১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭, শনিবার, ৮:২৪

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ধন্যবাদ

আত্মপক্ষ

এবনে গোলাম সামাদ

১৯৯১ সালে খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় আরাকান (রাখাইন প্রে) থেকে কক্সবাজারে প্রথম ২,৫০,০০০ রোহিঙ্গা শরণার্থী কক্সবাজারে আসে। তাদের আশ্রয় দেয়ার জন্য জাতিসঙ্ঘ এবং বাংলাদেশের পক্ষ থেকে খোলা হয় আশ্রয়শিবির। ১৯৯৪ সালে তদানীন্তন মিয়ানমার সরকার শরণার্থীদের ফিরিয়ে নিতে রাজি হয়। কিন্তু কিছু রোহিঙ্গা ফিরতে পারলেও বেশির ভাগ রোহিঙ্গা ফিরতে পারেননি। যারা ভাবছেন, আলোচনার মাধ্যমে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হতে পারবে, তারা আমার মনে হয় এই ইতিহাস স্মরণ করছেন না।

বর্তমানে রোহিঙ্গা সমস্যা আরো প্রবল আকার ধারণ করেছে। আর এটা সৃষ্টি হতে পেরেছে মিয়ানমারের মূল ভূখণ্ড থেকে পাঠানো মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ভয়াবহ অত্যাচারের কারণে। অনেক মিথ্যা কথা প্রচার করা হচ্ছে মিয়ানমার কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে। মিয়ানমার সরকার বলছে, যাদের উল্লেখ করা হচ্ছে রোহিঙ্গা মুসলমান, তারা নাকি অতি সম্প্রতি বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিভাগ থেকে আরাকানে যাওয়া ব্যক্তি; কিন্তু আমরা দেখছি রোহিঙ্গা মায়েরা সন্তান কোলে আসছেন। এই শিশু সন্তানরা নিশ্চয় চট্টগ্রাম বিভাগ থেকে আরাকানে যায়নি। নিশ্চয় এরা জন্মেছে আরাকানে। আর তাই জন্মসূত্রেই এদের বলতে হয় আরাকানি। কিন্তু মিয়ানমার সরকার এদেরও বলছে রাষ্ট্রবিহীন মানুষ। যেটা আন্তর্জাতিক আইনে বলা যায় না। ব্রিটিশ শাসনামলে ১৯২৩ সালে যে আদমশুমারি হয়, তাতে দেখা যায় যে, আরাকানের জনসমষ্টির শতকরা ৩৬ ভাগ মুসলমান। এ থেকে অবাধেই অনুমান করা চলে যে, চট্টগ্রাম বিভাগ থেকে আরাকানে বাংলাভাষী মুসলমান যাওয়ার যে কথা মিয়ানমার সরকার বলছে, তা সত্য নয়।

বাংলাভাষী মুসলমান সেখানে অনেক আগে থেকেই আছেন। তারা হঠাৎ যাওয়া নয়। আমরা ইতিহাসে দেখি আরাকানের রাজারা একসময় ছিলেন বাংলার সুলতানদের সামন্ত। আরাকান একটা পৃথক স্বাধীন রাজ্য ছিল না। সর্বোপরি তা ছিল না বর্তমান মিয়ানমারের কোনো অংশ। মিয়ানমার সরকার এখন চাচ্ছে এই সমগ্র ইতিহাসকেই অস্বীকার করতে। মিয়ানমারের সৈন্যরা নিরস্ত্র বেসামরিক জনসমষ্টির ওপর যে ভয়াবহ অত্যাচার চালাচ্ছে তাকে বলতে হবে যুদ্ধাপরাধ, জেনেভা কনভেনশন অনুসারে। মিয়ানমার যেভাবে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বাংলাদেশে ঠেলে দিচ্ছে, তাকে বলতে হবে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে মিয়ানমারের অঘোষিত যুদ্ধ। একে রোধ করতে হবে পাল্টা সামরিক ব্যবস্থার মাধ্যমে। অন্য কোনোভাবে এর কোনো সমাধান আসতে পারে বলে আর মনে হচ্ছে না। কেননা সমস্যাটা সৃষ্টি হতে পেরেছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর আন্তর্জাতিক নিয়ম লঙ্ঘনের ফলে। তাই সমস্যাটা হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রধানত সামরিক। এই সমস্যাকে আর বিবেচনা করা চলে না আর কোনো রাজনৈতিক সমস্যা হিসেবে। আমাদের দেশে অনেকে অং সান সু চির কঠোর সমালোচনা করছে। কিন্তু যেটা বোঝা দরকার, তা হলো মিয়ানমার এখনো চলছে সেনা শাসনে। সু চির এখানে কিছু করার বাস্তব ক্ষমতা নয়। মিয়ানমারের সামরিকবাহিনী পরে যারা দেশটিকে নিয়ন্ত্রণ করছেন, তারা হলেন থেরাবাদী বৌদ্ধভিক্ষু। এরা হলেন খুবই ধর্মান্ধ। আজকের মিয়ানমারের রাষ্ট্রধর্ম হলো থেরাবাদী বৌদ্ধধর্ম। সেনাশক্তি ও ধর্মীয় উন্মাদনা একত্রে সৃষ্টি করতে পারছে আরাকানে রোহিঙ্গা মুসলিম নির্যাতন। বল প্রয়োগের বিপক্ষে বল প্রয়োগ ছাড়া এর কোনো বিহিত হতেই পারে না।

