১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭, শনিবার, ৮:২৬

চালের দাম বাড়লে রোহিঙ্গাদের খাওয়াব কী?


সমস্যার পর সমস্যা, বিপদের পর বিপদ। ২০১৭-১৮ অর্থবছরের অর্থনীতি এমনিতেই নানা চাপের মধ্যে, ইত্যবসরেই এসে হাজির রোহিঙ্গা সমস্যা। সমস্যাটি পুরনো; কিন্তু এবার হাজির ভয়ঙ্কর রূপে। লাখ লাখ রোহিঙ্গা অত্যাচারিত হয়ে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিচ্ছে। প্রাণ বাঁচাতে, ইজ্জত বাঁচাতে, একটু দম ফেলতে। এতেই তো বিষয়টি থেমে থাকে না। মানবতার কারণে, ঐতিহ্যের কারণে এখন বাংলাদেশকে এদের দেখভাল করতে হবে- খাওয়াতে হবে, থাকার ব্যবস্থা করতে হবে, চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে, তাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে। রোহিঙ্গাদের হিসাব রাখতে হবে। এ এক বিপুল কর্মযজ্ঞ। একদিনের নয়, কতদিনের কাজ তা কেউ আমরা জানি না। আমরা চাই, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও চায় রোহিঙ্গারা নিজ দেশে সসম্মানে ফিরে যাক। তারা সেখানকার নাগরিক হোক। কিন্তু মিয়ানমারের ‘জান্তা’ এটা চায় না। তারা করছে ‘এথনিক ক্লিনজিং’। এ অবস্থায় রোহিঙ্গাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা কতদিনের জন্য তা আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারি না। এর অর্থ কী? পাঁচ-সাত লাখ লোকের দৈনন্দিন খাওয়া-দাওয়া। কত খাবার লাগবে? বিশাল ব্যাপার। লাগবে প্রচুর অর্থ ও সরবরাহ। এই টাকার বাড়ি কোথায়?

টাকা না হয় জোগাড় করা গেল, খাবারের ব্যবস্থা কী? আমাদের নিজেদেরই এখন খাবার নিয়ে সমস্যা হচ্ছে। যুগান্তরে প্রকাশিত খবরের শিরোনাম : ‘চাল নিয়ে অস্বস্তি’। আরেকটি খবরের কাগজের শিরোনাম হচ্ছে ‘চালের দাম নিয়ন্ত্রণের বাইরে, আরও বাড়বে’। যুগান্তরের একটি নিবন্ধের শিরোনাম : ‘চালের দাম কমছে না কেন?’ এদিকে একটি অর্থনীতিবিষয়ক সংবাদপত্র চালের দামের দায়িত্ব খাদ্যমন্ত্রীর ঘাড়ে চাপিয়ে খবরের শিরোনাম করেছে, ‘খাদ্যমন্ত্রীর ব্যর্থতার পাল্লা ভারি হচ্ছে’। এর চেয়েও দুঃসংবাদ দিয়েছে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার একটি মূল্যায়ন প্রতিবেদন। এ প্রতিবেদনে দেশে চালের মূল্য বৃদ্ধি নিয়ে সতর্কবার্তা আছে। প্রকৃতপক্ষে প্রতিদিন চালের ওপর খবর ছাপা হচ্ছে। খুবই সতর্কতামূলক প্রতিবেদন।

পত্রিকার খবর পড়ে এবং টিভির খবর দেখেশুনে মনে হচ্ছে, চাল নিয়ে একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এ পরিস্থিতির শুরুটা আজকে নয়। দেশে অল্প সময়ের ব্যবধানে দুই দুইটা বন্যা হয়েছে- একটা ছোট আকারের এবং পরেরটা বড় আকারের। চালের মূল্যবৃদ্ধি ঘটতে শুরু করে প্রথম ছোট আকারের অকাল বন্যার পরই। ওই বন্যায় মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ইত্যাদি সিলেট বিভাগীয় অঞ্চল এবং বৃহত্তর ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোনার বিস্তীর্ণ অঞ্চল প্লাবিত হয়। প্রচুর বোরো ফসল বিনষ্ট হয়, ক্ষতিগ্রস্ত হয় কৃষক ও গরিব মানুষ। পরের বন্যাটি ঘটে দেশের উত্তর, মধ্য ও নিন্মাঞ্চলে। এ সময়ে মাঠে ছিল আউশ এবং সামনে ছিল আমন ফসল। আউশ ফসলের ক্ষতি হয় প্রচুর। আমনের চারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আমন বোনার কাজ হয় বিলম্বিত। এসব প্রাকৃতিক কারণে যে ফসল নষ্ট হয় তার প্রেক্ষাপটে শুরু হয় ‘স্পেকুলেশন’ (গুজব)। বাড়তে শুরু করে চালের দাম।

