নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার দর পর্যবেক্ষণ এবং ন্যায্যমূল্যে পণ্য সরবরাহের দায়িত্বে নিয়োজিত সরকারি প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্যানুযায়ী, রাজধানী ঢাকায় গতকাল প্রতি কেজি মোটা ইরি চাল বিক্রি হয় ৫০ থেকে ৫৪ টাকা কেজি দরে। একই মানের চাল এক বছর আগে অর্থাৎ গত বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর বিক্রি হয় ৩৩ থেকে ৩৬ টাকা কেজি দরে। টিসিবির হিসাবেই এক বছরে গরিবের খাদ্য মোটা চালের দাম বেড়েছে প্রায় ৫১ শতাংশ অর্থাৎ দেড় গুণেরও বেশি।
বাজারের প্রকৃত চিত্র অবশ্য আরো নেতিবাচক। রাজধানীর বেশির ভাগ খুচরা বাজার এবং মুদি দোকানে গতকাল ৫৪ থেকে ৫৬ টাকা কেজি দরে মোটা চাল বিক্রি করতে দেখা যায়। ভালো মানের নাজিরশাইল ও মিনিকেট চাল বাজারে ৭০ থেকে ৭২ টাকায় বিক্রি হলেও টিসিবির প্রতিবেদনের ৬৫ থেকে ৬৮ টাকা উল্লেখ করা হয়। এক বছর আগে ছিল ৪৮ থেকে ৫৫ টাকা। এ ক্ষেত্রে এক বছরে ৩৮ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধির কথা জানায় টিসিবি।
টিসিবির হিসাবে মাঝারি মানের পাইজাম চাল গতকাল বিক্রি হয় ৫৫ থেকে ৫৮ টাকা দরে। এক বছর আগে ছিল ৪০ থেকে ৪২ টাকা। ২০১৫ সালের একই দিনে দাম ছিল ৩৮ থেকে ৪০ টাকা। মাঝারি মানের চালের দাম এক বছরে ২৯ শতাংশ এবং দুই বছরে ৪৫ শতাংশ বেড়েছে বলে জানায় এ সরকারি সংস্থা। টিসিবির মতে, গত দুই বছরে সরু চালের দাম বেড়েছে ৫৫ শতাংশ।
গতকাল রাজধানী ঢাকার কয়েকটি পাইকারি ও খুচরা বাজার ঘুরে রীতিমতো নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি চোখে পড়ে। একই মানের চালের দাম একেক বাজারে একেক রকম। পাইকারি বাজারের সাথে খুচরা বাজারের সামঞ্জস্য নেই। মিল নেই এক দোকানের সাথে পাশের দোকানের। যে যার মতো করে দাম হাঁকছেন। ইচ্ছে মতো ক্রেতার গলা কাটছেন। আর কিছু মানুষ হুজুগে পড়ে বস্তায় বস্তায় চাল কিনে মজুদ গড়ছেন। চালের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য এসব লোককেও দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বাজারে চালের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল রোববার থেকে খোলা বাজারে বিক্রি (ওএমএস) শুরু করেছে সরকার। ঢাকায় ১১০টি ট্রাক নেমেছে। এ ছাড়া চট্টগ্রাম, রংপুর, দিনাজপুর ও রাজশাহী শহরে চাল বিক্রি শুরু হয়েছে। তবে তা সিদ্ধ নয়, আতপ চাল। দামও ১৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০ টাকা করা হয়েছে। প্রথম দিন বড় বড় শহরে সীমিত আকারে ওএমএসে চাল বিক্রি শুরু হলেও আজ সোমবার থেকে জেলাপর্যায় পর্যন্ত চাল বিক্রি করা হবে বলে জানিয়েছেন খাদ্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা। তবে সিদ্ধ চালের পরিবর্তে আতপ চাল এবং এর দাম দ্বিগুণ হওয়ায় ক্রেতাদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা যায়। তাদের অভিযোগ, দেশের বেশির ভাগ অঞ্চলের মানুষ আতপ চালের ভাত খেতে অভ্যস্ত নন।
খাদ্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সরকারি গুদামে সিদ্ধ চালের সঙ্কট, এ জন্য ওএমএসে আতপ চাল দেয়া হচ্ছে। সরকার বোরো সংগ্রহ করতে পারেনি। অন্য দিকে বিদেশ থেকে যে চাল আমদানি করা হচ্ছে তাও আতপ। তাই চালের দাম বেড়ে যাওয়ার প্রোপটে ওএমএসের চাল বিক্রি শুরু হলেও গরিবের স্বস্তি ফিরছে না।
সন্তোষজনক বাড়তি মজুদ থাকায় আমদানি নিরুৎসাহিত করতে ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে চালের শুল্কহার ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ করেছিল সরকার। এর সাথে রেগুলেটরি ডিউটি তিন শতাংশ যোগ হওয়ায় ব্যবসায়ীদের ২৮ শতাংশ শুল্ক গুনতে হতো। ফলে গত দেড় বছর ধরে বেসরকারি পর্যায়েও চাল আমদানি প্রায় বন্ধ ছিল। কিন্তু চালের মজুদ কমতে কমতে দেড় লাখ টনের ঘরে চলে আসায় এবং দাম কেজিপ্রতি ৬০ টাকা ছাড়িয়ে যাওয়ায় আমদানি শুল্ক কমাতে বাধ্য হয় সরকার। রমজানের শেষ ভাগে এসে আমদানি বাড়াতে বিদ্যমান শুল্কহার ২৮ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশে নামিয়ে আনার ঘোষণা দেয় সরকার। আগস্টের মাঝামাঝিতে এসে আরো ৮ শতাংশ কমিয়ে নির্ধারণ করা হয় মাত্র ২ শতাংশ। তফসিলি ব্যাংকগুলোকে বিনা বিনিয়োগে আমদানি ঋণপত্র (এলসি) খোলার অনুমতি দেয়ার নির্দেশ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু তত দিনে বিশ্ববাজারে চালের দাম বেড়ে যাওয়ায় এবং সরকারি গুদামে পর্যাপ্ত চাল মজুদ না থাকায় বাজার নিয়ন্ত্রণ কোনোভাবেই সম্ভব হচ্ছে না।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দেশে তিন কোটি ৪৯ লাখ ৬৮ হাজার টন চাল উৎপাদিত হয়েছে। চলতি অর্থবছরে উৎপাদনের ল্য তিন কোটি ৫০ লাখ টন। হওরের পরিস্থিতি উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা পূরণে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে বলে আশঙ্কা করেছিলেন সংশ্লিষ্টরা। সে আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম তখন দাবি করেন হাওর ডুবে গেলেও চালের কোনো ঘাটতি হবে না। তার দাবি ছিল, বাংলাদেশে বছরে ১৫ থেকে ২০ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত থাকে। হাওরে ছয় লাখ টন কম উৎপাদন হলেও কোনো ঘাটতি হবে না। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর তখন বলেছিল, এবার বোরো মওসুমে ৪৮ লাখ হেক্টর জমিতে বোরোর আবাদ হয়েছে। এ থেকে এক কোটি ৯১ লাখ টন চাল উৎপাদনের ল্য ঠিক করেছিল সরকার। তবে হাওর তলিয়ে যাওয়ায় তা কিছুটা কম হওয়ার আশঙ্কা আছে। হাওরের দুই লাখ ২৪ হাজার হেক্টর জমিতে বোরোর আবাদ হয়েছিল। সেখান থেকে প্রায় ৯ লাখ টন চাল উৎপাদনের আশা করেছিল অধিদফতর।