১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭, রবিবার, ৯:৩২

অক্ষম বাবা-মাকে পাহাড়ে রেখে এসেছেন অনেক রোহিঙ্গা

সেনাদের বর্বরতা থেকে রেহাই পায়নি ২৫ দিনের শিশুও

মোহাম্মদ নুরু (৩৫) তার চলাফেরায় অক্ষম বাবা আলী হোসেন (৯৩) ও মা নুর বিবি (৭৭) কে কাঁধে নিয়ে এলাকার সবার সাথে বাংলাদেশে আসার জন্য রওনা দেন। সাথে তার স্ত্রী ও চার শিশুসন্তান। স্ত্রীও পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। রাতে তারা রাজারবিল পাহাড়ি ঢালা পথে পৌঁছেন। অতি কষ্টে মা-বাবাকে ঢালার পথের মধ্যখানে পৌঁছতে পারলেও কান্ত শরীর নিয়ে আর এগোতে পারেননি। প্রতিবেশীরাও তার জন্য অপেক্ষা করছেন না। পাহাড়ে একা হয়ে যাওয়ার ফলে ঢালা পথে একটি ত্রিপলের ছাউনি, কিছু খাদ্য ও দেড় লাখ কিয়াত দিয়ে নিঝুম পাহাড়ে বাবা-মাকে ফেলে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বাংলাদেশে চলে আসেন নুরু। শুধু নুরুর মা-বাবা নন, একই এলাকার মৃত কালুর স্ত্রী, কাছিম আলীর ছেলে বাটুসহ বিভিন্ন এলাকার আরো ছয়-সাতজন বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে বনের মধ্যে দেখতে পান আরেক রোহিঙ্গা শব্বির আহমদ।

আরকানের পথে পথে মৃত্যুভয়
পথ চলছে মা-বাবা, সন্তানসহ পুরো পরিবার। পুরুষদের কাঁধে মালামাল। মহিলাদের কোমরে শিশু। কিশোরদের কাঁধে মাদুর কিংবা ত্রিপল। অনেকে বৃদ্ধ মা-বাবাকে কাঁধে নিয়ে বিভিন্ন গ্রামের হাজার হাজার রোহিঙ্গার সাথে অনবরত পথ চলছেন। গন্তব্য বাংলাদেশ। রাখাইনের রাছিডং থানার লামার পাড়ার বাসিন্দা শব্বির আহমদ বলেন, পরিবারের ১২ সদস্যকে নিয়ে ১০ দিন ও রাত হেঁটে নাফ নদী পাড়ি দিয়ে শাহপরীর দ্বীপ সীমান্তে পৌঁছেন তিনি। মিয়ানমারের নাইক্ষ্যংদিয়া সীমান্ত থেকে পুরো পরিবারের জন্য দুই লাখ ৯০ হাজার কিয়াত ও একটি নাকের দুল দিয়ে রাতে নাফ নদী পার হয়ে শাহপরীর দ্বীপসীমান্তে আসেন তিনি।
শব্বির আহমদ জানান, রাছিডংয়ে তাদের পাড়ায় ১৩ শতাধিক মানুষের বসবাস ছিল। এর মধ্যে ৩৪০ জনকে খুঁজে পেয়েছেন তারা। বাকিদের পুড়িয়ে মারা হয়েছে। এ মর্মান্তিক দৃশ্য দেখে রাছিডংয়ের কয়েকটি গ্রামের প্রায় ২০ হাজার রোহিঙ্গা একসাথে ঈদের পর দিন বাংলাদেশের দিকে রওনা দেন। চলার পথে দেখেছি রাখাইনের গ্রামগুলো যেন মৃত্যুপুরী ও ভুতুড়ে নগরীতে পরিণত হয়েছে। মাঝে মধ্যে সেনাদের টহল নজরে পড়লে এ সময় আল্লাহর জিকির ছাড়া আর কোনো ঢাল তাদের ছিল না। এভাবে প্রতি মুহূর্ত আতঙ্ক ও মৃতুর ভয় নিয়ে হাঁটার পর অবশেষে নাইক্ষ্যংদিয়া সীমান্তে পৌঁছেন। সেখানে আরো প্রায় ৪০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের জন্য জড়ো হয়েছেন। নাইক্ষ্যংদিয়ায় ছয় দিন থাকার পর ১৩ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় শাহপরীর দ্বীপে পৌঁছে শব্বিরের পরিবার।

