১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭, শুক্রবার, ১১:০৯

চাল নিয়ে গোলকধাঁধা

হাওর অধ্যুষিত দেশের ৬ জেলায় পাহাড়ি ঢল এবং ৩২ জেলায় অকাল বন্যায় বোরো ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হওয়ায় দেশে চালের সংকট শুরু হয়। সংকট মোকাবিলায় ব্যবসায়ীদের চাল আমদানির অনুমতি দেয় সরকার। একই সঙ্গে সরকারও বিভিন্ন দেশ থেকে ‘জি-টু-জি’ পদ্ধতিতে চাল আমদানির উদ্যোগ নেয়। শুধু তাই নয় সংকট কাটাতে চালের আমদানি শুল্কও কমানো হয়। কিন্তু এতকিছুর পরও দেশের বাজারে কমেনি চালের দাম। মিল মালিকদের সিন্ডিকেটের কারণে চালের দাম বাড়ছে বলে পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতাদের অভিযোগ।

জানা গেছে, সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে চাল আমদানির কারণে মাঝে মোটা চালের দাম সামান্য কমলেও আবারো বেসামাল হয়ে পড়েছে চালের বাজার। মোটা চালের কেজি এখন ৫২ টাকা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, চালের এই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে চরম বিপাকে পড়েছেন নিম্ন আয়ের মানুষ। সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, আড়তদাররা দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। সে কারণেই খুচরা বাজারে চালের দাম বেড়েছে। আবার আড়তদাররা দাম বৃদ্ধির জন্য মিলারদের দায়ী করছেন। তারা বলছেন, মিলাররা চাল ছাড়ছে না, এ কারণে নতুন করে চালের দাম বেড়েছে।
জানা গেছে, চলতি বোরো মৌসুমে অভ্যন্তরীণভাবে ৮ লাখ টন চাল সংগ্রহের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল সরকার। ১০ই সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সংগ্রহ হয়েছে মাত্র আড়াই লাখ টন। অভ্যন্তরীণভাবে আশানুরূপ সংগ্রহ না হওয়ায় খাদ্যমন্ত্রী আন্তর্জাতিক বাজার থেকে ১০ লাখ টন চাল আমদানির লক্ষ্য নিয়ে ভিয়েতনামে গেলেও চুক্তি করতে পেরেছেন মাত্র তিন লাখ টনের। একই সঙ্গে মিয়ানমারেও ১০ লাখ টন চাল কিনতে চেয়ে আশ্বাস পেয়েছেন তিন লাখ টনের। সব মিলিয়ে ১৬ লাখ টন ধান, চাল ও গম সংগ্রহের লক্ষ্যের মধ্যে ৭৮ শতাংশই অর্জিত হয়নি। ১০ই সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ ও আমদানির মাধ্যমে ধান, চাল ও গম সংগ্রহ করা গেছে ৪ লাখ টনের কিছু বেশি। যদিও অভ্যন্তরীণ সংগ্রহ অভিযানের প্রাথমিক সময়সীমা এরই মধ্যে শেষ হয়েছে। ১০ই সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চাল ও গমের মজুত ছিল ৪ লাখ ৫৪ হাজার টন; এক বছর আগের একই সময়ে সরকারের কাছে খাদ্যশস্যের মজুত ছিল যেখানে ১০ লাখ ৮৭ হাজার টন।
জানা গেছে, ঈদের আগে থেকেই অস্থির হতে শুরু করে রাজধানীর চালের বাজার। কাওরান বাজারে মধ্যবিত্তের মিনিকেট চালের পাইকারি দর ৬০ টাকায় উঠেছে। এছাড়া নাজিরশাইল ৬৫, চিনিগুড়া ৮৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এক সপ্তাহে কেজিতে পাইকারি দামে দুই টাকা বাড়লেও খুচরা বাজারে কিছু ক্ষেত্রে ৬/৭ টাকা বেড়েছে।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেরিতে চাল আমদানির অনুমতি দেয়ার সিদ্ধান্তটি এই সংকটের জন্য দায়ী। সময় মতো শুরুতেই চাল আমদানির অনুমতি দিলে সংকট এতো ভয়াবহ হতো না। বাবুবাজার-বাদামতলী চাল আড়তদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন সরকার বলেন, আমরা অনেক আগে থেকেই চাল আমদানির সুযোগ চেয়ে সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছিলাম। ওই সময় দিলে সুফল পাওয়া যেত। কিন্তু পরে যখন শুল্ক কমিয়ে সরকার চাল আমদানির সুযোগ দিলো, ততদিনে বিভিন্ন দেশ চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। এর ফলে শুল্ক কমানোর পরও বেশি দামে চাল আমদানি করে ব্যবসায়ীরা সুবিধা করতে পারেনি।

সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত এক বছরের ব্যবধানে মোটা চালের দাম বেড়েছে ১২ শতাংশ। আর মাসিক মূল্যের ভিত্তিতে মোটা চালের দাম বেড়েছে ১.৩৭ শতাংশ। বছরভিত্তিতে টিসিবি দেখিয়েছে এক বছর আগে এ চালের কেজিপ্রতি দাম ছিল ৩২ থেকে ৩৪ টাকা। আর বাজারে বর্তমানে এ চালের দাম কেজিপ্রতি বিক্রি হচ্ছে ৪৮ থেকে ৫০ টাকা দরে। গত দশ বছরে চালের দাম কেজিতে বেড়েছে ২৫ থেকে ২৮ টাকা। মোটা চালের পাশাপাশি সরু ও মাঝারি দানার চালের দামও বেড়েছে।

টিসিবি’র তথ্য অনুযায়ী, সরু চাল কেজিপ্রতি বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৬৬ টাকা। উত্তম মানের নাজির ও মিনিকেট ৬২ থেকে ৬৬ টাকা। সাধারণ মানের নাজির ও মিনিকেট ৬০ থেকে ৬২ টাকা। পাইজাম ও লতা উত্তম মানের ৫২ থেকে ৫৫ টাকা। সাধারণমানের ৫০ থেকে ৫২ টাকা। এদিকে স্বর্ণা ও চায়না ইরি মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৪৭ থেকে ৫০ টাকায়। সংস্থাটির তথ্য মতে, সপ্তাহের ব্যবধানে সরু চালের দাম বেড়েছে ৫.৩৬ শতাংশ। এছাড়া সাধারণ মানের নাজিরশাইল ও মিনিকেট ৫.৫৬, উত্তম মানের নাজিরশাইল ও মিনিকেট ৩.৪৫, সাধারণ মানের পাইজাম ও লতা চাল ৩.১৬, উত্তম মানের পাইজাম ও লতা চাল ৪.০৮, স্বর্ণা ও চায়না ইরি চালের দাম বেড়েছে ২.২৭ শতাংশ। আর কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) গত ১০ বছরে ৫ ধরনের চালের বাজার বিশ্লেষণে দেখিয়েছে, সব ধরনের চালের দাম ১০ বছরের ব্যবধানে দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে।
অপরদিকে খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বোরো মৌসুমে সরকার মিলারদের কাছ থেকে ৮ লাখ টন চাল ও ৭ লাখ টন ধানসহ মোট ১৫ লাখ টন খাদ্যশস্য সংগ্রহের লক্ষ্য নির্ধারণ করলেও তা পাওয়া যায়নি। এরা কারসাজি করে অতিরিক্ত মুনাফার আশায় বোরো ধান ও চাল মজুত করেছে। যা এখনো পর্যন্ত ওইসব মিলারদের গুদামেই রয়েছে। এর প্রেক্ষিতে কারসাজি করে সরকারকে ধান ও চাল না দেয়া এবং অবৈধ মজুতের অভিযোগে খাদ্য মন্ত্রণালয় ১৬শ’ ডিলারকে কালো তালিকাভুক্ত করেছে। এর পরও সুরাহা হয়নি।

খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বলেন, অসৎ মিলারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। অবৈধ মজুতকৃত চালও বাজারে চলে আসবে। আর তখনই চালের সরবরাহ স্বাভাবিক হবে। চালের সরবরাহ স্বাভাবিক হলেই দামও কমবে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, চালের দাম বৃদ্ধির পেছনে মূল কলকাঠি নাড়েন চালকল মালিকরা। কারণ কৃষকের ঘর থেকে ধান চলে যাওয়ার পর ফড়িয়াদের মাধ্যমে তা যায় মিল মালিকদের হাতে। বাজারের অধিকাংশ ধান মিল মালিকদের হাতে যাওয়ার পর মিল মালিকরা সেগুলো গুদামজাত করে রেখে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে। এতে ধানের দাম বেড়ে যায়। আর ধানের দাম বাড়ানোর পর তারা চালের দামও বাড়ায়। মিল পর্যায়ে দাম বাড়ার পর পাইকারি থেকে খুচরা পর্যায়ে আসতে যত হাত বদল হয় ততবারই দাম বাড়ে। মূলত এভাবেই চালের দাম বেড়ে যাচ্ছে।

রাজধানীর পাইকারি ও খুচরা বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পাইকারি বাজারে নিম্নমানের নাজিরশাইল চালের বস্তা ২৫৫০ টাকা থেকে বেড়ে ২৬৫০ টাকা হয়েছে। আর খুচরা বাজারে ৫৪ টাকার নিম্নমানের নাজিরশাইল ৫৬ টাকা হয়েছে। উন্নতমানের নাজিরশাইল ৬২ টাকা থেকে বেড়ে ৬৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া খুচরা বাজারে স্বর্ণা চাল ৫০, পারিজা চাল ৫০ থেকে ৫২, উন্নতমানের মিনিকেট ভালো ৬৪ থেকে ৬৬, বিআর আটাশ চাল ৫০ থেকে ৫২ ও বাসমতি চাল ৭০ থেকে ৭৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। অর্থাৎ রাজধানীর পাইকারি বাজারে গত এক মাসের ব্যবধানে বস্তাপ্রতি গড়ে চালের দাম বেড়েছে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা। আর খুচরা বাজারে কেজিপ্রতি বেড়েছে ৩ থেকে ৪ টাকা।

কাওরান বাজারের চাল ব্যবসায়ী সোলেমান মিয়া বলেন, চালে সংকট আছে। তবে এই সংকটকে কাজে লাগিয়ে মজুত করে দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে মজুতদাররা। ৪০ বস্তা চালের অর্ডার দিলে ৫-৭ দিন পর ২০ থেকে ২৫ বস্তা চাল সরবরাহ করা হয়। তাদের কাছে চাল থাকলেও সময় মতো চাল সরবরাহ করে না বলে অভিযোগ করেন তিনি।
হাতিরপুল বাজারের চাল ব্যবসায়ী হারুন ব্যাপারী বলেন, মজুতদাররা আমাদের কাছে যে দামে চাল বিক্রয় করে, আমরা তার চেয়ে দু’চার টাকা বেশিতে বিক্রয় করি। মজুতদাররা দাম বাড়ালে আমাদের তো কিছু করার থাকে না। কোরবানি ঈদের পর থেকেই চালের দাম বাড়তি। আমরা চাল কিনি মোহাম্মদপরের কৃষি মার্কেট থেকে। সেখানে চালের দাম এখন বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা বেশি। যা কেজি প্রতি ৬ টাকা বেশি।
শান্তিনগর বাজারের খুচরা দোকানি আবদুর ওয়াদুদ বলেন, ঈদের পর থেকে সব ধরনের চালের দাম বেড়েছে। চাল আমদানি বন্ধ ও ব্যাপক বন্যায় চালের দাম বাড়ছে এমন নয়। আসলে সিন্ডিকেটদের অসৎ কারসাজি ও দৌরাত্ম্যই চালের দাম বৃদ্ধির প্রধান কারণ বলে মনে করেন এ ব্যবসায়ী।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=83064