১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭, সোমবার, ৯:৪৮

বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে মুসলিমবিশ্বের পরনির্ভরতা নিরাপদ নয়

ইসমাঈল হোসেন দিনাজী : বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ক্ষোভের সঙ্গে বলেছেন, ‘বিশ্ব যখন এগিয়ে চলেছে আমরা তখনও বসে, বিবিতালাকের ফতোয়া খুঁজেছি কুরআন ও হাদিস চষে।’
দীর্ঘ ১১৮ বছরে মাত্র ১২জন মুসলিম নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন। ৫৭টি মুসলিমপ্রধান দেশের মোট বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়েও আমেরিকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বেশি। অধিকাংশ মুসলিমপ্রধান দেশের জাতীয় আয় আসে প্রাকৃতিক সম্পদ অর্থাৎ আল্লাহপ্রদত্ত রিজিক থেকে। মুসলিমপ্রধান দেশগুলোর জাতীয় বাজেটের প্রায় অর্ধেক অর্থ স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের নামে দলীয় নেতাকর্মীদের হাতে তুলে দেয়া হয়। কিন্তু অমুসলিম দেশসমূহ জাতীয় আয়ের সিংহভাগ এমনকি কোম্পানিগুলোকেও বাধ্যতামূলকভাবে লাভের একটা অংশ বিজ্ঞান-গবেষণায় খরচ করতে বাধ্য করে।

তাই ইসরাইলের মতো ক্ষুদ্র দেশেও ৯০ হাজারের অধিক পিএইচডি ডিগ্রিহোল্ডার বসবাস করেন। কিন্তু দেশটিতে মাত্র দেড় কোটি মানুষের অধিবাস। অথচ এপর্যন্ত নোবেলবিজয়ী ১৭৯ জন ইহুদি। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, দাম দেয়া হচ্ছে ক্রিকেট আর অসৎ রাজনীতির। তাই মুসলমানদের আইকন ক্রিকেটার এবং অসৎ রাজনীতিকরা। আজকাল দেশের তরুণরা স্বপ্ন দেখে ক্রিকেটার ও ফুটবলার হবার। তারা আজ স্বপ্ন দেখে না একজন সালাহউদ্দিন আইয়ুবী হবার, বখতিয়ার খিলজী হবার, সুলতান মাহমুদ হবার। নেই ওমর, উসমান, আবুবকর হবার মতো প্রেরণা। কোনও বিজ্ঞানী হবার স্বপ্ন তরুণরা দেখে না। উল্লিখিত নামগুলো হয় তো তারা জানেই না বা আস্তে আস্তে ভুলতে বসেছে। মুসলমানরা আজ কে শিয়া কে সুন্নি, কে হানাফি, কে ওয়াহাবি, কে আহলে হাদিস এসব কূটতর্ক নিয়ে ব্যস্ত। অথচ পৃথিবীব্যাপী ইহুদিদের ৫০ এর অধিক গ্রুপ একত্রিত হয়ে ইসরাইল নামক জারজ রাষ্ট্রটিকে অর্থ আর ক্ষমতা দিয়ে টিকিয়ে রেখেছে। কিন্তু ৫৭টি মুসলিমপ্রধান দেশ কখনই একত্রিত হতে পারে না। তাই কাশ্মির, ফিলিস্তিন, ইরাক, চেচনিয়াও স্বাধীন হয় না।

যখন ইহুদিরা সিএনএন, ইএসপিএন, ফক্স নিউজ, স্কাই নিউজ, টাইমস এর মতো মিডিয়া গড়তে ব্যস্ত, মুসলমানরা তখন পিস টিভি, ইসলামিক টিভি, আল জাজিরা, বন্ধ করতে তৎপর। ইহুদিরা যখন কালমার্কস, আইনস্টাইন, বব ডিলান কিংবা রবার্ট মারডকের মতো জায়নবাদীদের বিশ্বব্যাপী আইকন বানাচ্ছে, তারা তখন আবদুল কাদির, জাকির নায়েক কিংবা ইউসুফ আল কারজাভীর মতো মেধাবীদের ‘সন্ত্রাসী’ অভিধা দিতে মরিয়া। এদেশের সবেধন নীলমণি নোবেলবিজয়ী ড. মুহম্মদ ইউনূস। তার সম্পর্কেও নানা কুৎসা রটিয়ে ‘মহত্ব’ জারি রাখা হয়েছে বিশ্বব্যাপী।

