১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭, রবিবার, ৯:৪৫

মাফিয়াদের খপ্পরে চালের বাজার

আমদানি শুল্ক কমানোর পাশপাশি বাকিতে ঋণপত্র খোলার সুযোগ দিয়েও অস্থিরতা কমছে না চালের বাজারে। লাগামহীনভাবে বেড়েছে পণ্যটির দাম। ফলে নাভিশ্বাস উঠেছে ভোক্তাদের। একটি সিন্ডিকেট কারসাজি করে চালের দাম বাড়াচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এই সিন্ডিকেট অবৈধভাবে চাল মজুত করার পাশাপাশি নানাভাবে অপপ্রচার চালিয়ে চালের দাম বাড়াচ্ছে। ইতোমধ্যে চালের বাজারে অস্থিরতার পেছনে অবৈধভাবে চাল মজুদকারী ১৬ হাজার মিল মালিককে ‘কালো তালিকাভুক্ত’ করেছে সরকার। কিন্তু চালের দাম বাড়ছেই। বর্তমানে রাজধানীর খুচরাবাজারে প্রতি কেজি মোটা চাল ( ইরি, গুটি স্বর্ণা) ৪৮ থেকে ৫০ টাকা, বিআর-২৮ ৫২ থেকে ৫৪ টাকায়, মিনিকেট ৫৮ থেকে ৬০ ও নাজিরশাইল ৬৫ থেকে ৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম গত বৃহষ্পতিবার সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, এক শ্রেণীর ব্যবসায়ী ও মিল মালিকরা চাল নিয়ে চালবাজি করছেন। চাল নিয়ে রাজনীতি চলছে। আমরা চালবাজি ও ষড়যন্ত্রের মধ্যে আছি। সমস্ত দেশকে একটা বিভ্রাটের মধ্যে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে।

এদিকে সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, চালের বাজারে হঠাত্ করে অস্থিরতা তৈরি হয়নি। হাওরে অকাল বন্যায় যখন আগাম বোরো ফসলের ক্ষতি হলো তখন কেন টনক নড়েনি খাদ্য অধিদপ্তরের? তখনতো সরকারের গুদামে চালের মজুদ তলানীতে ছিল। সে সময় কেন খাদ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা আগাম সংকটের আভাস পেলেন না। সময়মতো চাল আমদানির উদ্যেগ নিলে বাজারে অস্থিরতা তৈরি হতো না। এছাড়া চাল আমদানিতে শুল্ক যখন কমানোই হলো তাহলে তা আরো আগে কমানো হলো না কেন? নাকি শুল্ক কমানোর জন্যই ইচ্ছাকৃতভাবে চালের বাজারে এ অস্থিরতা তৈরি করা হয়েছিল?

খাদ্য বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, সাধারণত মার্চের দিকে চালের মজুদের পরিমাণ কিছুটা কমে আসলেও তা ছয়-সাত লাখ টনের নিচে নামে না। আর মে মাসে অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে বোরো সংগ্রহ শুরু হলে মজুদ বাড়তে থাকে। কিন্তু এবার পরিস্থিতি পুরোপুরি উল্টো হয়েছে। কারণ, তার আগেই হাওরে অকাল বন্যায় আগাম বোরো ফসল নষ্ট হয়েছে। ফলে খাদ্য বিভাগ অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে বোরো সগ্রহে ব্যর্থ হয়েছে। খাদ্য বিভাগ যদি এ সংকট মোকাবেলায় দ্রুত ব্যবস্থা নিত তাহলে চালের বাজারে এ সমস্যা হতো না।

খাদ্য বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত এই কর্মকর্তা বলেন, চালের মজুদ তলানীর বিষয়টি ও হাওরে অকাল বন্যায় বোরো ফসলের ক্ষতিতে বাজারে অস্থিরতা তৈরি হতে পারে বিষয়টি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিভিন্ন সময় মৌখিকভাবে জানানো হয়েছে। কিন্তু বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। তখন বিষয়টি গুরুত্ব্্ দিলে চালের বাজারে কোন সংকট হতো না।

তবে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বলেছেন, যারা বলেছে চালের মজুত কম থাকায় দাম বেড়েছে তারা ভুল ব্যাখ্যা করছে। আমরা শুধু সরকারি বিতরণ ব্যবস্থায় চাল সরবারহ করি। সরকার দেরিতে চাল আমদানি প্রক্রিয়া কেন শুরু করল- এমন প্রশ্নে খাদ্যমন্ত্রী বলেন, আমরা যথাসময়ে চাল আমদানি প্রক্রিয়া শুরু করেছি। ট্যারিফ উঠিয়ে দেওয়ার জন্য আমরা আগেই চিঠি লিখেছিলাম।

