১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭, রবিবার, ৯:২৫

চালের বাজারে নজিরবিহীন নৈরাজ্য॥ অসহায় ক্রেতারা

নজিরবিহীন নৈরাজ্য অব্যাহত থাকায় চালের বাজার ক্রেতার নাগালের বাইরে। অস্থির চালের বাজারে অসহায় হয়ে পড়েছে সরকার এবং ক্রেতারা। সংকট কাটিয়ে উঠতে সরকারি- বেসরকারিভাবে ৭ লাখ টন চাল আমদানি করলেও ফল হয়েছে উল্টো। সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে মুখেই হুমকি দিচ্ছে সরকার। নাগালে আসছে না চালের বাজার। তবে মিল মালিকদের দাবি, মজুদদারি নয় চাল নিয়ে মন্ত্রণালয়ের হিসাবের গরমিলেই দেখা দিয়েছে সংকট। আসলে কি পরিমাণ চালের চাহিদা রয়েছে তার কোন সঠিক পরিসংখ্যান নেই মন্ত্রণালয়ের কাছে।

জানা গেছে, দুই মাস আগে বন্যার কারণে বাজারে চালের দাম বৃদ্ধি করে প্রায় হাজার কোটি টাকা লোপাট করে সিন্ডিকেট। তখনও ১৬ হাজার মিল মালিককে কালো তালিকাভুক্ত করলেও বহাল তবিয়তে রয়েছে চাল সিন্ডিকেট। তখন বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার চাল আমদানিতে শুল্ক প্রত্যাহার করলেও সেই সিন্ডিকেট চক্র থেমে নেই। এই চক্র আবারও হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করতে বাজারে সক্রিয়। কিন্তু সরকার কোন ব্যবস্থা না নিয়ে মুখেই শুধু হুঙ্কার দিচ্ছে।
চালের দাম বৃদ্ধির মাধ্যমে এই সিন্ডিকেট হাজার কেটি টাকা লোপাট করলেও হুমকি ছাড়া সরকার কার্যত কোন ব্যবস্থাই নেয়নি। এতে করে চাল সিন্ডিকেট আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। কোন কারন ছাড়াই প্রতি দিনই চালের দাম বাড়ছে। মিল মালিক আর খুচরা ব্যবসাযীরা একে অপরকে দায়ী করছে। আর জনগণের পকেট উজার হচ্ছে। সরকার নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। এ অবস্থায় সাধারণ ক্রেতারা অসহায় হয়ে পড়েছে।

দেশে এই প্রথম মোটা চাল কিনতে হচ্ছে ৫০ টাকা কেজিতে। গত ক-মাস ধরেই দাম নিয়ে চলা এই নৈরাজ্যের কথা স্বীকার করছে সরকারও। কিন্তু কারা এই নৈরাজ্যের জন্য দায়ী তার ব্যাখ্যা নেই সরকারের কাছে।
সরকারি হিসাবে দেশের চালের চাহিদা মেটায় প্রায় ১৮ হাজার চাল কল। দু-মাস আগেই গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে কালো তালিকাভুক্তি করা হয় ১৬ হাজার মিল মালিককে। তাদের কাছ থেকে ৩ বছর চাল কেনা হবে না বলে জানান খাদ্যমন্ত্রী।
সরকার মিল মালিকদের মজুদকে দায়ী করলেও দৃশ্যত কোন ব্যবস্থা নেয়নি। অটো মেজর এন্ড হ্যাস্কিং চালকল সমিতির সভাপতি এর আগে বলেছিলেন সারা দেশে ১০/১২ মিল মালিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেই চালের দাম কমবে। তারাই সারা দেশের চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু সরকার তা না করে সাধারণ ১৬ হাজার মিল মালিকের বিরুদ্ধে বিনা কারণেই কালো তালিকভুক্ত করলো। এই ১০/১২ মিল মালিকের সাথে রয়েছে মন্ত্রনালয়ের বেশ কিছু কর্মকর্তার সাথে সক্ষতা। ব্যবসায়ীদের দাবি মন্ত্রণালয়ের যোগসাজশ ছাড়া এভাবে দাম বাড়াতে পারে না।