পৃথিবীর রাজনীতি এখনো নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে বল প্রয়োগের ভিত্তিতে। ক’দিন আগে আমরা দেখলাম হিমালয় সীমান্তে দোকলাম বা দাংলাং নিয়ে চীন-ভারত যুদ্ধ বাধার অবস্থার সৃষ্টি হতে। চীন সামরিক দিক থেকে কড়া হতে পারার ফলে ভারত এখন বলছে, দাংলাং নিয়ে নতুন সীমান্ত চুক্তি করার কথা। দাংলাং ভারতের জায়গা নয়। ভুটানি ভাষায় দাংলাং হলো দোকলাম। জায়গাটা ভুটানের সীমানার মধ্যে পড়লেও পড়তে পারে; কিন্তু ভারতের সীমানার মধ্যে পড়ে না। তবুও ভারত ভুটানের পক্ষ নিয়ে সেখানে পাঠিয়েছিল সৈন্য। কিন্তু এখন সে চীনের সামরিক শক্তির চাপে সৈন্য সরিয়ে নিতে যাচ্ছে। চীন যদি ভারতের তুলনায় সামরিক দিক থেকে দুর্বল, তবে এভাবে দাংলাং সমস্যার সমাধান হতে পারত না। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কেন রোহিঙ্গা সমস্যার ক্ষেত্রে মিয়ানমারকে সমর্থন দিতে চাচ্ছে, আমরা তা জানি না। কেননা রোহিঙ্গা সমস্যা ভারতের কোনো সমস্যা নয়। এটা বাংলাদেশ-মিয়ানমারের মধ্যে সমস্যা।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ধন্যবাদ। কেননা, তিনি রোহিঙ্গাদের আরাকানে থাকার দাবিকে সমর্থন দিচ্ছেন। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের নীতিকে তিনি সমর্থন দিচ্ছেন না। পশ্চিমবঙ্গ, যার নাম এখন হতে যাচ্ছে কেবলই বঙ্গ; তার জনসমষ্টি যদি বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়ায়, তবে শিলিগুড়ির ২৭ কিলোমিটার করিডোরের মধ্য দিয়ে ভারত সরকার মিয়ানমারকে কোনো সামরিক সাহায্য দিতে পারবে না। অন্য দিকে নরেন্দ্র মোদির সরকার যদি মিয়ানমার সরকারের প্রতি খুব সহানুভূতিশীল হয়ে ওঠে, তবে চীন-ভারত দ্বন্দ্বের কারণে, চীন আর আগের মতো মিয়ানমারের পক্ষ নেবে বলে মনে হয় না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশকে সহায়তা করবে বলেই মনে হচ্ছে। অন্য দিকে সমগ্র মুসলিম বিশ্ব, বিশেষ করে মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া যেভাবে বাংলাদেশের পক্ষে এসে দাঁড়াচ্ছে, তাতে বাংলাদেশের উচিত হবে শক্তির যুক্তিকে শক্তি দিয়েই মোকাবেলা করা। যুদ্ধ কাম্য নয়। কিন্তু জাতিতে জাতিতে, রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে, যুদ্ধ হচ্ছে এবং হবে।

