জাতীয় প্রেস কাবে সুজনের গোলটেবিল বৈঠকে আমন্ত্রিত আলোচকেরা
১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭, রবিবার, ৯:৩৪

সুজনের গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা

জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে দেশ ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়বে

সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের আলোচনা সভায় বক্তারা বলেছেন, আগামী জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে দেশ ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সংশ্লিষ্ট সবার করণীয় রয়েছে, তবে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা নির্বাচন কমিশনের। তবে নির্বাচনকালে সরকার নিরপে ভূমিকা পালন না করলে সবচেয়ে শক্তিশালী ও নিরপে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) পওে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা প্রায় অসম্ভব। গতকাল জাতীয় প্রেস কাবে ‘সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সুস্পষ্ট করণীয়’ শীর্ষক ওই গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা এ কথা বলেন।

সুজন সভাপতি এম হাফিজ উদ্দিন খানের সভাপতিত্বে ও সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদারের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত এ গোলটেবিল বৈঠকে আলোচনায় অংশ নেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) এম সাখাওয়াত হোসেন, সুজন নির্বাহী সদস্য সৈয়দ আবুল মকসুদ, আলী ইমাম মজমুদার, ইঞ্জিনিয়ার মুসবাহ আলীম ও আক্কাস হোসেন, সহসম্পাদক জাকির হোসেন, আবুল হাসান চৌধুরী, বিশ্বাস লুৎফর রহমান, মুহাম্মদ আব্দুল ওদুদ, সাইফুদ্দিন আহমেদ প্রমুখ। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সুজন কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী দিলীপ কুমার সরকার।

সুজনের সভাপতি এম হাফিজ উদ্দিন খান বলেন, নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেই হবে না, নির্বাচন হতে হবে সুষ্ঠু, নিরপে ও গ্রহণযোগ্য। নির্বাচনে সব নাগরিকের ভোটাধিকারও থাকতে হবে। বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী সংসদের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে সংসদ বহাল রেখে নির্বাচন হবে। এই বিধান রেখে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে সবার জন্য সুযোগ নিশ্চিত করা দুরূহ হবে। আর সে েেত্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠান হবে সুদূর পরাহত।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন, প্রশাসনের রাজনীতিকরণ, নির্বাচন কমিশন গঠন, নিরাপত্তা ইস্যুতে যত দিন পরিবর্তন না আসবে, তত দিন সুষ্ঠু, নিরপে ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন প্রায় অসম্ভব। কেননা বাজেটের ৭৫ শতাংশ ব্যয় হয় নিরাপত্তা খাতে। ২০১৪ সালে যে নির্বাচন হয় সেখানে ১৫৩ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন, সেই নির্বাচনেও নিরাপত্তা খাতে ৩৩০ কোটি টাকা খরচ হয়েছে, যা সত্যিই অবিশ্বাস্য।
সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে আমরা ভয়াবহ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবো। নির্বাচন কমিশনকে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করতে হবে এবং এ ব্যাপারে সরকারকে সহযোগিতা করতে হবে। ভোটার তালিকা যদি সঠিক না হয়, নির্বাচনী এলাকার সীমানা পুনর্বিন্যাস যদি সঠিক না হয়, ভোটাররা যদি প্রার্থী সম্পর্কে তথ্য না পান তাহলে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।

