১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭, শনিবার, ৮:৫৮

যানজটের নগরীতে অসহায় রোগীর জীবন

ক্যানসার রোগী সিদ্দিককে একটি পরীক্ষা করানোর জন্য চিকিৎসক সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে রেফার করেন। ফলে রোগীকে টেস্ট করানোর জন্য অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে ওই হাসপাতালটিতে যেতে হয় রোগীর স্বজনকে। যানজটের কারণে রাস্তায় সময় লাগে তিন ঘণ্টার উপরে। রোগীর ভাই মোতাছিন বিল্লাহ জানান, অ্যাম্বুলেন্স হওয়া সত্ত্বেও রাস্তায় তেমন কোনো সুযোগ পাননি তারা। সাধারণ গাড়ির মতোই তাদের যেতে হয়েছে। তিনি আরো জানান, কয়েকদিন পর অবশ্য তার ভাই মারা যান। চলতি বছরের ১২ই জুন ঢাকার নাবিস্কোতে এক সড়ক দুর্ঘটনায় মারাত্মক আহত হন রিকশাচালক মোসলেম উদ্দিন। পরে তাকে পথচারীরা উদ্ধার করে তেজগাঁও শাখার শমরিতা হাসপাতালে নিয়ে যান। হাসপাতালটি রোগীকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে তাকে দ্রুত ঢামেকে নিয়ে ভর্তি করতে বলে। পরে পথচারীরা ওই রোগীকে অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢামেকে নিয়ে যাওয়ার পথে দেড় থেকে দু’ঘণ্টার যানজটের কবলে পড়েন। এই সময়ে রোগীর অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মারাত্মক সমস্যার সৃষ্টি হয়। ঢামেকে নেয়ার পর চিকিৎসকরা বলেছিলেন, রোগীর রক্তক্ষরণটা বেশি হয়েছে। দ্রুতই দু’ব্যাগ রক্ত দিতে হবে। শুধু সিদ্দিক বা মোসলেম নন, রাজধানীতে যানজটে প্রতিদিন হাজার রোগী ভোগান্তিতে পড়েন। এই শহরে রোগীবাহী অ্যাম্বুলেন্স অনেক সময়ে অগ্রাধিকার পায় না। আর যানজটের ভোগান্তিতে পড়ে অনেক অ্যাম্বুলেন্স হাসপাতালে দেরিতে পৌঁছার কারণে অনেক রোগী লাশ হয়ে সেই অ্যাম্বুলেন্সে বাড়ি ফিরেছেন বলে অ্যাম্বুলেন্সের চালকরা জানিয়েছেন। ঢাকা শহরে যানজটে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি নিত্যদিনের। কিন্তু রোগীরাও এতে রেহাই পাচ্ছেন না। অ্যাম্বুলেন্সে যাতায়াত করা অসুস্থ ও মুমূর্ষু রোগী অনেক সময়ে সঠিক সময়ে হাসপাতালে পৌঁছতে পারেন না। যে অ্যাম্বুলেন্স মানুষের জীবন বাঁচাতে রাস্তায় নামে, সেটিই যদি শিকার হয় এই ভোগান্তির তবে অসুস্থ রোগীর জীবন নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। ঢাকা শহরে প্রতিদিন অসংখ্য রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে নেয়ার মতো অবস্থায় পড়তে হয়। কিন্তু মাঝপথে তাদের সম্মুখীন হতে হয় ট্রাফিক জ্যাম নামের এক কঠিন সমস্যায়। সংশ্লিষ্টরা বলেন, যানজট, প্রাইভেট কার-এর আধিক্য এবং কিছু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গাফিলতির কারণে ভুগতে হচ্ছে অ্যাম্বুলেন্সের এবং তার যাত্রীদের। ঘণ্টার পর ঘণ্টা পড়ে থাকতে হচ্ছে এই যানজটে। এছাড়া, দেশের অ্যাম্বুলেন্সগুলোতেও চিকিৎসা সেবার তেমন কোনো সরঞ্জাম নেই। তাই রোগীদের আরো বেশি ভুগতে হচ্ছে যানজট নামক এই বাধায়। ফারুক নামের এক অ্যাম্বুলেন্স চালকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় তার ভোগান্তির কিছু কথা। তিনি জানান, কিছু কিছু ট্রাফিক পুলিশ অসাধু উপায়ে তাদের কাছ থেকে অ্যাম্বুলেন্সের প্রতিটি সিটের জন্য চার্জ করে এবং টাকা আদায় করে। আর যখন রাস্তা দিয়ে ভিআইপি গাড়ি যায় তখন তাদের আটকা পড়ে থাকতে হয় অনেকক্ষণ। এসময় অনুরোধ করেও তাদের রোগী নিয়ে যেতে দেয়া হয় না। ঢাকা মেডিকেল কলেজের এক অ্যাম্বুলেন্স চালক বলেন, প্রাইভেট গাড়িগুলো আমাদের মোটেও সাইড দেন না। এমনকি গাড়িতে মুমূর্ষু রোগী থাকা অবস্থাতে সাইরেন বাজালেও না। মাঝে মাঝে পুলিশ আমাদের গাড়ি থামিয়ে কাগজপত্র দেখেন। আমাদের গাড়িতে মূলত লাইফ সাপোর্টে থাকা রোগীরাই থাকেন, কিন্তু তারপরেও প্রাইভেট গাড়িগুলো বা ট্রাফিক পুলিশ আমাদের কোনোই সাহায্য করেন না। তবে আরেকজন অ্যাম্বুলেন্স চালক কায়সার জানান, কিছু ট্রাফিক পুলিশের সাহায্য তিনি পেয়েছেন। ট্রাফিক পুলিশ আমাদের যানজটে পড়লে সাহায্য করে কিন্তু প্রাইভেট গাড়িগুলো আমাদের মোটেও গুরুত্ব দেয় না এবং আমাদের যেতেও দেয় না। একজন ট্রাফিক পুলিশ এ ব্যাপারে বলেন, যদি আমরা যানজটের ভেতরে কোনো অ্যাম্বুলেন্স দেখি বা সাইরেন শুনতে পাই তবে রাস্তা দিয়ে যতই ভিআইপি গাড়ি যাক না কেন আমরা সেই ভিআইপি গাড়ির রাস্তা বন্ধ করে দেই। যদি আমরা অ্যাম্বুলেন্সের সামনে কোনো প্রাইভেট গাড়ি দেখি তাহলে প্রাইভেট গাড়িটিসহ অ্যাম্বুলেন্সটিকে যেতে দেই। যদি আমরা দেখি কোনো অ্যাম্বুলেন্স যানজটে পেছনে পড়ে আছে তাহলে আমরা তাদের উল্টো পথ দিয়ে যাওয়ারও সুবিধা করে দেই। অ্যাম্বুলেন্সে যদি কোনো রোগী থাকে তবে আমরা সেই গাড়ি আর থামাই না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ এ প্রসঙ্গে বলেন, এক্ষেত্রে রোগীদেরকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। অনেক মুমূর্ষু রোগী অ্যাম্বুলেন্সে থাকেন সংশ্লিষ্টদের বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। যানজটে পড়লেও তাদেরকে কিভাবে দ্রুত হাসপাতালে পৌঁছানো যায় সেদিকে নজর দিতে হবে। আইনও মানতে হবে আমাদের।

