১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭, শনিবার, ৯:০৯

সড়কে মৃত্যুর মিছিল থামছে না

নিহতের সংখ্যা ২০০০ ছাড়াল

দুর্ঘটনায় গতকাল শুক্রবারও দুই শিশুসহ তিনজন নিহত হয়েছেন। এ নিয়ে গত ২১৩ দিনে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তির সংখ্যা দাঁড়াল ২ হাজার ১ জনে। এ সময় প্রতিদিন গড়ে ৯ জনের বেশি প্রাণ ঝরেছে সড়কে।

গতকাল নিহত তিনজনের দুজনই পথচারী। অপরজন হলেন রিকশাযাত্রী। সড়ক দুর্ঘটনায় কারা, কীভাবে মারা যাচ্ছে সে বিষয়ে ২০১৫ সালে একটি গবেষণা করেছিল বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক। গবেষণায় বলা হচ্ছে, যাদের মৃত্যু হচ্ছে তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি হলো পথচারী, ৪১ শতাংশ। এরপর ১৯ শতাংশ প্রাণ যায় বাস বা অন্য যানের যাত্রীদের। মোটরসাইকেল বা তিন চাকার বাহনের আরোহী আছে ১৬ শতাংশ।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সাম্প্রতিক গবেষণাতেও সড়ক দুর্ঘটনার সবচেয়ে বড় শিকার হিসেবে পথচারীদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। পথচারীদের একটা বড় অংশই আবার স্কুলগামী শিক্ষার্থী।
গতকাল নওগাঁর রানীনগরে স্কুলছাত্র জিহাদ হোসেন (১২), চট্টগ্রামের সিনেমা প্যালেস মোড়ে দুই বছরের শিশু মোজাম্মেল হোসেন ও সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলায় গ্রাম পুলিশ সদস্য বারিক মিয়া (৪২) ট্রাকচাপায় নিহত হন।
২১৩ দিন ধরে প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক, আঞ্চলিক কার্যালয় ও প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্যের ভিত্তিতে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তির সংখ্যার হিসাব রাখা হচ্ছে। সড়ক দুর্ঘটনার কারণ ও নিহত ব্যক্তিদের পরিচয় পর্যালোচনা করে দেখা যায়, মূলত ফিটনেসবিহীন যানবাহন ও বেপরোয়া গতির কারণে দুর্ঘটনা বেশি ঘটছে। এর ফলে পথচারী এবং যাত্রীরা সবচেয়ে ঝুঁকির মধ্যে পড়ছেন। কিন্তু বাংলাদেশে সরকারিভাবে পথচারীদের সচেতন করার কোনো কর্মসূচি নেই। সম্প্রতি প্রাথমিক স্তরে কিছু বইয়ে সড়ক নিরাপত্তার বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসাব বলছে, দেশে মোট যানবাহন আছে ২৯ লাখ ৮৪ হাজার। এর মধ্যে ফিটনেস সনদবিহীন চলছে ২ লাখ ৭০ হাজার। এর বেশির ভাগই যাত্রীবাহী বাস ও ট্রাক।