মুশকিল হচ্ছে, দ্রব্যমূল্য যখন বাড়তে শুরু করে তখন বাজারে বাড়ে একরকম, আর মানুষের মুখে মুখে বাড়ে অন্যরকম। চালের মূল্যবৃদ্ধিতেও ঘটছে এটা। চাল কত রকমের তার সঠিক হিসাব কেউ আমরা জানি না। একেক ধরনের চালের দাম একেক অঞ্চলে একেক রকম। আবার মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবও একেক শ্রেণীর মানুষের ওপর একেক রকম। কিন্তু সত্যি কথা হচ্ছে, চালের দাম ঊর্ধ্বমুখী। মাঝখানে কয়েকদিন একটু থেমে ছিল। কিন্তু গত কয়েকদিনে তা আবার অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে পবিত্র ঈদুল আজহার ছুটির কথা। এই ঈদে দোকানপাট ও সরবরাহ বেশ কিছুদিন বন্ধ থাকে। দ্বিতীয়ত, বলা হচ্ছে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের কথা- যার কারণে চালের চাহিদা আরও বাড়বে। তৃতীয় কারণ একটা গুজব- ভারত চাল রফতানি করবে না। আবার বার্মা (মিয়ানমার) থেকে চাল আনা হবে, এতে কারও কারও আপত্তি। কারণ তাদের সঙ্গে কূটনৈতিক যুদ্ধ চলছে। এ অবস্থায় কী করে তাদের কাছ থেকে চাল আনি? মোটকথা, এসবই এই মুহূর্তের কারণ।

তবে আমার মতে, চালের মূল্যবৃদ্ধির মূল কারণ সরকারি গুদামে চালের ঘাটতি। সাধারণত সরকারের হাতে ৮-৯ লাখ টন চাল থাকে। এবার আছে এর তিন ভাগের এক ভাগ। বেসরকারি খাতে ব্যবসায়ীদের হাতে যে চাল থাকে তার হিসাব সরকারের রাখার কথা। জানা যাচ্ছে, সেই হিসাব সরকারের হাতে নেই। সরকার বলছে তার হাতে চাল আছে, গমও আছে। ১৫-২০ লাখ টন চাল ও গম আমদানি হচ্ছে। সরকার চাল আমদানি সহজতর ও লাভজনক করার জন্য চালের ওপর শুল্ক হ্রাস করেছে। বেসরকারি খাত চালের ঋণপত্র খুলছে প্রতিদিন। শুধু নগদ এলসি নয়, বাকিতে অর্থাৎ ‘ডেফার্ড পেমেন্ট’ ভিত্তিতেও চাল আমদানির সুযোগ দেয়া হয়েছে। বস্তুত প্রতিদিনই চাল বাংলাদেশে ঢুকছে। এর সুফলও আমরা পাচ্ছি। কিন্তু সরকারি দুটো কার্যক্রম অনুপস্থিত দেখে লোভাতুর ব্যবসায়ী এবং ‘দেশপ্রেমিক’ চাল ব্যবসায়ী, চালকলের মালিক, চাতালের মালিকরা সুযোগ নিচ্ছে। সরকার দুর্যোগের সময় সাধারণত খোলা বাজারে চাল বিক্রি করে (ওএমএস)। এ ছাড়া ৪০-৫০ লাখ হতদরিদ্রকে ১০ টাকা কেজি দরে চাল দেয়। আবার ১৫ টাকা কেজি দরে চাল দেয় শহরাঞ্চলের দরিদ্রদের। যে কোনো কারণেই হোক, এসব কার্যক্রম এখন পর্যন্ত চালু হয়নি। মন্ত্রী বলেছেন, ২০ তারিখ থেকে চালু হবে। এই বিলম্বের সুযোগটা নিচ্ছে ব্যবসায়ী নামক কুষ্মাণ্ডরা। তারা নানা অজুহাত দেখিয়ে প্রতিদিন চালের দাম বাড়াচ্ছে। এই বর্ধিত দাম যদি কৃষক-উৎপাদকরা পেত তাহলে একটা কথা ছিল। কিন্তু পাচ্ছে চাতাল মালিক এবং বড় বড় পাইকাররা।