তিনি আরো বলেন, নির্ভুল ভোটার তালিকা, সুষ্ঠু, নিরপে ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের প্রধানতম পূর্বশর্ত। আর এ জন্য প্রয়োজন ভোটার সংখ্যার মধ্যে যতদূর সম্ভব সমতা আনা। ২০০৮ ও ২০১৩ সালের মধ্যে ভোটার সংখ্যার পার্থক্য বেড়ে গেছে। সুতরাং বিদ্যমান ভোটার তালিকা অনুযায়ী নির্বাচন হলে তা প্রশ্নবিদ্ধ হতে বাধ্য।
লেখক ও গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, সবার অংশগ্রহণে সংসদ নির্বাচন আয়োজনে কমিশনকে কী কী চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হবে, তা তাদেরই অনুধাবন করতে হবে এবং সবাইকে তা জানাতে হবে। তিনি নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যম ও রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সংলাপের পাশাপাশি ইসিকে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ প্রশাসনের সাথে সংলাপ করার পরামর্শ দেন।
আলী ইমাম মজুমদার বলেন, ‘আমরা দেখছি, নির্বাচনী ব্যয়ের রিটার্ন নির্বাচন কমিশন যাচাই-বাছাই করে না, কিন্তু তারা যদি এটি যাচাই-বাছাই না-ই করবে তাহলে তারা এটি জমা নেয় কেন?’ তিনি ভারতের নির্বাচন কমিশনের জনবলের সাথে তুলনা করে বলেন, আমাদের নির্বাচন কমিশনের জনবল প্রায় সাত হাজার ছাড়িয়ে গেছে, তাহলে নির্বাচনী কর্মকর্তারা কেন হলফনামা বা ব্যয়ের রিটার্ন যাচাই-বাছাই করতে পারবে না তা আমার বোধগম্য নয়। নির্বাচন কমিশন এ ব্যাপারে নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমের সহযোগিতার প্রয়োজন মনে করে তা তারা চাইতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
আবুল হাসান চৌধুরী বলেন, গণতন্ত্র মানে শুধু সরকার ও বিরোধী দল নয়। গণতন্ত্রের প্রতি সবার আনুগত্য ও মমত্ববোধ থাকতে হবে। আমরা একটি সত্যিকারের নির্বাচন চাই। তিনি নিবাচনের সাথে সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে ‘সোস্যাল কন্ট্রাক্ট’-এ যাওয়া যায় কি না সে ব্যাপারে সুজনের প্রতি আহ্বান জানান।
মূল প্রবন্ধে সুজনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী দিলীপ কুমার সরকার বলেন, ২০১৩ সালের নির্ধারিত সীমানার ভিত্তিতে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে তা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হতে বাধ্য। এটি সুস্পষ্ট যে সুষ্ঠু, নিরপে ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য নির্বাচন কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ করণীয় রয়েছে। তবে নির্বাচনকালে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রাকারী বাহিনী তথা সরকার নিরপে ভূমিকা পালন না করলে এবং কমিশনকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা না দিলে, সবচেয়ে শক্তিশালী ও নিরপে নির্বাচন কমিশনের পওে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা প্রায় অসম্ভব।

দিলীপ কুমার সরকার বলেন, সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা অনুযায়ী, অর্থাৎ সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগের ৯০ দিনের মধ্যে অর্থাৎ ২৮ জানুয়ারি ২০১৯ এর মধ্যে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন করতে হবে। আর সংবিধানের ১১৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, এ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। তবে নির্বাচন মানেই সুষ্ঠু, নিরপে ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। শুধু তা-ই নয়, নির্বাচন বলতে প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনও। তাই প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন নিশ্চিত করার দায়িত্বও নির্বাচন কমিশনের এবং এ ল্েয কমিশনকে সব প্রতিযোগীর জন্য সমান সুযোগ বা ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ সৃষ্টির উদ্যোগ নিতে হবে।
তিনি বলেন, নির্ভুল ভোটার তালিকা সুষ্ঠু, নিরপে ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের প্রধানতম পূর্বশর্ত। আর এই ভোটার তালিকা প্রণয়ন নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক দায়িত্ব। আমরা দেখছি, ২০০৮-এর পরে ভোটার তালিকায় হালনাগাদ প্রক্রিয়ায় অপোকৃত কমসংখ্যক নারী অন্তর্ভুক্ত হতে থাকে, যার ফলে ‘জেন্ডার-গ্যাপ’ নারীর জন্য ক্রমাগতভাবে প্রতিকূল হয়ে পড়ে। যেমন, ২০১৫-১৬ সালের তথ্যানুযায়ী পুরুষের চেয়ে ২৬ শতাংশ কম নারী ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হন। ভোটার তালিকা হালনাগাদের সময় বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহ ও তালিকাভুক্তির কথা থাকলেও, সাম্প্রতিক অতীতে তথ্য সংগ্রহকারীরা বাড়ি বাড়ি যাননি বলে অভিযোগ উঠেছে। এ কথা বলার অপো রাখে না যে, ত্র“টিপূর্ণ ভোটার তালিকা দিয়ে নির্বাচন হলে তা প্রশ্নবিদ্ধ হতে বাধ্য।

ভোটারদের তথ্যভিত্তিক মতায়ন সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী, জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ বিভিন্ন স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের আইনে হলফনামার বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হলেও, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের েেত্র তা বাদ রাখা হয়েছে। আমরা মনে করি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনেও প্রার্থী কর্তৃক হলফনামা প্রদানের বিধান যুক্ত হওয়া উচিত। এ ছাড়া নির্বাচনী ব্যয়ের বৈধ সীমা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। বিগত কমিশন এ ব্যয়সীমা ১৫ লাখ থেকে ২৫ লাখ টাকা করেছে। এর ফলে সাধারণ নাগরিকদের ভোটাধিকার থাকলেও তারা প্রতিনিধি হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। তাই কমিশনকে নির্বাচনী ব্যয়ের লাগাম টেনে ধরতে হবে এবং একই সাথে নির্বাচনী ব্যয়ের বৈধ সীমা কমানোর আহবান জানান।

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/252390