১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭, রবিবার, ৯:২৭

নাফ নদীর তীরে রোহিঙ্গা শিশুদের গুলীবিদ্ধ লাশ

সম্প্রতি ছড়িয়ে পড়া এক ভিডিওতে দেখা গেছে, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর কয়েকজন গুলীবিদ্ধ শিশুর লাশ নাফ নদীর তীরে ভেসে আসছে। এরইমধ্যে অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক সংবাদমাধ্যম এবিসি নিউজ এটি সম্প্রচার করেছে। তবে স্বাধীন পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে এর সত্যতা নিশ্চিত করার কথা জানায়নি তারা। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য ইন্ডিপেনডেন্ট জানিয়েছে, ভিডিওতে যে শিশুদের দেখা যাচ্ছে তারা মিয়ানমার পুলিশের গুলীতে প্রাণ হারিয়েছেন বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। তবে তারাও এটির স্বাধীন পর্যালোচনা করেনি। এদিকে ভিডিওটি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ায় মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর ক্ষোভ বাড়তে শুরু করেছে। সাম্প্রতিক ক্লিয়ারেন্স অপারেশনের লক্ষ্যে সেনা অভিযান শুরুর কয়েকদিনের মাথায় ‘বিদ্রোহী রোহিঙ্গারা’ ২৪টি পুলিশ চেকপোস্টে বিদ্রোহীদের কথিত সমন্বিত হামলায় অন্তত ১০৪ জন নিহত হওয়ার কথা জানিয়ে রোহিঙ্গাবিরোধী অভিযান জোরদার করে সরকার। এরপর থেকেই মিলতে থাকে বেসামরিক নিধনযজ্ঞের আলামত। পাহাড় থেকে ভেসে আসতে শুরু করে বিস্ফোরণ আর গুলীর শব্দ। পুড়িয়ে দেওয়া গ্রামগুলো থেকে আগুনের ধোঁয়া এসে মিশছে মৌসুমী বাতাসে। মায়ের কোল থেকে শিশুকে কেড়ে নিয়ে শূন্যে ছুঁড়ছে সেনারা। কখনও কখনও কেটে ফেলা হচ্ছে তাদের গলা। জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হচ্ছে মানুষকে। আহত শরণার্থী হয়ে তারা ছুটছে বাংলাদেশ আর ভারতে। পালিয়ে আসতে গিয়ে এ পর্যন্ত পানিতে ডুবে প্রায় ১০০ শিশুর মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়ার কথা জানিয়েছে গার্ডিয়ান।

এবিসি নিউজে প্রকাশিত ভিডিওতে দেখা গেছে, নাফ নদীর বালুময় তীরে এক কিশোর ও এক নবজাতকের নিথর দেহ পড়ে আছে এবং সে দেহগুলোর পাশে মানুষের ভিড় জমে আছে। কিছুক্ষণ পর দেখা যায় আরেক তরুণ এক শিশুর মরদেহ নিয়ে ওই দুই মৃতদেহের পাশে রাখছে। ভিডিওতে ওই তিন শিশুর একজনকেও নড়াচড়া করতে দেখা যায়নি এবং দেখেই বোঝা যাচ্ছিল ওই ছোট্ট দেহে আর প্রাণের অস্তিত্ব নেই।

অতীতে নিপীড়ন থেকে বাঁচতে ভিনদেশে আশ্রয় নিয়েছেন এমন রোহিঙ্গারা ভিডিওটি দেখার পর ক্ষোভ জানিয়েছেন। এমনই একজন আনোয়ার শাহ। অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসরত রোহিঙ্গা কমিউনিটির নেতা তিনি। আনোয়ার জানান, এখনও বেশ কয়েক হাজার রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে পালানোর চেষ্টা করছে বলে তার জানা আছে। এবিসি নিউজকে তিনি বলেন, পাহাড়ে প্রায় ৩০,০০০ রোহিঙ্গা আটকা পড়ে আছে। ওইসব রোহিঙ্গার দুর্দশার কথা উল্লেখ করে আনোয়ার বলেন, ‘তাদের খাবার নেই, আশ্রয় নেই। তারা কেবল সেখানে মরছে। যখনই তারা দলে দলে সেখান থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করছে, তখনই সেনাবাহিনী ও পুলিশ তাদেরকে আক্রমণ করছে, তাদের হত্যা করছে।’ আনোয়ার আরও বলেন, ‘আমি শুনেছি আমার বোনদের একজন এরইমধ্যে বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছে, কিন্তু অন্য দুই বোনের কী পরিণতি হয়েছে তা সম্পর্কে এখনও জানতে পারিনি। তাদের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ নেই এবং আমি জানি না তারা কোথায় আছে।’ গত তিন সপ্তাহে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও পুলিশের হাতে প্রায় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ১ হাজার রোহিঙ্গা নিহত হয়েছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ। সংস্থাটির মানবাধিকারবিষয়ক প্রধান জেইদ রা’দ আল ঘটনাকে ‘জাতিগত নিধনযজ্ঞের পাঠ্যপুস্তকীয় দৃষ্টান্ত’ আখ্যা দিয়েছেন। মহাসচিব গুয়েতেরেজ প্রশ্ন রেখেছেন, এক তৃতীয়াংশ মানুষ দেশ থেকে উচ্ছেদ হলে তাকে জাতিগত নিধন ছাড়া আর কী নামে ডাকা যায়।
ধস নেমেছে মিয়ানমারের পর্যটন খাতে
বিদেশী পত্রপত্রিকায় মিয়ানমারের আরাকান বা রাখাইন অঞ্চলে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর নির্যাতন ও সহিংসতার খবর অনবরত প্রকাশ পাওয়ায় দেশটির পর্যটন খাতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বলে দাবি করছে মিয়ানমারের টুরিজ্যম ফেডারেশন। অনেক বিদেশী পর্যটক মিয়ানমার সফর বাতিল করছেন। ফেডারেশনের চেয়ারম্যান উ খিন অং তান বলেছেন, তার দেশে পর্যটক আগমন আশঙ্কাজনক হারে কমছে। অনেক দেশের সরকার তাদের নাগরিকদের মিয়ানমার সফরে যেতে বারণ করছে। ব্রিটেন তার নাগরিকদের ইতিমধ্যে মিয়ানমার সফরের ব্যাপারে সতর্ক করেছে। এর ফলে মিয়ানমারের দক্ষিণাঞ্চলে পর্যটকদের ভিড় কমছে। নাগাপালি সৈকতে বিদেশি পর্যটকও হ্যাস পেয়েছে।
মিয়ানমারের কাছে অস্ত্র বিক্রি করছে যারা
ব্রিটিশদের উপনিবেশ থেকে ১৯৪৮ সালে স্বাধীন হয় মিয়ানমার। এর পর অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় ধরে শক্ত হাতে দেশটির রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করছে সেনাবাহিনী। ১৯৯০-এর দশকের শুরু থেকে বিভিন্ন সময়ে মিয়ানমারের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও যুক্তরাষ্ট্র। ২০১২ সালে তথাকথিত গণতান্ত্রিক রূপান্তর হয় মিয়ানমারে। তা সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত দেশটির ওপর ইইউর অস্ত্র আমদানি-রপ্তানির নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এই সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বিপুল অস্ত্র আমদানি করেছে মিয়ানমার।
কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরার এক প্রতিবেদনে গ্রাফিক্স ব্যবহার করে অস্ত্র আমদানির সেই তথ্য দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেদনটিতে ১৯৯০ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত মিয়ানমার কোন দেশের কাছ থেকে কত অস্ত্র কিনেছে, তার বিবরণ রয়েছে। এতে দেখানো হয়েছে মিয়ানমারের কাছে সবচেয়ে বেশি অস্ত্র ও আনুষঙ্গিক সরঞ্জাম বিক্রি করেছে চীন, রাশিয়া, ভারত, ইসরায়েল ও ইউক্রেন।