আমরা যখন অতীতের দিকে তাকাই, তখন দেখি সুবেদার শায়েস্তা খাঁ বাদশাহ আরঙ্গজেবের নির্দেশে মগ ও পর্তুগিজ জলদস্যুদের যুদ্ধের মাধ্যমে পরাজিত করে দমন করেছিলেন। পর্তুগিজ ও মগেরা চট্টগ্রাম ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল ১৬৬৬ খ্রিষ্টাব্দে। সুবেদার শায়েস্তা খাঁ যুদ্ধ জয়ের পর চট্টগ্রাম শহর ও বন্দরের নতুন নাম রেখেছিলেন ইসলামাবাদ। অতীতে যুদ্ধ ছাড়া এই অঞ্চলে শান্তি স্থাপিত হতে পারেনি। আমার মনে হয় এখন আরাকানেও পারবে না। আরাকান রাজসভায় খ্রিষ্ট্রীয় সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে একাধিক মুসলমান বাংলাভাষী কবির কদর হয়েছিল। এদের মধ্যে দৌলত কাজী ও আলাওল বিশেষ প্রসিদ্ধ হয়ে আছেন। দৌলত কাজী সতী ময়নামতি কাব্যের প্রস্তাবনায় লিখেছেন :
কর্নফুলী নদী পূর্বে আছে এক পুরী।
রোসাঙ্গ নগরী নাম স্বর্গ-অবতারী॥
তাহাতে মগধ বংশ ক্রমে বুদ্ধাচার।
নাম শ্রী সুধর্ম রাজা ধর্মে অবতার॥
প্রতাপে প্রভাত ভানু বিখ্যাত ভুবন।
পুত্রের সমান করে প্রজার পালন॥
এখানে লক্ষ করলে দেখা যায় যে, দৌলত কাজী বলছেন, সুধর্মা হচ্ছেন মগধ বংশের রাজা। তিনি বলছেন না, সুধর্মা হচ্ছেন কোনো আরাকানি রাজবংশের রাজা। অতীতে মগধ বলতে বোঝাত বর্তমান বিহারের দক্ষিণ ভাগকে। মগ বলতে ঠিক কাদের বোঝানো হতো, তা নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। অনেকের মতে, মগ শব্দের উদ্ভব হয়েছে প্রাচীন মগধের নাম থেকে। চট্টগ্রামের একদল লোককে বলা হয় বড়–য়া মগ। এরা দাবি করেন যে, এদের পূর্বপুরুষ চট্টগ্রাম অঞ্চলে এসেছিলেন মগধ থেকে। আরাকানে একসময় মগধ থেকে আসা রাজবংশ রাজত্ব করেছেন, এ রকম কথা অনেকেই বলেন। তাদের মতে মগ কথাটার উদ্ভব হতে পেরেছে মগধ থেকে। অন্য দিকে অনেকের মতে মগ কথাটা উদ্ভব হয়েছে ‘মঙ’ শব্দ থেকে। মঙ বলতে বোঝাত, বর্তমান মিয়ানমারের অধিবাসীদের। এরা ছিল খুবই দুর্দান্ত ও ভয়ঙ্কর প্রকৃতির। অতীতে আরাকানে এসে একদল মঙ বসবাস শুরু করে। তারাই পুর্তুগিজ জলদস্যুদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বাংলাদেশে সৃষ্টি করেছিল বিরাট অরাজক অবস্থা, যা এখনো স্মৃতি হয়ে আছে ‘মগেরমুল্লুক’ হিসেবে। মগেরমুল্লুক বলতে বোঝায় অরাজক দেশ। আসলে মিয়ানমারের মূল ভূখণ্ড থেকে আগত ম্রনমা সৈন্যরা আরাকানে বিরাট অরাজকতা সৃষ্টি করেছে। এটা আমাদের উপলব্ধিতে থাকা দরকার। হ
লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/252055