মুসলমানরা আজ জ্ঞান ও গবেষণার রাজ্য থেকে অনেক দূরে। ছোটখাটো বিষয় নিয়ে বহুভাগে বিভক্ত। তাই জ্ঞান-বিজ্ঞান থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন ছিন্নভিন্ন মুসলিম জাতি। মুসলমানরা আজ সংখ্যায় ২০০ কোটি হয়েও উচ্চশিক্ষিত এবং ঐক্যবদ্ধ দেড় কোটি ইহুদির কাছে কোণঠাসা।
লাখ লাখ ফিলিস্তিনীকে নিজভূমি থেকে বিতাড়িত করে ইহুদিরা ইসরাইল নামক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছে। তারা কোটি কোটি টাকা খরচ করছে গবেষণা আর মেধাবীদের মূল্যায়নে। আর মুসলমানরা নিজেরা নিজেরা কামড়াকামড়ি করেন। ফিলিস্তিনীদের অসহায় কান্না দেখেন বসে বসে টিভির পর্দায়। মিয়ানমারে মুসলিমদের ওপর গণহত্যা দেখে কিছুই যেন তাদের করবার থাকে না। প্রকৃত অর্থে মুসলিমবিশ্ব এখন কিংকর্তব্যবিমূঢ়!

মুসলমানদের আজ কোথাও মুখ দেখাবার উপায় নেই। যেখানেই যান তাদের সন্ত্রাসী হিসেবে ট্রিট করা হয়। ঘৃণার তীর নিক্ষেপিত হয় মুসলমানদের প্রতি। কিন্তু কেন? এমন দুরবস্থা তো হবার কথা নয়?
মুসলমানরা এখন আল্লাহর ওপর নির্ভরশীল নন। আল্লাহর মদদ তাদের দরকার নেই। তারা চেয়ে থাকেন ওয়াশিংটন, মস্কো অথবা দিল্লির দিকে। বেইজিং আর টোকিও না হলে তাদের চলে না। আল্লাহকে কোথাও খুঁজে পান না তারা।
বলতে দ্বিধা নেই, ফরজ-ওয়াজিবের দিকে নজর নেই। কিন্তু সুন্নত ও নফল দিয়ে টানাহেঁচড়া করেন। মারামারি, লাঠালাঠি, কাটাকাটির শেষ নেই। আল্লাহর কিতাব আল কুরআনে অবশ্য করণীয় অনেক কিছু আছে। সেদিকে তাদের খেয়াল নেই। কিন্তু বিবিতালাকের ফতোয়া খুঁজতে খুঁজতে জীবন কাবার করে দেন। একতালাক, দুইতালাক, না তিনতালাক তা নিয়ে যুদ্ধ বাঁধান। জীবনপাত ঘটান। ফলে কাজের কাজ হয় না। আকাম করে সময় ও অর্থের অপচয় করেন মাত্র।
অতীতে মুসলমানরা বিজ্ঞানে অনেক অবদান রাখলেও এখন লবঘণ্টা। এর কারণ হচ্ছে এদিকে নজর দেবার অবকাশ তাদের কই! মুসলমানরা এখন গুঁতোগুঁতিতে বিজি। তাই বিজ্ঞানচর্চায় মনোনিবেশ করা বা এখাতে অর্থ বিনিয়োগ তাদের পক্ষে অতোটা এখন ইজি নয়। তারা অস্ত্র ক্রয়ে ব্যস্ত। অভিযোগ রয়েছে, তারা কেউ কেউ লাদেন তৈরিতে অর্থ বিনিয়োগ করেন। অবশ্য পালটা অভিযোগও রয়েছে। লাদেনকে যারা হত্যা করেছে, তৈরিও করেছিল তারাই। ওই যে কথায় বলে না, ‘সর্প হয়ে দংশন করে, ওঝা হয়ে ঝাড়ে।’ বিন লাদেন সৃষ্টি ও তার বিনাশের ব্যাপারটাও সেরকমই।

