১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭, শনিবার, ৮:৫২

নাফ নদীর তীরে শতাধিক রাষ্ট্রবিহীন শিশুর জন্ম

পেটের সন্তানকে বাঁচাতে নিজের জীবন বাজি রাখলেন শতাধিক রোহিঙ্গা নারী। তারা বর্মি বাহিনীর আক্রমণ থেকে প্রাণে বেঁচে সীমান্ত পেরিয়ে আসার পথেই জন্ম দিয়েছেন শতাধিক রাষ্ট্রবিহীন, আশা-স্বপ্ন-ভবিষ্যৎহীন সন্তানের। এমন প্রতিকূলতার মাঝেও গর্ভধারণী মা সন্তান জন্ম দিতে পেরে খুবই খুশি।

গত বুধবার উখিয়ার আনজুমান পাড়ায় কথা হয় রোহিঙ্গা নারী হাছিনা বেগমের সাথে। তিনি মিয়ানমারের টংবাজার এলাকার বাসিন্দা নাছির মোহাম্মদের (৪০) স্ত্রী। ৬ দিন হেটে পৌঁছেন বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের জিরো পয়েন্টের ওপারে কুয়ানচিবং এলাকায়। গত রোববার সকালে ১০টায় সেখানে থেকে এপারে এসে আশ্রয় নেন পালংখালী আঞ্জুমানপাড়ায় নাফ নদীর পাড়ে।
এক দিকে দেশ ছেড়ে পালিয়ে আসার চেষ্টা, অন্য দিকে সন্তান প্রসব যন্ত্রণা। সাথে ুধার যন্ত্রণা। এ বিপদের সময় তার পাশে ছিলেন স্বামী ও স্থানীয় বিজিবির সদস্যরা। তাদের সহযোগিতায় নাফ নদীর কাদামাটিতে জন্ম দিলেন এক পুত্রসন্তান। হাছিনা বেগম বলেন, মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে আমার ছেলে নাফ নদীর এপারে সীমান্তে জন্ম নিয়েছে। ক্ষুধার জ্বালায় কাতর হয়ে আসছে শরীর। দুর্বলতা অনুভব করছি। খোলা আকাশের নিচে আছি, বৃষ্টি হলে নবজাতক নিয়ে কী করব এ চিন্তায় আছি।
২৫ বছর বয়সী সুরাইয়া সুলতানা ২৬ আগস্ট অনাগত সন্তানের জীবন বাঁচতে রাখাইনের নিজ বসতভিটা ছেড়ে এক কাপড়ে বেরিয়ে পড়েন। সেনাবাহিনী সে দিন তাদের গ্রামে নারকীয় তাণ্ডব চালায়। পুরো গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়। পুরুষদের নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করা হয়। বুলেটের আঘাত থেকে রক্ষা পায়নি নিষ্পাপ শিশুরাও। সুরাইয়ার ভাষায়, ওই দিন সেনাবাহিনী ও মগ সন্ত্রাসীদের হাতে সম্ভ্রম হারান তার গ্রামের শতাধিক নারী ও কিশোরী। দুই দিন পাহাড়-জঙ্গলের বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে সুরাইয়া পৌঁছান বাংলাদেশ সীমান্তের টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যং ইউনিয়নের ঝিমংখালি বেড়িবাঁধ এলাকার নো ম্যানস ল্যান্ডে। সেখানে বিজিবি তাদের বাংলাদেশ প্রবেশে বাধা দেয়। সেখানেই সুরাইয়ার প্রসব ব্যথা ওঠে। এক দিকে প্রসব ব্যথা, অন্য দিকে খোলা আকাশের নিচে অঝোরে বৃষ্টি। অবশেষে দয়া হয় কর্তব্যরত বিজিবি কর্মকর্তার। সুরাইয়াসহ দুর্ভাগা কয়েকজন মহিলাকে নিজেদের বোটে আশ্রয় দেন ওই কর্মকর্তা। বোটের মধ্যেই প্রসব বেদনা শুরু হলে কয়েকজন মহিলা শাড়ি দিয়ে বেষ্টনী তৈরি করেন। ভারী বৃষ্টির মধ্যে বোটের মধ্যেই জন্ম নেয় সুরাইয়ার সন্তান। নবজাতকসহ মায়ের স্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে তাদের পাঠিয়ে দেয়া হয় নিকটস্থ নয়াপাড়া ক্যাম্পে। সেখানে তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়।

নয়াপাড়ার শরণার্থী ওই ক্যাম্পে গিয়ে মা সুরাইয়া ও তার শিশুসন্তান আয়েশার খোঁজ পাওয়া যায়। ক্যাম্প ইনচার্জ মো: মমিনুল হক বলেন, ২৬ আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত এখানে শতাধিক নবজাতক ও প্রসূতির চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। যাদের জন্ম হয়েছে নো ম্যানস ল্যান্ডে। আমরা সাধ্য অনুযায়ী তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছি।

বালুখালী পাহাড়ের চূড়ায় জন্ম হয় রোহিঙ্গা কিশোরী নূর বিবির প্রথম কন্যাসন্তান। ৮ সেপ্টেম্বর দুপুরে বালুখালী পাহাড়ের চূড়ায় সদ্য জন্ম নেয়া মেয়েকে বুকে জড়িয়ে বসে থাকতে দেখা যায় নূর বিবিকে। তবে প্রথম মা হওয়ার আনন্দ স্পর্শ করতে পারছে না তাকে। কারণ তার মা-বাবাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। একই সময় সবাই বাড়ি থেকে বের হলেও তারা কোথায় আছেন তা জানেন না তিনি।

জঙ্গলেই দ্বিতীয় সন্তানের জন্ম হয়েছে ২২ বছর বয়সী তাহেরার। বাংলাদেশে আসার পথে একটি জঙ্গলে এ সন্তানের জন্ম দিয়েছেন তিনি। তাহেরা বলেন, আমার জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময় ছিল এটি। টানা তিন দিন স্বামী আর ছোট ভাইয়ের কাঁধে চড়ে বাংলাদেশ সীমান্তের নো ম্যানস ল্যান্ডে আসেন। তাদের কাঁধেই সদ্য ভূমিষ্ঠ হওয়া শিশুসন্তান নিয়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়েছেন। এভাবে কোনো রকম চিকিৎসা সহায়তা ছাড়া বাংলাদেশ-মিয়ানমারের নো ম্যানস ল্যান্ডে শতাধিক রোহিঙ্গা শিশুর জন্ম হয়েছে। যাদের শারীরিক অবস্থা খুবই শোচনীয় বলে জানা গেছে।

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/252112