১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭, শনিবার, ৮:২৩

খাদ্য ঘাটতি : সরকার সময় থাকতে সাবধান হয়নি

আশিকুল হামিদ : চমৎকার কিছু কথা শুনিয়েছেন সরকারের দু’জন বিশিষ্ট মন্ত্রী। একজন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, দ্বিতীয়জন খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম। সরকারের ব্যর্থতা এবং দলীয় লোকজনের প্রতি বিশেষ আনুকূল্যের পরিণতিতে চালের দাম যখন লাফিয়ে বাড়ছে এবং দেশের সম্পূর্ণ চালের বাজার যখন ব্যবসায়ী নামের টাউট এবং অতি মুনাফাখোর একটি গোষ্ঠী দখল করে নিয়েছে, তেমন এক কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও মন্ত্রীদ্বয় বলে বসেছেন, ব্যবসায়ী ও সাংবাদিকদের ‘দোষে’ই নাকি চালের দাম বেড়েছে! নিজেদের বক্তব্যের পক্ষে যুক্তি দেখাতে গিয়ে ১৪ সেপ্টেম্বর দুই মন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেছেন, ব্যবসায়ীরা নাকি স্বাক্ষরবিহীন একটি চিঠি দেখিয়ে প্রচার করেছে ভারত বাংলাদেশে চাল রফতানি করবে না। টেলিভিশনসহ সংবাদপত্রগুলোও নাকি কোনোরকম যাচাই-বাছাই ছাড়া বানোয়াট সে চিঠির ভিত্তিতেই ভারতের রফতানি না করা সংক্রান্ত খবর প্রচার করেছে এবং তার ফলেই নাকি চালের দাম বেড়ে গেছে! মন্ত্রীরা প্রসঙ্গক্রমে জানিয়েছেন, রফতানির জন্য ভারতের হাতে এক কোটি টনেরও বেশি চাল রয়েছে এবং বড় কথা, ভারত চাল রফতানি বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়নি! কথাগুলো শুনতে মন্দ না হলেও বাস্তব পরিস্থিতি কিন্তু দুই মন্ত্রীকে সমর্থন করে না। তারা যেহেতু ভারতের মন্ত্রী নন সেহেতু রফতানির জন্য দেশটির মজুদের পরিমাণ সম্পর্কে বলার কোনো অধিকারও তাদের থাকতে পারে না। তাছাড়া ভারতের রফতানি বিষয়ক খবর নিয়ে প্রকাশ্যেই আলোচনা চলছে বেশ কিছুদিন ধরে।

মন্ত্রীদ্বয় যদি প্রাথমিক দিনগুলোতেই ‘সত্য’ কথাটা জানিয়ে দিতেন তাহলে হয়তো চালের দাম নাও বাড়তে পারতো। কিন্তু সত্য জানানোর সে দায়িত্ব তারা যথাসময়ে পালন করেননি। এই না করার কারণ হিসেবে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের আলোচনায় বলা হচ্ছে, চালের দাম যারা যথেচ্ছভাবে বাড়িয়ে চলেছে তারা ‘আওয়ামী সিন্ডিকেট’ নামে পরিচিত। সে কারণেই সম্ভবত মন্ত্রীরা নীরবতা অবলম্বন করেছেন! আর এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে ‘আওয়ামী সিন্ডিকেট’-এর লোকজন যে হারে ও যেভাবে ইচ্ছা সে হারে ও সেভাবেই চালের দাম বাড়িয়ে চলেছে। গণমাধ্যমের রিপোর্টে জানানো হয়েছে, গত ১২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মাত্র পাঁচ দিনেই ৫০ কেজির প্রতি বস্তা চালের দাম ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা বেড়ে গেছে। সে হিসাবে চাল ভেদে প্রতি কেজির দাম বেড়েছে ৬ টাকা পর্যন্ত। দাম শুধু বাড়ছে না, খুচরা বিক্রেতারা জানিয়েছেন, দাম বাড়ার এই প্রবণতা থেমে যাওয়ার তথা দাম কমার কোনো সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। দাম বরং ক্রমাগত বাড়তেই থাকবে। কারণ, সবকিছুর পেছনে রয়েছে ‘আওয়ামী সিন্ডিকেট’ এবং তার পেছনে রয়েছে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা। মাত্র মাস কয়েক আগেই সরকারের কোন মন্ত্রী সুদূর ব্রাজিল থেকে পচা ও নষ্ট গম আমদানি করে আলোচিত ও নিন্দিত হয়েছিলেন, তার নাম ধরেও আলোচনা যথেষ্টই হচ্ছে। সুতরাং অমন কোনো মন্ত্রী যদি সাংবাদিকদের ঘাড়ে সব ‘দোষ’ চাপানোর চেষ্টা করেন তাহলে আর যা-ই হোক সরকারের পক্ষে রেহাই পাওয়ার সুযোগ তৈরি হবে না।