সরকার যদি নিজের মজুদ ব্যবস্থা বাড়াতে আর ১০/১২ মিল মালিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে তাহলেই কেবল দাম নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। তা না হলে কোনভাবেই বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। সরকারের হাক ডাক ছাড়া আর কিছুই করার নেই।
লম্বা সময়জুড়ে এই অস্থিরতা চললেও হুঁশিয়ারি-বক্তব্য ছাড়া, বাজার নিয়ন্ত্রণে মজুদকারীদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ না থাকার সমালোচনা করছেন সংশ্লিষ্টরা। বছরে ধানের চাহিদা প্রায় সাড়ে তিন কোটি টন। বন্যা ও ব্লাস্ট রোগে এবার উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে মাত্র ১৫ লাখ টনের। সে কারণেই দেশে চাল সংকটের কারণ দেখছে না মন্ত্রণালয়।
কনজুমার এসোসিয়েশন বাংলাদেশ (ক্যাব) এর সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, হাক ডাক ছাড়া সরকার ভোক্তার জন্য কিছুই করেনি। বাজারে কোন মনিটরিং নেই। নিজেদের ইচ্ছা মত দাম বাড়াচ্ছে ব্যবসায়ীরা।
তিনি আরও বলেন, ব্যবসায়ীরা তো আর দান খয়রাত করতে বসেনি। যে তারা নিজের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে দেশের জন্য কাজ করবেন। তারা তো লাভের জন্যই ব্যবসা করেন। সুযোগ পেলে তো তারা ব্যবসা করবেই।

তবে সরকারের মজুদদারির অভিযোগ নাকচ করছেন মিল মালিকেরা। তারা বলছেন, চাল নিয়ে মন্ত্রণালয়ের হিসাবেই আছে গরমিল। আর সে কারণেই তৈরি হয়েছে সংকট। সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে চলতি বছরের পহেলা জুলাই থেকে ১২ সেপ্টেম্বর চাল আমদানি হয়েছে অন্তত সাত লাখ টন।

চালের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকারের পক্ষ থেকে কয়েক দফা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কয়েকটি দেশ থেকে চাল আমদানি করা হয়েছে, শুল্ক কমানো হয়েছে। জোরদার করা হয়েছে বাজার তদারকি কার্যক্রমও। কিন্তু কিছুতেই দামের লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না।
খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্র অনুযায়ী, গত বোরোতে চালের উৎপাদন ২০ লাখ টন কম হয়েছে। চালের আমদানি বাড়াতে গত ২০ জুন চাল আমদানিতে শুল্কহার ২৮ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করে, কিন্তু এরপরও বাজারে তেমন প্রভাব না পড়ায় গত ১৭ আগস্ট আমদানি শুল্ক আবার কমিয়ে ২ শতাংশ করা হয়।

দাম কমাতে সরকারি ও বেসরকারিভাবে ইতোমধ্যে চাল আমদানিও করা হয়েছে। কিন্তু তার কোনো ইতিবাচক প্রভাব দেশের চালের বাজারে এখনো পরিলক্ষিত হচ্ছে না। বরং বছরের শুরু থেকে যে চালের দাম বাড়তে শুরু করেছিল এখন পর্যন্ত সেই ধারাবাহিকতা বিরাজমান।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকার শুল্ক কমানোর ফলে দেশে চালের আমদানি বাড়লেও সরু ও মাঝারি চাল আমদানি হচ্ছে কম। বেশি আমদানি হচ্ছে আতপ ও মোটা চাল। আর এ সুযোগকেই কাজে লাগাচ্ছে দেশের মিল মালিকেরা। এ ছাড়া চালের বাজার ঊর্ধ্বমুখীর জন্য আমদানিকারকদের কারসাজি রয়েছে।
তবে আমদানিকারকরা এ অভিযোগ অস্বীকার করে জানান, সরকার মূলত অনেক বেশি দামে চাল ক্রয় করার কারণে বেসরকারি পর্যায়ের আমদানিকারকদের বেকায়দায় পড়তে হচ্ছে ও বেশি দামে চাল কিনতে হচ্ছে। তা ছাড়া সরকার চালের ওপর শুল্ক কমানোর সংবাদে সাপ্লাইয়াররা বুকিং রেট বাড়িয়ে দিয়েছে।

