১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭, শনিবার, ৮:২৯

রোহিঙ্গা সংকট

বৈশ্বিক চাপেও থামেনি মিয়ানমার

মার্কিন প্রতিনিধিদল যাচ্ছে মিয়ানমারে, রাখাইনের সহিংসতা কবলিত এলাকাগুলোতে যেতে দেওয়া হবে না
মিয়ানমারের পক্ষে রাশিয়ার বিবৃতি
নানামুখী আন্তর্জাতিক চাপের মুখেও থামছে না মিয়ানমার। দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীর বীভৎস হত্যা আর ধ্বংসযজ্ঞ থেকে প্রাণ বাঁচাতে গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত চার লাখের বেশি রোহিঙ্গা মুসলিম বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে।
সিএনএন গত বৃহস্পতিবার জানায়, রোহিঙ্গাদের বাস্তব অবস্থা দেখতে গত বৃহস্পতিবার মিয়ানমারে প্রতিনিধিদল পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে রাখাইন রাজ্য সরকারের সচিব টিম মং সুয়ে বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে গতকাল জানান, মার্কিন উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্যাট্রিক মার্ফিকে রাখাইনের সহিংসতাকবলিত এলাকাগুলোতে যেতে দেওয়া হবে না। তিনি শুধু ইয়াঙ্গুন গিয়ে স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চিসহ অন্য সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করবেন। রাখাইনের রাজধানী সিত্তে গিয়ে গভর্নরের সঙ্গেও বৈঠক করবেন।

ওয়াশিংটনে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত অং লিনকে বৃহস্পতিবার তলব করেন প্যাট্রিক মার্ফি। এ সময় অং লিনকে জানানো হয়, রাখাইনের গ্রামগুলোতে হামলাসহ সেখানকার সহিংসতায় যুক্তরাষ্ট্র গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। এ সময় প্যাট্রিক মার্ফি বলেন, মিয়ানমারের প্রকাশ্যে স্বীকার করা উচিত রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে পালিয়ে গেছে। বাংলাদেশে পালিয়ে যাওয়া রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার ফিরিয়ে নেবে।
রাখাইনের সহিংসতা নিয়ে অন্য দেশগুলোকে নাক গলানোর বিষয়ে সতর্ক করে দিয়েছে রাশিয়া। মস্কো মনে করে এটা মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয়। রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভার বরাত দিয়ে দেশটির সরকারি বার্তা সংস্থা স্পুটনিক শুক্রবার এ কথা জানায়।

জাখারোভা গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, ‘এটা বোঝা খুব গুরুত্বপূর্ণ যে একটি সার্বভৌম দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করা হলে তাতে করে আন্তধর্মীয় সংঘাতের আরও অবনতি হতে পারে। আমি জোর দিয়ে বলছি, মিয়ানমারে সব ধর্মের নেতাদের নিয়ে আন্তধর্মীয় সংলাপের যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, আমরা তাকে স্বাগত জানাই।’
রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র জানান, মিয়ানমারে অভ্যন্তরীণভাবে যারা বাস্তুচ্যুত হয়েছে দেশটির কর্তৃপক্ষ তাদের বাড়িঘরে ফিরিয়ে নেওয়ার পদক্ষেপ নিচ্ছে। এই সংকটে অন্য যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদের ক্ষেত্রেও একই রকম পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
রাখাইনে সহিংসতার জন্য মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গণহত্যা, জাতিগত নিধন ইত্যাদি অভিযোগ ক্রমশ জোরের সঙ্গেই বলছে জাতিসংঘ, ইউরোপীয় পার্লামেন্ট, ওআইসি ছাড়াও বিভিন্ন দেশ। এরপরও সহিংসতা বন্ধ করছে না মিয়ানমার। উল্টো জাতিগত নিধনের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করছে।
রোহিঙ্গাদের নিধনে পোড়ামাটি নীতি: অ্যামনেস্টি
জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের পর এবার লন্ডনভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালও মিয়ানমারের বিরুদ্ধে
রাখাইনে ‘জাতিগত নিধনের’ অভিযোগ এনেছে। সংগঠনটি বলছে, মিয়ানমার সুপরিকল্পিতভাবে এই অভিযান চালাচ্ছে। দেশটির সেনাবাহিনী সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে।
অ্যামনেস্টি বলছে, রাখাইন থেকে রোহিঙ্গাদের নিধনের জন্য ‘স্কর্চড আর্থ’ (পোড়ামাটি) কৌশল নিয়েছে মিয়ানমার। ২৫ আগস্টের পর থেকে অন্তত ৮০টি এলাকায় সুপরিকল্পিতভাবে পুড়িয়ে দেওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে স্যাটেলাইট চিত্রে। অগ্নিসংযোগের তথ্য, স্যাটেলাইটের মাধ্যমে পাওয়া ছবি, তোলা ছবি, ভিডিও, প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে অ্যামনেস্টি নতুন তথ্যপ্রমাণ পেয়েছে। এসব থেকে প্রমাণিত হয়, প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের গ্রামকে লক্ষ্যবস্তু করে পরিকল্পিত অভিযান ও অগ্নিসংযোগ চালিয়েছে।

অ্যামনেস্টির ক্রাইসিস রেসপন্স ডিরেক্টর তিরানা হাসান বলেন, এসব তথ্যপ্রমাণ অকাট্য। রোহিঙ্গাদের দেশ থেকে তাড়াতেই মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রাখাইনে অভিযান চালাচ্ছে। নিঃসন্দেহে এটি জাতিগত নির্মূল অভিযান।
অ্যামনেস্টি আরও বলেছে, মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী রোহিঙ্গা নির্মূলে স্কর্চড আর্থ কৌশল গ্রহণ করেছে। এই কৌশলের মাধ্যমে গ্রামকে ঘিরে রাখে, পালানোর সময় মানুষকে গুলি করে, তাদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়—এসবই মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। গত চার বছরে এত প্রকটভাবে অগ্নিসংযোগের ঘটনা আর ঘটেনি।

স্কর্চড আর্থ এমন একটি সামরিক কৌশল, যাতে সেনারা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়ার সময় ‘শত্রু’ সেনাদের হত্যার পাশাপাশি সবকিছু পুড়িয়ে দেয়। শত্রুর পক্ষে ব্যবহার করা সম্ভব—এমন স্থাপনা ও অবকাঠামো পুড়িয়ে দেয়। এ থেকে পরিত্রাণ পায় না খাদ্যের উৎস, পানি সরবরাহ, পরিবহন, যোগাযোগ, শিল্পকারখানা। সামরিক কৌশল অনুযায়ী সেনাবাহিনী ‘শত্রু’ ভূমিতে অথবা নিজেদের নিয়ন্ত্রিত ভূখণ্ডেও ব্যবহার করতে পারে। শত্রুর সম্পদ ধ্বংস করার কৌশলের চেয়ে স্কর্চড আর্থ ভিন্ন। এই কৌশলটি একেবারেই কৌশলগত এবং রাজনৈতিক কারণে ব্যবহার করা হয়।
কৌশলগত কারণে সংঘর্ষকবলিত এলাকায় বেসামরিক নাগরিকদের খাদ্যের উৎস ও পানির সরবরাহ ধ্বংস করা আন্তর্জাতিক আইনবিরোধী।

http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1325116