হঠাৎ চালের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণ জানাতে গিয়ে বাজারের খুচরা ব্যবসায়ীসহ তথ্যাভিজ্ঞরা আরো অনেক কথাই বলেছেন। সেদিকে যাওয়ার পরিবর্তে বলা দরকার, কিছুদিন ধরে সাধারণ মানুষের মুখে মুখে আবারও দুর্ভিক্ষের কথা উচ্চারিত হচ্ছে। বেশি বয়সীরা ১৯৭৪ সালের কথাও স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন- যে বছরের দুর্ভিক্ষে কয়েক লাখ মানুষ অনাহারে মারা গিয়েছিল। আজকের নিবন্ধে ওই দুর্ভিক্ষ সম্পর্কে কিঞ্চিত আলোচনা করার ইচ্ছা রয়েছে। তার আগে মাত্র কিছুদিন আগের একটি অভিজ্ঞতার কথা শোনানো যাক। এই অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট অভ্যুত্থানে নিহত রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের একটি সাক্ষাৎকার দেখে। এবারের আগস্ট মাসেও যথারীতি মরহুম নেতাকে নিয়ে যথেষ্ট প্রচারণা চালানো হয়েছে। সে প্রচারণার অংশ হিসেবেই বাংলাদেশ টেলিভিশন কয়েকদিন ধরে তার একটি সাক্ষাৎকার প্রচার করেছে। আমি নিজেও সেটা দেখেছি। কিন্তু কোনো দিনই সম্পূর্ণ সাক্ষাৎকার দেখা ও শোনা হয়নি। কারণ, কবে কখন প্রচার করা হবে তা আগেভাগে জানানো হতো না। তা সত্ত্বেও যা বোঝার তা বুঝতে অসুবিধা হয়নি। মরহুম নেতা ইংরেজিতে বলছিলেন বলেই ধরে নেয়া যায়, সাক্ষাৎকারটি নিশ্চয়ই কোনো বিদেশি সাংবাদিক বা টেলিভিশনকে দিয়েছিলেন তিনি। এই সাক্ষাৎকারের একটি অংশ আমাকে মুগ্ধ করেছে, যেখানে প্রধানমন্ত্রী (নাকি রাষ্ট্রপতি?) হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমান বেশ জোরের সঙ্গেই বলেছেন, তারা ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের সত্যতা অস্বীকার করেননি। তারা বরং তখনই জানিয়েছিলেন- ১. বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ হয়েছে এবং ২. সে দুর্ভিক্ষে ২৭ হাজার মানুষ মারা গেছে।