বাংলাদেশ অটো মেজর, রাইস ও হাসকিং মিলের সাধারণ সম্পাদক লায়েক আলী ইত্তেফাককে বলেন, হাওরে অকাল বন্যায় ও ব্লাস্ট রোগে ২০ থেকে ২৫ লাখ টন চালের ঘাটতি হবে। এছাড়া উত্তরাঞ্চলে ধানের ফলন ভালো হয়নি। প্রতি হেক্টর জমিতে ৬ থেকে ৮ মণ ধান কম হয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে বাজারে। দাম বাড়ার ক্ষেত্রে মিল মালিকদের কোন কারসাজি নেই।

অবৈধ মজুতের পাশাপাশি চলছে অপপ্রচার

চালের দাম বাড়ার কোন কারণ নেই বলে জানিয়েছেন খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বলেছেন, গত বোরো মৌসুমে এক কোটি ৯১ লাখ টন বোরো ধান উত্পাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। হাওর অঞ্চলে আগাম বন্যা ও বিভিন্ন রোগবালাইয়ে ২০ লাখ টন ফসল নষ্ট হয়েছে। কিন্তু তারপরও এক কোটি ৭০ লাখ টন বোরো ধান পাওয়া গেছে। এরসাথে ২২ লাখ টন আউশ ধান পেয়েছি। সবমিলিয়ে ১ কোটি ৯২ লাখ টন ধান আমাদের ঘরে এসেছে।

তাহলে চালের সংকট কোথায়

অভিযোগ উঠেছে, চালের বাজার অস্থিতিশীল করতে একটি সিন্ডিকেট কাজ করছে। সিন্ডিকেটটি ব্যবসায়ীদের মাঝে অপপ্রচার চালাচ্ছে। গত ১০ সেপ্টম্বর ভারতের মিনিস্ট্রি অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ’র স্বাক্ষর বিহীন একটি ভুয়া চিঠি বন্দর এলাকায় বিভিন্ন ব্যাসায়ীদের মাঝে প্রচার করেছে। চিঠিতে বলা হয়, আগামী ১৫ সেপ্টেম্বরের পর ভারত বাংলাদেশে চাল রফতানি করবে না। চিঠিটি মোবাইলে ছবি ধারন করে তা ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে ব্যবসায়ীদের মাঝে। চিঠির সূত্র ধরে পরে আমদানিকারকরা চালের মূল্য কেজি প্রতি ২/৩ টাকা করে বাড়িয়ে দিয়েছেন। চিঠির গুজবে বাজারে চালের দাম হু হু করে বাড়াতে শুরু করেছে। অনেক আমদানিকারক বন্দর থেকে চাল খালাশের পর তা তাদের নিজস্ব গুদামে স্টক করতে শুরু করেছেন। তবে এর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে সরকার। ইতোমধ্যে চালের অবৈধ মজুতদারদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এছাড়া মাঠে নেমেছে গোয়েন্দারা।

চাল আমদানি বেড়েছে

সরকার চাল আমদানির শুল্ক ২৮ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২ শতাংশে এনেছে। শুল্ক কমানোর পর চাল আমদানি বেড়েছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জুলাইয়ে চাল আমদানির জন্য ১৪ কোটি ৬৪ লাখ ডলারের এলসি (ঋণপত্র) খোলা হয়েছে। এই অংক গত বছরের জুলাই মাসের চেয়ে ১২৫৩৭ শতাংশ বেশি। জুলাই মাসে চাল আমদানির এলসি নিষ্পত্তি হয়েছে ৭ কোটি ১২ লাখ ডলারের, যা গত বছরের জুলাইয়ের চেয়ে ৫৩১৬ শতাংশ বেশি। গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জুলাই মাসে মাত্র ১১ লাখ ৬০ হাজার ডলারের এলসি খোলা হয়েছিল। এছাড়া গম আমদানির এলসি বেড়েছে ৭৪ শতাংশ।

খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, বেসরকারিভাবে ১৭ লাখ টন চাল আমদানির জন্য এলসি খোলা হয়েছে। ভিয়েতনাম থেকে আড়াই লাখ টন চাল আমদানি হচ্ছে। ইতোমধ্যে ভিয়েতনামের এক লাখ ৫৪ হাজার টন চাল গোডাউনে ঢুকেছে। বাকি চাল খালাসের অপেক্ষায় আছে। কম্বোডিয়া থেকে আড়াই লাখ টন চাল আমদানিতে চুক্তি হয়েছে। আগামি তিন মাসের মধ্যে এসব চাল দেশে আসবে। এছাড়া রবিবার মিয়ানমানের একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে আসছে। তাদের সাথে দুই লাখ টন চাল আমদানির চুক্তি হবে।

আজ থেকে ওএমএস

স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য আজ রবিবার থেকে খোলাবাজারে (ওএমএস) চাল ও আটা বিক্রি শুরু করবে সরকার। প্রতি কেজি চাল ১৫ টাকা ও আটা ১৭ টাকায় বিক্রি করা হবে। প্রাথমিকভাবে দেশের বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলোতে তা চালু হবে।

 

http://www.ittefaq.com.bd/trade/2017/09/17/127632.html