১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭, শনিবার, ৯:০৪

টিআর ও কাবিটা প্রকল্প

মাগুরায় এবার ২৬ কোটি টাকার কাজে অনিয়ম

মাগুরায় এবার গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ (টিআর) ও গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কারের (কাবিটা) সহস্রাধিক প্রকল্পের ২৬ কোটি ৩৫ লাখ টাকার কাজে অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। কাজ না করেও টাকা লুটপাট করা হয়েছে। এ ঘটনায় চার উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তারা (ইউএনও) তদন্ত করে অধিকাংশ প্রকল্পে কোনো কাজই হয়নি বলে প্রমাণ পেয়েছেন।
এর মধ্যে শতাধিক প্রকল্পের কোনো অস্তিত্বই নেই। তা ছাড়া অন্তত ৩৫টি প্রকল্পে দুবার বরাদ্দ দেখানো হয়েছে। এক মাস ধরে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে অন্তত ৩৫টি প্রকল্প এলাকায় অনুসন্ধান চালানো হয়। এসব প্রকল্পের একটিতেও কোনো কাজ হয়নি।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১ হাজার ১৩২টি প্রকল্পের অনুকূলে এই অর্থ বরাদ্দ দেয়। নিয়মানুযায়ী ৩০ জুনের মধ্যে প্রকল্পগুলোর কাজ শেষ করার কথা। কাজ শেষ হয়েছে এমন প্রতিবেদন দাখিল করে অর্থও ছাড় করা হয়েছে।

টিআর প্রকল্পের আওতায় ছোট পরিসরে রাস্তা সংস্কার, সোলার প্যানেল স্থাপন, ঈদগাহ বা অন্য কোথাও মাটি ভরাট, মসজিদ-মন্দির সংস্কার এবং ছোট কালভার্ট নির্মাণ করা হয়। প্রতিটি প্রকল্পে সর্বোচ্চ ৪-৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। কাবিটার প্রকল্পে বরাদ্দ দেওয়া হয় ১৪-১৫ লাখ টাকা। এর আওতায় রাস্তা সংস্কার, খাল পুনঃখনন প্রভৃতি কাজ করা হয়। গত অর্থবছরে মাগুরায় টিআরের (বিশেষ) জন্য ৯৬৯টি প্রকল্পে ৭ কোটি ২০ লাখ এবং কাবিটার (বিশেষ) জন্য ১৬৩টি প্রকল্পে ১৯ কোটি ১৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। প্রকল্পগুলোর জন্য বরাদ্দ ২৬ কোটি ৩৫ লাখ ৮৩ হাজার ৬৬০ টাকা উত্তোলন করা হয়েছে।
জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আতিকুর রহমান বলেন, প্রকল্পগুলোর ব্যাপারে অভিযোগ তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
সরেজমিন অনুসন্ধান
সদর উপজেলার শত্রুজিৎপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) বিষ্ণুপুর পশ্চিমপাড়া জামে মসজিদের সামনের রাস্তা সংস্কারসহ মসজিদের পাশে আরও চারটি প্রকল্পের জন্য তিন টন করে গম বরাদ্দ দেওয়া হয়। প্রকল্প এলাকার বাসিন্দা আবুল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, পাঁচটি প্রকল্পে একমুঠো মাটির কাজও হয়নি। আর তিনটি রাস্তা তো রীতিমতো ইট বিছানো। সেখানে মাটির কাজের সুযোগই নেই।