মরহুম নেতা পুনরাবৃত্তি করে বলেছেন, তারা সত্য লুকাননি। বাংলাদেশের স্থপতি এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রধান নেতা হিসেবে যিনি সম্মানিত হয়ে এসেছেন, তার উল্লেখ করা মৃত মানুষের সংখ্যা নিয়ে কিন্তু সচেতন সকল মহলে ভিন্নমত ও বিতর্ক রয়েছে। কারণ, সে সময়ের বিভিন্ন পরিসংখ্যানে জানানো হয়েছিল, ১৯৭৪ সালের এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া ভয়াবহ দুর্ভিক্ষে ‘লাখ লাখ মানুষ’ অসহায়ভাবে মৃত্যুবরণ করেছিল। অধিকাংশেরই কাফনের কাপড় পর্যন্ত মেলেনি। এমনকি কলাপাতাও নয়। কেননা, দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের কাছে একটি কলাপাতাও তখন দুর্লভ এক খাদ্যদ্রব্যে পরিণত হয়েছিল। মানুষ কলাপাতা খেয়েও জীবন বাঁচানের চেষ্টা করেছে।... ‘আঞ্জুমান মফিদুল ইসলাম’ শুধু রাজধানী ঢাকাতেই সে সময় ২৮৬০টি বেওয়ারিশ লাশ দাফন করেছিল। মুজিব সরকারের খাদ্যমন্ত্রী আবদুল মোমিন তার স্বীকারোক্তিতে জানিয়েছিলেন, ১৯৭৪ সালের নভেম্বর মাসে সাড়ে ২৭ হাজার মানুষ ‘অনাহার ও ব্যাধির ফলে’ মৃত্যুবরণ করেছে। (দৈনিক ইত্তেফাক, ২৩ নভেম্বর, ১৯৭৪) আমরা জানি না, প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমান তার খাদ্যমন্ত্রীকে উদ্ধৃত করতে গিয়েই ‘সাড়ে’ বাদ দিয়ে শুধু ২৭ হাজার মানুষের কথা বলেছেন কি না। তিনি সম্ভবত এটাও লক্ষ্য করেননি যে, খাদ্যমন্ত্রী আবদুল মোমিনের পরিসংখ্যানে শুধু নভেম্বর মাসের কথা বলা হয়েছিল!

ইতিহাসে রেকর্ড রাখার স্বার্থে এখানে নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলতেই হবে। এপ্রিলের দিক থেকে শুরু হলেও দুর্ভিক্ষ ভয়ংকর রূপ নিয়েছিল ১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বরের দিকে। আমি তখন ঢাকা ভার্সিটির ছাত্র, খন্ডকালীন চাকরি করতাম একটি সাপ্তাহিক পত্রিকায়। এর অফিস ছিল মতিঝিলে, আদমজী কোর্টের পাশের এক ভবনের পাঁচ তলায়। এ সময়ই সারাদেশ ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের কবলে পড়েছিল। আমরাও কোনোদিন দু’ বেলার বেশি পেট ভরে খেতে পারতাম না। পাঠকদের বিশ্বাস করতে কষ্ট হতে পারে, কিন্তু কঠিন সত্য হলো, আমি নিজেও বহুদিন নারীসহ বহু মানুষের লাশের পাশ দিয়ে হেঁটে গিয়েছি। বায়তুল মোকাররমের পশ্চিম গেটের সামনে শুধু নয়, লাশ দেখেছি স্টেডিয়ামের সামনের রাস্তায়ও। রাজউক ভবনের সামনেও লাশ দেখেছি দিনের পর দিন। এ সময়ের সবচেয়ে মর্মান্তিক একটি তথ্য হলো, কয়েকদিনের মধ্যেই রাজউক এবং বঙ্গভবনের মধ্যকার রাজপথ থেকে লাশ নিয়ে ট্রাকে ওঠাতে দেখেছিলাম। লাশের সঙ্গে রাস্তার কুকুরগুলোকেও ট্রাকে তুলে নিত ‘পচ্ছিন্নতাকর্মীরা’। কুকুর ধরার জন্য বিশেষ ধরনের লোহার যন্ত্র ব্যবহার করা হতো। যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠতো কুকুরগুলো। লাশ এবং কুকুরগুলোকে ঠিক কোথায় নেয়া হতো সে কথা আজও পর্যন্ত আমি জানতে পারিনি।