এছাড়া বেসরকারি পর্যায়ে বড় বড় আমদানিকারকদের কাছে অনেক ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত ছোট আমদানিকারকরা অসহায়। বড় আমদানিকারকরা এক সঙ্গে বেশি পরিমাণ চাল ক্রয় করায় কিছুটা কম মূল্যে কিনতে পারে। কিন্তু ছোট আমদানিকারকরা তেমন কোনো সুবিধা পাচ্ছে না। আর বুকিং রেট বাড়ার কারণে শুল্ক কমানোর সুবিধাও ভোগ করতে পারছে না আমদানিকারকরা।
চাল আমদানিকারক আজমীর ট্রেডিংয়ের মালিক মো. ইদ্রিস মিয়া জানান, যদি পাইকারি বাজারে কেজি প্রতি চালের দাম এক টাকা বাড়ে তাহলে তা খুচরা বাজারে কেজি প্রতি ৩ থেকে ৪ টাকা বেড়ে যায়। আবার পাইকারি পর্যায়ে কমলে খুচরা পর্যায়ে কমতে সময় নেয়। এরই মধ্যে দেখা যায়, পাইকারিতে আবার বেড়ে যায়। ফলে খুচরা পর্যায়ে ভোক্তারা সুবিধা পায় না।
রাজধানীর মোহাম্মদপুর টাউন হল বাজারের খুচরা ব্যবসায়ী বিসমিল্লাহ রাইস স্টোরের মালিক আনিসুর রহমান বলেন, বর্তমানে ভালো মানের মিনিকেট বিক্রি হচ্ছে প্রতিকেজি ৭০ টাকা দরে। তবে কোয়ালিটি অনুযায়ী প্রতিকেজি মিনিকেটের দাম ৬৫ থেকে ৭০ টাকার মধ্যে রয়েছে। একইভাবে প্রতিকেজি নাজিরশাইল চাল বিক্রি হচ্ছে ৬৫ থেকে ৭০ টাকা দরে। বিআর আটাশ চালের দাম ৫৫ থেকে ৬০ টাকার মধ্যে রয়েছে।

সবচেয়ে কম দামের চাল হলো গুটি স্বর্ণা, যা প্রতিকেজি বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৫২ টাকা দরে। মূলত সাশ্রয়ের লক্ষ্যে নিম্ন আয়ের মানুষেরা এই ধরনের মোটা চাল বেশি ক্রয় করে থাকেন বলেও জানান তিনি।
এদিকে বাংলাদেশ অটো মেজর এন্ড হাসকিং মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক লায়েক আলী জানান, ধানের মৌসুম শেষ। এখন বাজারে ধান পাওয়া যাচ্ছে না। যা আছে তা প্রতিদিন দাম বাড়ছে। আগামী নবেম্বরের আগে নতুন ধান আসবে না। এ জন্য ধানের দাম বেড়েছে। তা ছাড়া ঈদের আগে পরে ছুটির কারণে ধান ও চাল আনা-নেয়ায় বেশি ভাড়া দিয়েও ঠিকমতো ট্রাক পাওয়া যায় না। এতে পরিবহন ব্যয় বেশি হচ্ছে। তা ছাড়া বন্যায় উত্তরাঞ্চলে চালকলে উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। এসব কারণে চালের দাম বেড়েছে।