বিষ্ণুপর গ্রামের পাশে খানপুর স্কুলের সামনে থেকে ঈদগাহ হয়ে ইছাহাকের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা পুনর্নির্মাণের জন্য ৩০ টন কাবিটার চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়। স্থানীয় ইউপি সদস্য জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমার জানামতে, দু-এক বছরের মধ্যে এই রাস্তায় কোনো মাটি ফেলা হয়নি।’
ধনেশ্বরগাতি ইউপির থৈপাড়া পাকা রাস্তা থেকে নিত্যান্দী পর্যন্ত রাস্তা সংস্কারের জন্য ৩৫ টন চাল, অর্থাৎ ১২ লাখ ৯৮ হাজার ৩৯৭ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। স্থানীয় তালখড়ি গ্রামের বাসিন্দা ও জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য সরোয়ার মল্লিক বলেন, এই নামে এই এলাকায় কোনো রাস্তা নেই। ভুয়া নাম দিয়ে বরাদ্দ এনে সব টাকা লুটপাট করা হয়েছে।
ধনেশ্বরগাতি ইউপির চেয়ারম্যান বিমল শিকদার বলেন, এখানে ভালোভাবে কাজ হয়েছে। কোনো অসুবিধা নেই।
শ্রীপুর উপজেলার গয়েশপুর ইউপির চণ্ডীবর সেতু থেকে ইউপি সদস্য তোবারক হোসেনের বাড়ি পর্যন্ত খাল পুনঃখনন, তাঁর বাড়ির সামনে থেকে বাকি মোল্লার বাড়ির জমি পর্যন্ত খাল পুনঃখনন, নবগ্রাম সেতু থেকে সুন্দর পুকুর পর্যন্ত খাল পুনঃখনন, মাশালিয়া ঠাকুর সেতু থেকে নবগ্রাম সেতু পর্যন্ত খাল পুনঃখনন, মাশালিয়া দেলোয়ারের বাড়ি থেকে সেকেনের পুকুর পর্যন্ত খাল পুনঃখনন এবং তেঁতুলবাড়িয়া নিমাইয়ের বাড়ি থেকে কাটাখালের মাথা পর্যন্ত খাল পুনঃখননের জন্য মোট ২০০ টন চাল কাবিটার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ ছয়টি প্রকল্পের কোথাও কাজ হয়নি। চণ্ডীবর গ্রামের নুরোল মোল্লা, গোলাম রাব্বানী, ইবাদত আলীসহ অন্তত ১০ জন বলেন, গ্রামের মাঝে ডোবার মতো খাল। এখানে এক ছটাক মাটি কাটার কাজও হয়নি। কিন্তু ঘটনাস্থল থেকে মুঠোফোনে জানতে চাইলে একটি প্রকল্পের সভাপতি ইউপি সদস্য তোবারেক হোসেন বলেন, ‘আমার বাড়ির পাশেই খাল। ওই খাল সুন্দরভাবে খনন করা হয়েছে।’

