১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭, শুক্রবার, ১১:০৭

৪০০ টাকার সুবিধা পেতে ঘুষ লাগে হাজার টাকা

কিডনি রোগীরা দিশেহারা

দেশে প্রতি বছর প্রায় ৪০ হাজার রোগী ক্রনিক কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়ে বীনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণ করছেন। চূড়ান্ত পর্যায়ের ক্রনিক কিডনি রোগীর সংখ্যা (যাদের ট্রান্সপ্লান্ট প্রয়োজন) প্রায় ৮ লাখ। বেঁচে থাকতে হলে এসব রোগীর সপ্তাহে দুই থেকে তিনবার ডায়ালাইসিস করাতে হয়। অধিক মুনাফা করতে ইচ্ছামতো ওষুধ ও অন্য সরঞ্জামের দাম বাড়াচ্ছে স্বার্থান্বেষী মহল। বিপুলসংখ্যক রোগীকে জিম্মি করে তারা লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। ডায়ালাইসিস ও প্রয়োজনীয় ওষুধের ব্যয় মেটাতে গিয়ে বেশিরভাগ রোগী সর্বস্বান্ত হচ্ছেন। অন্যদিকে, কিডনি ইন্সটিটিউটসহ বেশ কয়েকটি সরকারি হাসপাতালে ৪০০ টাকায় ডায়ালাইসিসের ব্যবস্থা রয়েছে। তবে অভিযোগ, সেখানে ৪০০ টাকার ডায়ালাইসিস পেতে ৫০০ থেকে এক হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়।

সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতে, এ বিপুলসংখ্যক রোগীর ডায়ালাইসিস সেবাকে লাভজনক ব্যবসায় পরিণত করেছে একটি সুবিধাবাদী মহল। সরকারি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস সেবার মূল্য কম হলেও সেখানে সব সাধারণ মানুষ সেবা পান না। অপরদিকে, বেসরকারি হাসপাতালের বিপুল ব্যয় মিটিয়ে গরিব রোগীরা দুই থেকে তিন বারের বেশি ডায়ালাইসিস করাতে পারেন না। যাদের কিছুটা সামর্থ্য রয়েছে তাদের মধ্যে ৯০ ভাগ সর্বোচ্চ তিন বছর চিকিৎসা চালানোর পর ডায়ালাইসিস বন্ধ করতে বাধ্য হন। তাদের মতে, সরকারের নজরদারির অভাব এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় গুটিকয়েক ব্যবসায়ীর কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছেন রোগীরা। অথচ কর্তৃপক্ষ একটু নজর দিলেই ডায়ালাইসিস সেবার মূল্য আরও কমানো সম্ভব। এর সুফল পাবে দেশের সাধারণ রোগীরা।

অনুসন্ধানে জানা যায়, কিডনি রোগীদের ডায়ালাইসিসে আইভি সেট ও এভি ফিস্টুলা নিডেল সেট অত্যাবশ্যক। বাংলাদেশে একমাত্র জেএমআই হসপিটাল রিকুইজিট ম্যানুফ্যাকচারিং লিমিটেড এ সেট উৎপাদন করে। এ প্রতিষ্ঠান নিডেল সেট বিক্রি করে নির্ধারিত মূল্য ২৪০ টাকায়। অথচ ভারতে রফতানি করে মাত্র ১০৩ টাকায় (১ ডলার ২৬ সেন্ট)। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানটি ১৩৭ টাকা কম মূল্যে সেটি ভারতে বিক্রি করছে। একইভাবে রক্ত বাড়াতে কিডনি বিকল রোগীদের প্রতি সপ্তাহে ০.৫ মিলি লিটারের রিকমভিন্যাট এরিথ্রোপয়েটিন ইনজেকশন নিতে হয়। যার বাজার মূল্য ২১০০ টাকা। দেশের বেশ কয়েকটি কোম্পানি এ ওষুধ উৎপাদন করলেও উৎপাদন মূল্য থেকে ৪ থেকে ৫ গুণ দামে তা বিক্রি করে থাকে। ডায়ালাইসিস চলাকালে রোগীর শিরায় একটি হেপারিন সোডিয়াম ইনজেকশন দিতে হয়। এটির দাম ৩৩০ টাকা। উৎপাদন ব্যয় অনুযায়ী এটির দাম ১৩০ টাকার বেশি হওয়া উচিত নয়। এভাবে কিডনি রোগীদের জিম্মি করে ওষুধের দাম ইচ্ছামতো বাড়িয়ে দিচ্ছে সুবিধাবাদী চক্র।