বর্তমান পর্যায়ে দুর্ভিক্ষের আশংকা সৃষ্টি হয়েছে কিছু বিশেষ কারণে। সন্দেহ নেই, প্রায় তিন মাস ধরে দেশজুড়ে যে বন্যা চলছে সেটা একটি বড় কারণ। বন্যায় সারাদেশে ফসলের ক্ষেত পানিতে তলিয়ে গেছে। এর ফলে দেশের উত্তর, দক্ষিণ ও মধ্যাঞ্চলের সকল আউশ ও আমনের আবাদ অনেক কম হবে বলে আশংকা করা হচ্ছে। আউশ ও আমনের ক্ষেতের সঙ্গে তলিয়ে গেছে সবজির ক্ষেতও। দেশের বাজারে এরও অশুভ প্রভাব পড়েছে। অশুভ এই প্রভাব আরো পড়তে থাকবে। বন্যায় সবজি ও ফসলের ক্ষেত তলিয়ে যাওয়ার বিষয়টি স্বাভাবিক হলেও তথ্যাভিজ্ঞরা অন্য এক কারণে ভীত ও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। এর ঠিক পূর্ববর্তী ফসল বোরোর চাষাবাদে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি এই ভীতি ও উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। পাঠকদের নিশ্চয়ই মনে পড়বে, বোরোর চাষাবাদ ক্ষাতিগ্রস্ত হয়েছিল ভারত থেকে নেমে আসা বিষাক্ত রাসায়নিকযুক্ত পানির কারণে। ভারতের সে পানি হাওর এলাকার সব ফসল ধ্বংস করে দিয়েছিল। এর প্রভাব পড়েছিল দেশের বোরো ধানের চাষাবাদের ওপর। কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে বোরোর উৎপাদন এবার ১০ লাখ টন কম হয়েছে। খাদ্য মন্ত্রণালয় অবশ্য জানিয়েছিল, ১০ লাখ টন নয়, উৎপাদন কম হয়েছে ২০ লাখ টনের। অন্যদিকে চালকল মালিক সমিতির হিসাবে উৎপাদন কম হয়েছে আসলে ৪০ লাখ টন। উৎপাদনের প্রকৃত পরিমাণ যেটাই হোক না কেন, এই সত্য সংশ্লিষ্ট সকলেই স্বীকার করেছেন যে, এবার বোরোর উৎপাদন অনেক কম হয়েছে।
এদিকে বোরোর ঘাটতি কাটিয়ে ওঠার আগেই বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে আউশ ও আমনের সব ক্ষেত। সরকারি হিসাবে জানানো হয়েছিল, আগস্ট মাসের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত ৪০ জেলায় তলিয়ে যাওয়া জমির পরিমাণ ছয় লাখ ৫২ হাজার ৬৫৪ হেক্টর। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর আশা করেছিল, প্রতি হেক্টর জমিতে এবার সাড়ে তিন টন করে চাল উৎপাদিত হবে। সে হিসাবে তলিয়ে যাওয়া জমিতে অন্তত ২৩ লাখ টন চাল উৎপাদিত হবে বলে ধরে নেয়া হয়েছিল। অন্যদিকে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের পরিধারণ ও মূল্যায়ন ইউনিট আমন ও আউশ মিলিয়ে এক কোটি ৫৮ লাখ টন চালের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল। কিন্তু বন্যার কারণে আমন ও আউশের উৎপাদন কমপক্ষে ১০ লাখ টন কম হয়েছে বলে জানা গেছে। কৃষিবিদ ও অর্থনীতিবিদসহ বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বোরোর পরপর আমন ও আউশের উৎপাদনও বিপুল পরিমাণে কমে যাওয়ার ফলে দেশকে বড় ধরনের খাদ্য ঘাটতি কবলে পড়তে হবে। তারা এমনকি দুর্ভিক্ষেরও আশংকা করছেন।

অমন আশংকাও কিন্তু অযথা করা হচ্ছে না। একটি প্রধান কারণ হিসেবে সকলেই চালের সংকট ও বেড়ে চলা দামের কথা উল্লেখ করেছেন। তারা বলেছেন এবং একথা সত্যও যে, সরকার একাধিক দফায় আমদানি শুল্ক কমালেও দেশের বাজারে চালের দাম কমছে না। চালের দাম বরং সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরেই থাকছে। ফলে জনগণের কষ্ট বেড়ে চলেছে। বিশেষ করে বন্যায় প্লাবিত অঞ্চলগুলোতে দুর্গত মানুষের কষ্ট অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে। প্রকৃতপক্ষে শুরু হয়েছে অঘোষিত দুর্ভিক্ষ। ওদিকে শুল্ক কমানো হলেও যথেষ্ট পরিমাণে চাল আমদানি হয়নি। চালভর্তি শত শত ট্রাক আটকে রাখা হয়েছে বিভিন্ন স্থলবন্দরে। নৌপথে আমদানি করা চালও সময়মতো খালাস করা হয়নি। চাল যেতে পারেনি বাজারেও। ফলে শুল্ক কমানোর কোনো সুবিধা বা সুফলই ভোগ করার সুযোগ পাচ্ছে না জনগণ।