মহম্মদপুর উপজেলার পলাশবাড়িয়া ইউপির যশোবন্তপুর স্কুল থেকে জীতের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা সংস্কারের জন্য ৫০ টন গম বরাদ্দ দেওয়া হয়। মূলত কাঁচা রাস্তাটি এলজিইডির। রাস্তাটি পাকা করার জন্য এলজিইডি এ বছর ঠিকাদার নিয়োগ দিয়েছে।
যশোবন্তপুর জিল্লুর বাড়ি থেকে চর যশোবন্তপুর শাম মিয়া বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা সংস্কারের জন্য কাবিটার বরাদ্দ দেওয়া হলেও মাটি বা ইটের কোনো কাজই হয়নি বলে এলাকার লোকজন জানান।
শালিখার ধনেশ্বরগাতি ইউপির ধাওয়ালী সেতু থেকে কিবরিয়া বিশ্বাসের বাড়ি পর্যন্ত খাল পুনঃখনন, কোরিয়া বিশ্বাসের বাড়ি থেকে তিন রাস্তার মোড় পর্যন্ত খাল পুনঃখনন এবং ধাওয়াখালী তিন রাস্তা থেকে ফটকী নদী পর্যন্ত খাল পুনঃখননের জন্য কাবিটায় ১২০ টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়। ধাওয়ালী গ্রামের বাসিন্দা নারায়ণ চন্দ্র শিকদার বলেন, ‘পাঁচ-সাত বছরের মধ্যে এখানে খাল খনন হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই।’
ওই তিনটি প্রকল্পের সভাপতি স্থানীয় ইউপি সদস্য আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘খাল খনন করা হয়নি এ কথা সত্যি। তবে সভাপতি হলেও আমি ওই প্রকল্প সম্পর্কে কিছুই জানি না।’
শালিখার তালখড়ি ইউনিয়নের (ইউপি) চতিয়া ব্রিজ থেকে গোবিন্দপুর ও সাতনাফুরিয়া থেকে চতিয়া ব্রিজ পর্যন্ত খাল পুনঃখননের জন্য ৪০ টন করে মোট ৮০ টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
তালখড়ি ইউপির চেয়ারম্যান সিরাজ উদ্দিন মণ্ডল বলেন, ‘ওই প্রকল্প সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। কোনো কাজও হয়নি। শুনেছি, ধনেশ্বরগাতি ইউপি সদস্য বাবলু মোল্লা প্রকল্পের সভাপতি।’ জানতে চাইলে বাবলু মোল্লা বলেন, ‘আমি ওই প্রকল্প সম্পর্কে কিছুই জানি না।’
সদর ও শ্রীপুর উপজেলার দায়িত্বে থাকা পিআইও মো. নুরুজ্জামান বলেন, ‘প্রকল্পের সভাপতি নির্বাচন করেন ইউপি চেয়ারম্যানরা। আমরা শুধু তদারক করি। অর্থবছরের শেষ পর্যায়ে বরাদ্দ আসায় প্রকল্পের অনুকূলে টাকা ব্যাংক ড্রাফট (বিডি) করে রাখা হয়েছে। সব প্রকল্পের মাস্টাররোল এখনো দাখিল করা হয়নি। কিছু ত্রুটি হতে পারে। তবে কাজ হয়নি এমন প্রকল্প নেই।’
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তার (ডিআরও) দায়িত্বে থাকা নির্বাহী হাকিম মোহাম্মদ জাকারিয়া বলেন, ‘প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তারা প্রকল্পের কাজ শেষ করে জুনের মধ্যেই প্রতিবেদন দাখিল ও অর্থ ছাড় করিয়ে নেন। অনিয়মের অভিযোগ ওঠার পরিপ্রেক্ষিতে গত আগস্টে জেলা প্রশাসকের নির্দেশে ইউএনওরা তদন্ত করে অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছেন।
শালিখা ও মহম্মদপুর উপজেলার দায়িত্বে থাকা পিআইও মো. মিরাজ হোসেন খান বলেন, ভুল হয়েছে। ওই ২৫টি প্রকল্পের টাকা প্রকল্পের সভাপতিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সরকারি কোষাগারে ফেরত দেওয়া হবে। তবে তিনি দাবি করেন, তাঁর এলাকায় ৭৫ শতাংশের বেশি প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে।

দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা গেছে, মূলত মাগুরা জেলার তিন সাংসদ যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী বীরেন শিকদার, মেজর জেনারেল (অব.) আবদুল ওয়াহহাব ও সংরক্ষিত মহিলা আসনের সাংসদ কামরুল লায়লার আধা সরকারি পত্রের (ডিও) পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রণালয় থেকে ওই বরাদ্দ দেওয়া হয়।
মাগুরা-১ আসনের (শ্রীপুর ও সদরের একাংশ) সাংসদ আবদুল ওয়াহহাব বলেন, ‘আমি তো এগুলো (প্রকল্প) আওয়ামী লীগের লোকজনকেই দিয়েছি। আর কাজ বুঝে নেওয়ার দায়িত্ব ইউএনও ও পিআইওর। যদি কাজ না হয়, সে দায় তাঁদের। আমার কী করার আছে?’