শব্বির আরো জানান, আরাকানে যারা এখনো আছেন তারা মানবেতর দিন পার করছেন। খাবার ও পানি নেই, নেই সীমান্ত পাড়ি দেয়ার মতো টাকা। পাশের একটি জনশূন্য গ্রামে আট ব্যক্তি চাল আনতে গিয়ে সেনাদের হাতে আটক হয়েছেন। এদের মধ্যে শব্বিরের গ্রামের মতিউর রহমানের ছেলে হোছন আহমদও রয়েছেন। অভুক্ত মানুষগুলো হাড্ডিসারে পরিণত হয়েছেন। বিশেষ করে নারী ও শিশুদের অবস্থা আশঙ্কাজনক। শব্বির মৃত্যু নগরী থেকে পুরো পরিবার নিয়ে এপারে আসতে পারায় সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে ভুলেননি।
হারানো ছেলেকে পেয়ে মা বেহুঁশ
মিয়ানমারের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে নাফ নদী পেরিয়ে টেকনাফে পৌঁছেন রোহিঙ্গারা। সেখানে বাসস্ট্যান্ডে অবস্থান করে চলে যান নির্দিষ্ট গন্তব্যে। হাজারো রোহিঙ্গার ভিড়ে অবস্থান করে শব্বিরের পরিবারও। এর মধ্যে ১৪ সেপ্টেম্বর বিকেলে টেকনাফ স্টেশনে শিশুসন্তান রমজান আলী (১২) ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে যায়। প্রায় ঘণ্টাখানেক খোঁজাখুঁজির পর তাকে পাওয়া যায়। মা সুফিয়া খাতুন প্রাণের ধন রমজান আলীকে পেয়ে মুহূর্তেই বেহুঁশ হয়ে পড়েন। অনেকক্ষণ চেষ্টার পর তার জ্ঞান ফিরলে ছেলেকে বুকে টেনে নেয়ার দৃশ্য উপস্থিত সবার হৃদয়ে নাড়া দেয়।

সন্তানের লাশ কোলে নিয়ে মায়ের বিলাপ
শাহপরীর দ্বীপের পশ্চিমপাড়া সাগর উপকূলে নৌকা উল্টে ডুবে যাওয়ায় নিজের কোলে রেখেও ছেলেকে বাঁচাতে না পারায় বিলাপ করছেন মা হামিদা খাতুন। সন্তানের লাশ কোলে নিয়ে তিনি বার বার মুখে চুমো খাচ্ছেন। বিলাপ করতে করতে তিনি বলেন, আমার যমজ দুই সন্তান আব্দুল মাবুদ ও আব্দুল করিম। তাদের বয়স (৪০) দিন। গত বৃহস্পতিবার সকাল ৭টায় মিয়ানমারের নাইক্ষ্যংদিয়া থেকে নৌকায় উঠি বাংলাদেশে আসার জন্য। সাথে ছিল ছোট বোন মাহমুদা। দুই যমজ শিশুর বাবা রশিদ আহমদ ৩১ আগস্ট সন্ধ্যার আগে নিখোঁজ হন। ওই দিন বিকেলে সেনাসদস্যরা গ্রামে হামলা চালায়। ওই সময় গ্রামবাসীর ওপর বৃষ্টির মতো গুলি ছুঁড়ে সেনাসদস্যরা। লোকজন পালিয়ে পাশের পাহাড়ে আশ্রয় নেন। সেনাসদস্যরা আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছে ঘরবাড়ি। তার আগেই নাডালা বাহিনীর সদস্য ঘরের জিনিসপত্র লুটপাট করেছে।

তিনি বলেন, প্রাণে বাঁচতে দুই যমজ শিশুসন্তানকে নিয়ে আরাকানের রাচিডং শহরের পিনদং গ্রাম থেকে পালিয়ে সীমান্তের নাইক্ষ্যংদিয়া এলাকায় এসে অবস্থান করি বৃহস্পতিবার সকাল ৬টা পর্যন্ত। স্বামী রশিদ আহমদের কোনো খোঁজ না পেয়ে ছোট বোন মাহমুদাকে সাথে নিয়ে নৌকায় সাগর পাড়ি দিয়ে বেলা ১১টায় শাহপরীর দ্বীপের পশ্চিমপাড়া সাগর উপকূলে পৌঁছলে নৌকাটি উল্টে ডুবে যায়। তখন আমার কোলে মাবুদ আর মাহমুদার কোলে ছিল করিম। পরে তাদের দুইজনকে মুমূর্ষু অবস্থায় সাগর থেকে উদ্ধার করা হয় এবং স্থানীয় এক পল্লী চিকিৎসকের সহযোগিতায় করিমকে বাঁচানো সম্ভব হলেও মাবুদ মারা যায়।
এ দিকে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ সৈকত থেকে এক রোহিঙ্গা শিশু এবং বাংলাদেশী এক নৌকামাঝির লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। ভেসে আসা রোহিঙ্গা শিশুর লাশটি গত শুক্রবার সকাল ৯টায় শাহপরীর দ্বীপ পশ্চিমপাড়া সাগর উপকূল থেকে উদ্ধার করা হয়। শিশুর লাশটি বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়েছে। অপর দিকে বিকেলে নিখোঁজ মাঝি মো: শাকেরের লাশ পাওয়া যায়।

টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো: মাইন উদ্দিন খান বলেন, গত বৃহস্পতিবার টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ উপকূলের কাছে সাগরে রোহিঙ্গাবাহী দুইটি নৌকা ডুবে যায়। এ ঘটনায় গত শুক্রবার সকালে এক রোহিঙ্গা শিশুর লাশ এবং বিকেলে নৌকামাঝি মো: শাকেরের (৩০) লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।
বর্মি সেনাদের নির্মমতা থেকে
রেহাই পায়নি ২৫ দিনের শিশুও
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে গতকাল শুক্রবার ভোর সাড়ে ৩টায় ভর্তি হয়েছে ২৫ দিন বয়সী একটি রোহিঙ্গা শিশু। তার পুরো শরীর ঝলসানো। অনেক স্থানে সংক্রমণ হয়ে গেছে। সে যন্ত্রণায় ছটফট করছে। ১২-১৩ দিন আগে বাড়িতে বর্মি বাহিনীর দেয়া আগুনে দগ্ধ হয় সাইফুল আরমান নামে এ শিশুটি। তার বাবা সৈয়দ নূর আরাকানের আকিয়াবের জোফরান এলাকার বাসিন্দা। এরপর তার পরিবার বাংলাদেশে পালিয়ে আসে।
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক আবুল কালাম জানান, চমেকের বার্ন ইউনিটে ১৭ জন পুড়ে যাওয়া রোহিঙ্গা রোগী চিকিৎসাধীন রয়েছে। এর মধ্যে গতকাল শুক্রবার নতুন করে ভর্তি করা হয়েছে ২৫ দিনের একটি শিশুকে। তার শরীরের ২০ ভাগ ঝলসে গেছে।
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পুলিশ ফাঁড়ির সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) আলাউদ্দিন তালুকদার জানান, সাইফুল আরমান নামে ওই শিশুকে গত শুক্রবার ভোরে উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) গাড়ি করে চমেক হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়।

এটা তোদের দেশ নয়
আরাকান থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা বলছেন, তাদের নির্মম নির্যাতন চালিয়ে এ দেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য করা হচ্ছে। না হয় গুলি করে মেরে ফেলার হুমকি দেয়া হচ্ছে। যারা তাদের কথামতো বাড়িঘর থেকে বের হতে একটু দেরি করছেন, তাদের গুলি করা হচ্ছে। গতকাল পালংখালী আঞ্জুমান পাড়া সীমান্ত পয়েন্টে গিয়ে দেখা গেছে, দলে দলে রোহিঙ্গারা ঢুকছেন। সবার মুখে আতঙ্ক। গতকাল শুক্রবার মিয়ানমারের মংডু উদং গ্রামের হামিদ (৩২) হাইচ্ছুরতা এলাকা থেকে নুর বানু (২২) ও চানছি মিপং বুচিডংয়ের কলিম উল্লাহসহ অসংখ্য রোহিঙ্গার সাথে কথা হয় এ সংবাদদাতার।
তারা বলেছেন, মিয়ানমার সেনাবাহিনী তাদের বলেছে, এটা তোদের দেশ নয়, বাংলাদেশ হলো তোদের দেশ। ওখানে গিয়ে আশ্রয় নে। যদি এখানে (মিয়ানমারে) থাকিস, তাহলে গুলি করে সবাইকে হত্যা করা হবে। যারা বাড়িঘর থেকে বের হতে একটু দেরি করছে, তাদের হত্যা করা হচ্ছে। বুচিডং এলাকার নুর আয়েশা (৩০) বলেন, বের হতে একটু দেরি করায় বাড়িতে ঢুকে আমার স্বামীকে গুলি করে হত্যা করেছে সেনারা। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সবার সবাই মালামাল নিয়ে সীমান্তে চলে আসি। বনজঙ্গল ও সীমান্তে আশ্রয় নিই। এরপর একদল রোহিঙ্গার সাথে কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্পে চলে আসি।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/252356