উল্লেখ্য, আষাঢ় ও শ্রাবণের অতি বর্ষণ এবং ভয়াবহ বন্যার পূর্বাভাষের কারণে সরকার এবার বেসরকারি খাতে চাল আমদানিকে উৎসাহিত করার উদ্দেশ্যে আমদানি শুল্ক কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। জুন মাস পর্যন্ত এই শুল্ক ছিল ২৮ শতাংশ। কিন্তু জুলাই মাসে সরকার এক ধাপেই ১৮ শতাংশ কমিয়ে শুল্ক ১০ শতাংশে নামিয়ে এনেছিল। অন্যদিকে এত বিরাট সুবিধা দেয়ার পরও চাল আমদানির ক্ষেত্রে অগ্রগতি লক্ষ্য করা যায়নি। সে কারণে পরের মাস আগস্টে এসে সরকার আরো একবার শুল্ক কমিয়েছিল। আট শতাংশ কমানোর ফলে শুল্ক হার হয়েছিল মাত্র দুই শতাংশ। কিন্তু মাত্র এক মাসের ব্যবধানে শুল্ক হার ২৮ থেকে দুই শতাংশে নামিয়ে আনার পরও এর কোনো শুভ প্রভাব চালের বাজারে পড়েনি। অথচ আগস্টের তৃতীয় সপ্তাহের খবরে জানানো হয়েছিল, সীমান্তের বিভিন্ন বন্দরে দিনের পর দিন ধরে আটকে থাকা কয়েক হাজার ট্রাকের চাল যদি বাংলাদেশে ঢুকতে পারে এবং সেসব চাল যদি আমদানিকারকরা সততার সঙ্গে বাজারে বিক্রির ব্যবস্থা করেন তাহলেই কেবল চালের দাম কমার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ, শুল্ক হার মাত্র দুই শতাংশে নামিয়ে আনায় এখন আর আগের মতো প্রতি কেজি চালের জন্য তাদের তিন-সাড়ে তিন টাকা বেশি গুনতে হবে না। ধারণা করা হয়েছিল, শুল্ক হার কমে যাওয়ায় আমদানিকারকরা চালের দাম কমাবেন। ফলে বাজারেও এর শুভ প্রভাব পড়বে। অন্যদিকে আগস্ট পেরিয়ে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি এসেও তেমন কোনো সম্ভাবনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। বরং প্রতি কেজিতে দাম বেড়েছে ৬ টাকা করে!

এমন অবস্থার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তথ্যাভিজ্ঞ ও রাজনৈতিক পর্যবক্ষকরা বলেছেন, আমদানি শুল্ক হার কমানোর সর্বশেষ সিদ্ধান্ত সঠিক হলেও এই সিদ্ধান্ত আরো আগেই নেয়া ও কার্যকর করা দরকার ছিল। কারণ, দেশে খাদ্যের মজুদ কমতে কমতে অত্যন্ত আশংকাজনক পর্যায়ে নেমে আসার ব্যাপারে সরকারকে জানানো হচ্ছিল কয়েক মাস ধরেই। এমনকি জুন মাসে গণমাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্টে পরিসংখ্যানসহ একথাও জানানো হয়েছিল যে, মজুদ একেবারে ‘তলানিতে’ গিয়ে ঠেকেছে এবং দেশ মারাত্মক খাদ্য ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সরকারের পক্ষ থেকে মজুদ বাড়ানোর কোনো প্রচেষ্টাই নেয়া হয়নি। সরকার এমনকি লাভজনক মূল্য দিয়ে কৃষকদের কাছ থেকে বোরো ধান সংগ্রহের জন্যও কোনো উদ্যোগ নেয়নি। সে কারণে কৃষকরা সব ধান বিক্রি করেছে গ্রামীণ মহাজন এবং মিলারদের কাছে। সীমান্ত দিয়েও পাচার হয়ে গেছে হাজার হাজার মণ ধান। এক মণ ধানও সরকারি গুদামে আসেনি।