ভুয়া প্রকল্পের নামে ডিও দেওয়া সম্পর্কে মাগুরা-২ আসনের (শালিখা, মহম্মদপুর ও সদরের একাংশ) সাংসদ যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী বীরেন শিকদার বলেন, ‘টিআর ও কাবিটার জন্য আমি কোনো ডিও দিইনি। বিশেষ বরাদ্দ কবে দেওয়া হয়েছে তা-ও আমি কিছু জানি না।’
সাংসদ কামরুল লায়লা বলেন, ‘আমার বরাদ্দ খুবই কম। আমার ডিও মসজিদ-মন্দিরের কাজের জন্য দেওয়া। খাল খনন বা রাস্তা সংস্কার নেই। তা ছাড়া আমি আমার বরাদ্দের তালিকা ডিসি সাহেবকে দিয়েছি। বলেছি, ওগুলোর বাইরে আমি কাউকে ডিও দিইনি।’
জেলা প্রশাসকের দপ্তরের সূত্রমতে, ইউএনওরা জেলা প্রশাসকের দপ্তরে প্রাথমিকভাবে যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন, ওই প্রতিবেদনে তাঁরা অধিকাংশ প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন এবং কিছু প্রকল্পের কাজ চলমান বলে উল্লেখ করেন।
মহম্মদপুরের ইউএনও চৌধুরী রওশন ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘তদন্ত করে দেখেছি, আমার এখানে কোনো প্রকল্পেরই কাজ হয়নি। জেলা প্রশাসকের কাছে এ ব্যাপারে একটি প্রতিবেদনও দিয়েছি। কাজ না হওয়ায় প্রকল্পগুলোর অনুকূলে আসা বরাদ্দের টাকা ফেরত যাবে। কাজ না করে কাউকে টাকা দেওয়া হবে না।’

সদর উপজেলার ইউএনও আশাফুর রহমান বলেন, ‘তদন্ত করতে গিয়ে আমার এখানে অধিকাংশ প্রকল্পের অস্তিত্ব পাইনি। যেগুলো পেয়েছি সেগুলোর একটিরও কাজ হয়নি। তাই প্রকল্পগুলোর অনুকূলে অর্থ ছাড় করা হয়নি। ত্রাণ ও পুনর্বাসন অধিদপ্তর থেকে একটি তদন্ত দল আসার কথা। এলে তাদের কাছে আমাদের তথ্য-উপাত্য উপস্থাপন করব।’
শ্রীপুরের ইউএনও আহসান উল্লাহ শরিফী বলেন, ‘জুন মাসে বরাদ্দ ছেড়ে দিতে হয়। অফিশিয়ালি কাজ শেষ হয়েছে বলেও দেখাতে হয়। মূলত অর্থবছর শেষ হওয়ার দু-এক মাসের মধ্যে কাজ সম্পন্ন হলে প্রতিবেদন দিতে হয়। আমার উপজেলায় সব প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে। তবে এখনো প্রতিবেদন দাখিল করা হয়নি। প্রক্রিয়া চলছে।’
শালিখার ইউএনও সুমন মজুমদার বলেন, এই উপজেলায় কিছু প্রকল্পে কাজে সমস্যা আছে। আবার অনেক প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে।
এর আগে মাগুরায় ওয়াজ মাহফিল ও নামযজ্ঞ অনুষ্ঠানের নামে ভুয়া প্রকল্প সাজিয়ে অর্থ আত্মসাতের চেষ্টার অভিযোগ পাওয়া যায়। এ নিয়ে গত ২২ জুলাই প্রথম আলোর প্রথম পাতায় ‘মাগুরায় ১৭৭৬টি ওয়াজ মাহফিল ও নামযজ্ঞ অনুষ্ঠানে বরাদ্দ-ভুয়া প্রকল্পে ২৪ কোটি টাকা’ শিরোনামে প্রতিবেদন ছাপা হয়। পরে প্রকল্পগুলোর বরাদ্দ স্থগিত করে মন্ত্রণালয়।

http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1325071