অবশ্য ফিটনেস সনদ আছে এমন যানেরও যান্ত্রিক ত্রুটি থাকতে পারে। কারণ, আইনে যানবাহনের প্রায় ৬০টি কারিগরি ও বাহ্যিক দিক বিবেচনা করে সনদ দেওয়ার কথা রয়েছে, যা বিআরটিএর একজন মোটরযান পরিদর্শকের পক্ষে খালি চোখে নিশ্চিত করা কার্যত অসম্ভব। যানবাহন না দেখেই ফিটনেস সনদ দেওয়ার অভিযোগ আছে। বিআরটিএর মিরপুর কার্যালয়ে ফিটনেস দেওয়ার একটি স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র বসানো হয়েছে। এতে দৈনিক বড়জোর ১০০ যান পরীক্ষা করা সম্ভব। যন্ত্রে দেওয়ার পর অর্ধেক বাস-ট্রাকই ফিটনেস পরীক্ষায় উতরাতে পারছে না বলে বিআরটিএর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
বিআরটিএর হিসাব আরও বলছে, দেশে লাইসেন্স আছে ১৯ লাখ ৫১ হাজার চালকের। অর্থাৎ মোটরযানের তুলনায় প্রায় ১০ লাখ লাইসেন্স কম আছে। বাড়তি এই যানবাহনগুলো ভুয়া লাইসেন্সধারী চালক দিয়ে চালানো হচ্ছে। এ ছাড়া ১৯৯০ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত প্রায় ২ লাখ পেশাদার চালকের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে শ্রমিক সংগঠনের তালিকা ধরে, যথাযথ পরীক্ষা ছাড়াই।
মোটরযান আইন অনুসারে, একজন পেশাদার চালক টানা পাঁচ ঘণ্টার বেশি যানবাহন চালাতে পারবেন না। এর বেশি চালাতে হলে অবশ্যই আধা ঘণ্টার বিরতি দিতে হবে। তবে কোনোভাবেই দিনে আট ঘণ্টার বেশি যানবাহন চালাতে পারবেন না। কিন্তু চালকদের অনেকে টানা ১২-১৬ ঘণ্টাও যানবাহন চালাচ্ছেন।

চালক ও যানবাহনের এই দুরবস্থা যে সড়ক দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়াচ্ছে, তা গবেষণাতেও উঠে এসেছে। এআরআইয়ের ২০১৫ সালের গবেষণা অনুসারে, দেশে ৫৩ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানোর জন্য। আর চালকদের বেপরোয়া মনোভাবের কারণে দুর্ঘটনা ঘটে ৩৭ শতাংশ। পরিবেশ-পরিস্থিতিসহ অন্য কারণে দুর্ঘটনার পরিমাণ ১০ শতাংশ। আর ব্র্যাকের গবেষণা বলছে, ৩৮ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনার উৎস হচ্ছে বাস-মিনিবাস। ৩০ দশমিক ৪ শতাংশ দুর্ঘটনার মূলে ট্রাক। ১২ শতাংশ মোটরসাইকেল।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী প্রথম আলোকে বলেন, চালকদের ঘাতক তকমা দিয়ে সবাই দায়িত্ব সারছে। কিন্তু চালক যে বিশ্রাম পাচ্ছেন না, প্রশিক্ষণ দরকার এবং তাঁদের জীবনমান রক্ষা করতে হবে—এটা কারও নজরে নেই। ফলে চালকেরা এখন জাতীয় শত্রুতে পরিণত হয়েছেন। এমন মনোভাব থাকলে সমস্যার সমাধান হবে না।
অবশ্য সড়ক দুর্ঘটনার জন্য অব্যবস্থাপনা, পরিবহন খাতের বিশৃঙ্খলাকে দায়ী করেছেন বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘মানুষ মারা যাচ্ছে সেটি সংখ্যা হিসেবে গুনছি। এগুলো আসলে হাজার কোটি টাকার সম্পদ হারাচ্ছি। সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষের মৃত্যুর মিছিল থামাতে হলে সড়কে শৃঙ্খলা আনতে হবে। সড়ক ব্যবস্থাপনায় সরকারকে সমন্বিত কর্মসূচি নিতে হবে।’

নিহতদের ৪১% পথচারী
ফিটনেসবিহীন যানবাহন ও বেপরোয়া গতির কারণে দুর্ঘটনা বেশি
৫৩% সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানোর জন্য। আর চালকদের বেপরোয়া মনোভাবের কারণে দুর্ঘটনা ঘটে ৩৭ শতাংশ
দেশে মোট যানবাহন আছে ২৯ লাখ ৮৪ হাজার। এর মধ্যে ফিটনেস সনদবিহীন চলছে ২ লাখ ৭০ হাজার। এর বেশির ভাগই যাত্রীবাহী বাস ও ট্রাক
১৯% বাস বা অন্য যানের যাত্রী
১৬% মোটরসাইকেল বা তিন চাকার বাহনের আরোহী

http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1325161