বিমান : আলজাজিরার প্রতিবেদন অনুযায়ী, উল্লিখিত সময়ের মধ্যে মিয়ানমারের কাছে সবচেয়ে বেশি ১২০টি বিমান বিক্রি করেছে চীন। এর পরই আছে রাশিয়ার অবস্থান। দেশটি ৬৪টি বিমান বিক্রি করেছে মিয়ানমারের কাছে। এ ছাড়া দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশটির কাছে পোল্যান্ড ৩৫, জার্মানি ২০, সাবেক যুগোস্লাভিয়া ১২, ভারত নয়, সুইজারল্যান্ড তিন ও ডেনমার্ক একটি বিমান বিক্রি করেছে ।
ক্ষেপণাস্ত্র : মিয়ানমারের কাছে সর্বাধিক দুই হাজার ৯৭১টি ক্ষেপণাস্ত্র বিক্রি করেছে রাশিয়া। এর পরই আছে চীনের অবস্থান। দেশটি প্রতিবেশীর কাছে এক হাজার ২৯টি ক্ষেপণাস্ত্র বিক্রি করেছে। এ ছাড়া বেলারুশ ১০২, বুলগেরিয়া ১০০ ও ইউক্রেন ১০টি ক্ষেপণাস্ত্র বিক্রি করেছে।
নৌযান : বার্মিজ নৌবাহিনীর জন্য ২১টি তরী কেনা হয়েছে চীনের কাছ থেকে। এ ছাড়া ভারত ও সাবেক যুগোস্লাভিয়ার কাছ থেকে কেনা হয়েছে তিনটি করে তরী।
কামান : সীমান্তবর্তী দেশ চীন সবচেয়ে বেশি ১২৫টি কামান বিক্রি করেছে মিয়ানমারের কাছে। এ ছাড়া দীর্ঘ সময় সামরিক জান্তাশাসিত দেশটির কাছে সার্বিয়া ১২০, রাশিয়া ১০০, ইসরায়েল ২১, উত্তর কোরিয়া ১৬ ও ভারত ১০টি কামান বিক্রি করেছে।
সাঁজোয়া যান : মিয়ানমারের কাছে সর্বাধিক ৬৯৬টি সাঁজোয়া যান বিক্রি করেছে চীন। এর পরই আছে ইসরাইলের অবস্থান। দেশটি মিয়ানমারের কাছে সাঁজোয়া যান বিক্রি করেছে ১২০টি। এ ছাড়া ইউক্রেন ৫০ ও ভারত ২০টি সাঁজোয়া যান বিক্রি করেছে।

গত ২৪ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের একটি সেনা ও কিছু পুলিশ ক্যাম্পে হামলা চালায় সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা বিদ্রোহীরা। এরপর থেকে দেশটির আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অব্যাহত নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞের মুখে প্রায় চার লাখ রোহিঙ্গা মুসলিম বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। এই অভিযান শুরুর পর থেকে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের নাগরিক ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো মিয়ানমারের আচরণের তীব্র সমালোচনা করলেও বৃহৎ শক্তিগুলো এক রকম নিষ্ক্রিয়তা দেখিয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, মিয়ানমারের সঙ্গে বৃহৎ রাষ্ট্রগুলোর নানামুখী সম্পর্ক রয়েছে। আর এ কারণেই তারা দৃশ্যত চুপ রয়েছে।

http://www.dailysangram.com/post/299974