এটা সব সময়ই হয়। তখন বন্ধ থাকে সরকারি সরবরাহ। কারণ এ কথা প্রমাণিত যে, ‘চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী’। আমাদের ব্যবসায়ীদের তোয়াজ করে, অনুরোধ করে কিছু করানো যাবে না। তাদের এখন ‘মালপানি’ কামাই করার সময়। আবার পুলিশ-মিলিটারি দিয়ে তাদের শায়েস্তা করেও কিছু ফলোদয় হবে না, অতীতেও কখনও হয়নি। দেখলাম বাণিজ্যমন্ত্রী চাল ব্যবসায়ীদের সাবধান করে দিচ্ছেন। কিছু লাভ হবে না। যেটা দরকার তা হচ্ছে, জরুরি ভিত্তিতে খোলাবাজারে চাল বিক্রির ব্যবস্থা করা। এটাই মোক্ষম ওষুধ। বাজারকে বাজারি নীতিতে চালাতে হবে। আর দরকার বিশেষ চাল প্রদান কর্মসূচির কাজ শুরু করা। বোঝাই যাচ্ছে হয় সরকারের প্রস্তুতির অভাব রয়েছে এ ক্ষেত্রে অথবা চাল স্টকে নেই। যদি তাই সত্যি হয়, তাহলে যে চালের এলসি খোলা হয়েছে সেই চাল যাতে অবিলম্বে দেশে ঢোকে তার ব্যবস্থা করা। আমাদের বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ীরা এসব ব্যাপারে দক্ষ। তাদের উৎসাহিত করা হোক। ব্যাংকগুলোকে কাজে লাগানো হোক। তারা আমদানির কাজটি মনিটরিং করুক। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেখুক চালের বিপরীতে কী পরিমাণ ঋণ দেয়া আছে। ওই ঋণ যাতে নিয়মিত শোধ হয় তার ব্যবস্থা করা দরকার। ওই সব ঋণ তদারকি করা হোক যাতে ঋণের টাকায় চাতাল মালিকরা চাল ধরে রাখতে না পারে।

স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে, সমগ্র বিষয়টাতে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের গাফিলতি কাজ করেছে। অপরিকল্পিতভাবে স্টক থেকে চাল খরচ করা, সেই অনুপাতে গুদামে চাল ভর্তি না করা, আমদানির হিসাব না রাখা, চাতাল মালিকদের হাতে কত চাল আছে তার হিসাব না রাখা, চাল সংগ্রহে সম্পূর্ণ ব্যর্থতা, চালের সংগ্রহ মূল্য নির্ধারণে ভুল করা ইত্যাদি নানা গুরুতর অভিযোগ উঠেছে তাদের বিরুদ্ধে। এ অবস্থায় ওই মন্ত্রণালয়ের জবাবদিহিতা দরকার।

আমি মনে করি, এখন আমাদের একটা ক্রান্তিকাল যাচ্ছে। চালের অভাব একটা সমস্যা, তবে জটিল সমস্যা। রাজস্বের অভাব রয়েছে, ভ্যাট আইন কার্যকর না হওয়ায় রাজস্বের অভাব আরও বেড়েছে। কৃষকদের এখন দরকার নতুন ঋণ, পুরনো ঋণ পরিশোধ বন্ধ রাখা। আমন ফসল যাতে নির্বিঘেœ ওঠে তার প্রতি লক্ষ্য রাখা। যেসব রাস্তাঘাট, পুল-ব্রিজ, কালভার্ট নষ্ট হয়েছে, তা মেরামতের ব্যবস্থা করা। এই জরুরি কাজে শীর্ষ পর্যায় থেকে ‘মনিটরিং’ দরকার। আর ভবিষ্যতের জন্য একটা কথা বলা দরকার। কৃষির উৎপাদনশীলতা কমছে। জমির পরিমাণ কমছে। সেচের জলের অভাব ঘটছে। ফসলি জমির উর্বরতা হ্রাস পাচ্ছে কৃত্রিম সার ব্যবহারের কারণে। জমির ‘টপ সয়েল’ বালিতে পরিণত হতে পারে কিনা তা ভেবে দেখা দরকার। এর প্রতিষেধক হল প্রাকৃতিক সার, যা আসে পশু, গাছপালা থেকে। এসব খাতেও সমস্যা দেখা দিচ্ছে। একরপ্রতি যত গরু দরকার, গাছ দরকার তা আছে কিনা পরীক্ষা করে দেখা দরকার। আত্মপ্রসাদ লাভের কোনো সুযোগ নেই। বিষয়টি চাল সম্পর্কিত। বাঁচা-মরার ইস্যু।

ড. আর এম দেবনাথ : অর্থনীতি বিশ্লেষক; সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

rmdebnath@yahoo.com

https://www.jugantor.com/sub-editorial/2017/09/16/155975