানামুখী পরিকল্পনা ও উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও বিভিন্ন জরিপ ও তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে এর সুফল সব ক্ষেত্রে জনগণ পর্যন্ত পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না।

ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বড় ধরনের অর্থপাচারে জড়িতদের আমরা কোনোভাবে আইনের আওতায় আনতে পারিনি। উল্টো বড় দুর্নীতিবাজদের সুরক্ষা করতে দেখেছি। সোনালী ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক, হলমার্ক এর জ্বলন্ত উদাহরণ। তিনি বলেন, অর্থপাচার প্রতিরোধ ও চুরি যাওয়া সম্পদ পুনরুদ্ধারে নিয়ন্ত্রক ও তদারকি প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতার ঘাটতি, সব পর্যায়ে দুর্নীতির বিস্তার রোধে প্রত্যাশিত মাত্রায় নিয়ন্ত্রণমূলক কার্যক্রমের অভাব রয়েছে। ব্যাংক খাতের কেলেঙ্কারিগুলোতে দোষীদের বিচারের আওতায় নিয়ে আসার ক্ষেত্রে ব্যর্থতার মতো উদাহরণ সার্বিকভাবে অভীষ্ট অর্জনের অগ্রগতির সাথে সাংঘর্ষিক।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/252707