মহাকবি ইকবাল মুসলমানদের দুর্দশা দেখে বড় আক্ষেপ করে লেখেন, ‘ওযা মে হো তু নাসারা তমুদ্দুন মে হো হনুদ; কিয়া ইয়ে হ্যায় মুসলিম যিসকো দেখ্কে শরমাতে ইয়াহুদ।’ অনুবাদ: শিক্ষায় তুমি খৃস্টান সম, হিন্দুতো তুমি সভ্যতায়; এই কিরে হায় মুসলিম তুমি ইহুদিও দেখে লজ্জা পায় ! ইকবাল যথার্থই বলেছেন। মুসলমানরা আজ সম্বিতহারা। দাঁড়বিহীন নৌকার মতো। গন্তব্য কোথায় তাদের জানা নেই। গড্ডলিকাপ্রবাহে ভেসে যাচ্ছে উদ্দেশ্যহীনভাবে। অথচ মুসলমানদের অঢেল অর্থবিত্ত বিদ্যমান। মাটির নিচে প্রাকৃতিক সম্পদ পড়ে আছে। লুটেপুটে নিচ্ছে তাদের শত্রুরা। এসব চেয়ে চেয়ে দেখা ব্যতীত কিছু করবার নেই।

আসলে মুসলমানরা এখন আল্লাহর বান্দাহ হতে গৌরব বোধ করেন না। তারা কেউ আমেরিকা অথবা অন্য কারুর ধান্ধা করেন। কেউ কেউ ওয়াশিংটনকে পাশে রেখে মসনদ আঁকড়ে থাকতে পছন্দ করেন। জ্ঞান-বিজ্ঞানের জন্য অর্থ ঢেলে লাভ কী! শায়েখরা কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করেন, সেগুলোতে বিশ্বের অনেকে ভর্তি হন। তবে সেখান থেকে বেরিয়ে মুবাল্লিগ হওয়া ছাড়া বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে বড় অবদান রেখেছেন এমন প্রমাণ এখনও মেলেনি। যথাযথ ফতোয়া দেবার জন্য যোগ্যতম মুফতি অবশ্যই লাগবে। ইমাম প্রয়োজন হবে। শাসক আর বিচারকও লাগবে। সেনাপতিরও প্রয়োজন রয়েছে। তার সঙ্গে বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদেরও দরকার হবে। এদিক থেকে মুসলিমবিশ্ব এখনও পেছনে পড়ে আছে বলে মনে হয়। তাই এব্যাপারে মনোনিবেশ করতে হবে খুব দ্রুত। মুসলিমবিশ্বকে বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে সমৃদ্ধ করতে হবে মুসলমানদেরই। এব্যাপারে পরনির্ভরতা যেমন কাক্সিক্ষত নয়, তেমনই তা নয় নিরাপদও। বিষয়টি বিশ্বমুসলিম-নেতৃত্বকে এখনই ভাবতে হবে। কালক্ষেপণের ফুরসত নেই।
উল্লেখ্য, ২০১৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ ফান্ড থেকে ৮১০ কোটি টাকার চুরির ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট চোরদেরই জনৈক ঘনিষ্ঠজন প্রযুক্তি সিস্টেম চেকের নামে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে গোপন কোড হাতিয়ে নেয় এবং সবকিছু তছনছ করে অপকর্মে সহায়তা করে বলে একটি বিদেশি টিভি চ্যানেলের রিপোর্টে প্রকাশ। প্রযুক্তিগত দুর্বলতা না থাকলে এ ক্ষতি হয়তো ঠেকানো যেতো।

http://www.dailysangram.com/post/300134