রাজধানীর যানজট নিয়ে ২০১৫ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)-এর পুরকৌশল বিভাগ এক গবেষণা করে। ওই গবেষণায় দেখা গেছে, যানজটে ঢাকা সিটিতে বছরে আর্থিক হিসেবে ৩২ হাজার কোটি টাকার কর্মঘণ্টার ক্ষতি হয়। পুরকৌশল বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. মো. হাদিউজ্জামান মানবজমিনকে জানান, ঢাকা শহরে প্রতিদিন যে কোনো পরিবহন মিলে মোট ২২ মিলিয়ন ট্রিপ দেয়া হয়। ট্রিপের গড় দূরত্ব ৫ দশমিক ৪ কিলোমিটার। প্রতি ট্রিপে ৩০ মিনিট করে দেরি ধরে এই হিসাব করা হয়েছে। পিক আওয়ারে অর্থাৎ বিকাল সোয়া ৬টা থেকে সোয়া ৭টা পর্যন্ত এই নেটওয়ার্কে প্রতি ঘণ্টায় রাস্তায় দেরি হওয়ার কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতি হয় আট লাখ টাকা। ড. মো. হাদিউজ্জামান আরো জানান, তাদের গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী ঢাকা শহরে গণপরিবহন আরো বাড়াতে হবে। পথচারীদের বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। রোগীবাহী অ্যাম্বুলেন্সকে গুরুত্ব দিতে হবে বেশি। বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণায় দেখা গেছে, যানজটের কারণে রাজধানী ঢাকায় প্রতিদিন ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। আর যানজটের কারণে বছরে যে আর্থিক ক্ষতি হয়, অঙ্কের হিসাবে তা প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। গত কয়েক বছরের বিভিন্ন গবেষণার তথ্য বিশ্লেষণ করে আর্থিক ক্ষতির এ আনুমানিক পরিমাণ পাওয়া যায়। এই শহরে এখন ঘণ্টায় গড়ে প্রায় সাত কিলোমিটার গতিতে চলছে যানবাহন। বিশ্বব্যাংক বলছে, এভাবে চলতে থাকলে আর কিছুদিন পর হেঁটেই গাড়ির আগে যেতে পারবে মানুষ। তীব্র যানজটের সময় গাড়ির আগে হেঁটে যাওয়ার অভিজ্ঞতা নগরবাসীর কাছে অপরিচিত নয়। যানজট পরিস্থিতি দিন দিন যেভাবে খারাপ হচ্ছে, তাতে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণও যে বাড়বে, তা বলাইবাহুল্য। যানবাহনের পরিমাণ যদি একই হারে বাড়তে থাকে এবং তা নিরসনের কোনো উদ্যোগ না নেয়া হয়, তাহলে ২০২৫ সালে এই শহরে যানবাহনের গতি হবে ঘণ্টায় চার কিলোমিটার, যা মানুষের হাঁটার গতির চেয়ে কম। মানুষের হাঁটার গড় গতি ঘণ্টায় পাঁচ কিলোমিটার বলে মনে করা হয়।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=83207