এভাবে সব মিলিয়েই সরকারি গুদামের অবস্থা আরো খারাপ হয়েছে। জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে প্রকাশিত খবরে জানা গিয়েছিল, চালের মজুদ এক লাখ ৮০ হাজার ৯১ টনে এসে দাঁড়িয়েছে। অথচ প্রাকৃতিক দুর্যোগের দিক থেকে বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ একটি দেশ হিসেবে চিহ্নিত বাংলাদেশে কম পক্ষে ১০ লাখ টন খাদ্যের মজুদ থাকা জরুরি। অন্যদিকে চলতি বছরের একই সময়ে মজুদের পরিমাণ কমতে কমতে প্রথমে চার লাখ ৭৭ হাজার টনে নেমে এসেছিল। সরকার তখনও কোনো ব্যবস্থা না নেয়ায় পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটেছে। যার ফলে মজুদ নেমে এসেছিল মাত্র এক লাখ ৮০ হাজার টনে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল হাওর অঞ্চলের আকস্মিক বন্যা। ভারত থেকে নেমে আসা পানির ঢলে সুনামগঞ্জের ছয়টি উপজেলার সম্পূর্ণ ফসল পচে গিয়েছিল। দেশের অন্য সব এলাকাতেও বোরোর আবাদ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। তা সত্ত্বেও কৃষকদের লাভজনক মূল্য দেয়া হলে তারা সরকারের কাছে ধান বিক্রি করতে আগ্রহী হয়ে উঠতো। এর ফলে সরকারি গুদামগুলো অনেকাংশে পূর্ণ হতে পারতো। কিন্তু সরকার সেটা করেনি। ফলে গুদামে মজুদ কেবল কমেছে। একই কারণে দুর্ভিক্ষের আশংকা ব্যক্ত করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
এমন অবস্থার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে খাদ্য মজুদের জন্য সরকারের পক্ষে দায় এড়ানোর কোনো সুযোগ থাকতে পারে না। কারণ, শিল্পায়নসহ বাস্তবসম্মত বিভিন্ন পদক্ষেপের মাধ্যমে চাকরির সুযোগ সৃষ্টি এবং মানুষের আয়-রোজগার বাড়ানোর চেষ্টা চালানোর পরিবর্তে ১০ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রির পাশাপাশি কাবিখা, ওএমএস ও ভিজিএফ ধরনের এমন কিছু কর্মসূচি সরকার গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেছে, যেগুলোর কারণে খাদ্যের মজুদ শুধু কমেছেই। ধান-চাল সংগ্রহ এবং বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্যও সরকারকে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। চাল আমদানির ব্যাপারেও একই কথা সত্য। আমদানির শুল্ক হার যদি সময় থাকতে কমানো হতো তাহলেও হয়তো পরিস্থিতি এতটা ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারতো না। ওদিকে আওয়ামী সিন্ডিকেটের লোকজন সরকারের নীতি-সিদ্ধান্ত ও কার্যক্রমের সুযোগ নিয়ে যথেচ্ছভাবে চালের দাম বাড়িয়েছে। এখনো তারা দাম কমানোর ব্যাপারে মোটেও আগ্রহ দেখাচ্ছে না। তথাভিজ্ঞরা বরং আশংকা করছেন, চালের আমদানি বাড়লেও ব্যবসায়ী নামধারী আওয়ামী টাউটদের অসততা ও দুর্নীতির কারণে চালের দাম কমার তেমন সম্ভাবনা নেই। তাছাড়া আয়-রোজগারের উপায় নেই বলে মানুষের পক্ষেও চাল কিনে খাওয়া সম্ভব হবে না। একই কারণে দেশে দুর্ভিক্ষের আশংকা কেবল বাড়ছেই।
আমরা জানি না, বাংলাদেশের হতভাগ্য মানুষের জন্য আরো একটি ১৯৭৪ অপেক্ষা করছে কি না!

http://www.dailysangram.com/post/299929