উল্লেখ্য, বছরে চালের চাহিদা প্রায় সাড়ে ৩ কোটি টন। এরমধ্যে বোরো মৌসুমে ১ কোটি ৯০ লাখ টন চাল উৎপাদিত হয়, কিন্তু এবার হাওর অঞ্চলে অকাল বন্যাসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগে বোরোর উৎপাদন কম হয়েছে।
সরকার মিয়ানমার থেকে চাল না পাওয়ায় বাজার তার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। অন্যদিকে ভারত বাংলাদেশের আড়াই মাসের জন্য চাল রফতানি নিষিদ্ধ করার কারণেই বাজার আরও অস্তির হয়ে উঠেছে। দেশের চালের বাজারে যে ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে তা যদি অব্যাহত থাকে তাহলে দেশে বড় ধরনের খাদ্য সংকট দেখা দিতে পারে।
বাংলাদেশে চালের দাম বেড়ে যাওয়ায় ইতোমধ্যে সতর্কবার্তা দিয়েছে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও)। সংস্থাটির মতে, গত তিন মাসে দেশে চালের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ার পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। এবারই প্রথম বাংলাদেশের জন্য এমন সতর্কবার্তা দিল এফএও। গত মঙ্গলবার সংস্থাটি বিশ্বের খাদ্য পরিস্থিতি নিয়ে এই মূল্যায়ন প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়, গত এক মাসে বিশ্বের খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে, দামও কমেছে, বিশেষ করে চাল-গম ও দানাদার খাবারের। তবে বাংলাদেশের বাজারে প্রধান খাদ্য চালের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে।

ভারত চাল রপ্তানি বন্ধ করে দিচ্ছে- এমন খবরে দেশের চালের বাজার আরো অস্থিতিশীল হয়ে পড়েছে। গত দুদিনেই পাইকারিতে কেজিপ্রতি গড়ে ৮/১০ টাকা করে দাম বেড়েছে। এ অবস্থায় আজ থেকে সারা দেশে ফের চালু হচ্ছে খোলাবাজারে বিক্রি (ওএমএস) কর্মসূচি, আর ২০ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হচ্ছে তালিকাভুক্ত হতদরিদ্রদের জন্য ১০ টাকায় চাল বিক্রি কার্যক্রম।
খাদ্য বিভাগের মহাপরিচালক বদরুল হাসান বলেন, চুক্তি হয়েছে। চালও আসবে। যা দেরি তা নিয়মের কারণে।
এদিকে সরকারি তথ্য-উপাত্ত বলছে, ৫ দেশ কথা দিলেও একমাত্র ভিয়েতনামের সরকার চুক্তির আড়াই লাখ টন চালের মধ্যে ১ লাখ ৫৫ হাজার টন দ্রুততার সঙ্গে বাংলাদেশে পাঠিয়েছে। ওই চাল সাম্প্রতিক বন্যা, রোহিঙ্গাদের আশ্রয়সহ বেশ কিছু সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে ব্যবহৃত হচ্ছে। অন্যদিকে ভারত সরকার ৩০ নবেম্বর পর্যন্ত চাল রপ্তানি বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছে।
থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, রাশিয়া, ভিয়েতনাম ও ভারতের সঙ্গে চাল আমদানির জন্য চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই করে বাংলাদেশ সরকার। এর মধ্যে একমাত্র ভিয়েতনাম থেকে আড়াই লাখ টনের বিপরীতে দেড় লাখ টন চাল এসেছে। কম্বোডিয়া ও থাইল্যান্ডের সঙ্গে চুক্তি হলেও এখনো চাল পায়নি সরকার। তবে কম্বোডিয়া থেকে প্রতিটন ৪৫৩ মার্কিন ডলার হিসেবে আড়াই লাখ টন আতপ চাল কিনতে গত বুধবার ঋণপত্র (এলসি) খোলা হয় বলে জানান খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক। উল্লিখিত সব দেশের সঙ্গেই ৫ বছরের সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে।

http://www.dailysangram.com/post/299972-