জানা গেছে, কিডনি ইন্সটিটিউটসহ বেশ কয়েকটি সরকারি হাসপাতালে ৪০০ টাকায় ডায়ালাইসিসের ব্যবস্থা রয়েছে। তবে সেখানে ৪০০ টাকার ডায়ালাইসিস পেতে ৫০০ থেকে এক হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। অন্যদিকে, বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে প্রতি সেশন হেমোডায়ালাইসিসের খরচ পড়ে ২৩০০ থেকে ৮ হাজার টাকা। একজন ক্রনিক কিডনি রোগীকে সপ্তাহে তিনবার ডায়ালাইসিস করাতে হয়। শুধু ডায়ালাইসিসে ব্যয় হয় সাড়ে ৭ হাজার থেকে ২৫ হাজার টাকা।

গণস্বাস্থ্য ডায়ালাইসিস সেন্টারে প্রতিদিন ২৫ জন অতিদরিদ্র রোগীকে বিনামূল্যে সেবা দেয়া হয়। এছাড়া ৩০০ সাধারণ রোগীর জন্য প্রতি ডায়ালাইসিস ১১০০ টাকা, ৭৫ জন মধ্যবিত্ত রোগীকে দিতে হবে ১৫০০ টাকা এবং উচ্চবিত্ত রোগীকে দিতে হয় তিন হাজার টাকা। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র সম্প্রতি এ সেবা দিতে শুরু করেছে। যেখানে প্রায় ৪০০ জন রোগীর সেবা দেয়ার ব্যবস্থা আছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, সঠিক নিয়ম মেনে একজন রোগীর কিডনি ডায়ালাইসিস করতে প্রায় ১৮০০ টাকা খরচ হয়। এরমধ্যে ফিল্টার ৬০০ টাকা, ফ্লুইড (এ ও বি) ১৮ লিটার ৫০০ টাকা, আইভি সেট এবং এভি ফিস্টুলা নিডেল সেট ২৪০ টাকা, ইনজেকশন ১৫০ টাকা, রোগীপ্রতি মেশিন ওয়াশ ৫০ টাকা, বিছানা পরিষ্কার বাবদ ৪০ টাকা এবং আনুষঙ্গিক (বিদ্যুৎ, পানি, পরিচ্ছন্নতা, কর্মচারীর বেতন) ২০০ টাকা। ডায়ালাইসিসসংক্রান্ত বেশিরভাগ অনুসঙ্গের ওপর রয়েছে ১৫ শতাংশ ভ্যাটসহ ২০ থেকে ২৬ শতাংশ ট্যাক্স। ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণ ও আনুষঙ্গিক ট্যাক্স কমানো হলে ডায়ালাইসিস ব্যয় আরও কমে আসবে।

এ প্রসঙ্গে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরউল্লাহ চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, ১৯৮২ সালের জাতীয় ওষুধ নীতি অনুসরণ করলে ডায়ালাইসিস সংক্রান্ত খরচ আরও কমিয়ে আনা সম্ভব। তিনি বলেন, ওষুধ কোম্পানিগুলো প্রতিযোগিতা করে এ সংক্রান্ত ওষুধ ও আনুষঙ্গিকের দাম বাড়ায়। দেশে উৎপাদিত রিকমভিন্যাট এরিথ্রোপয়েটিন ইনজেকশনের বাজার মূল্য ২১০০ টাকা। ১৯৮২ সালের ওষুধ নীতি অনুসরণ করা হলে ১০০ টাকা লাভসহ এর দাম হতো ৬০০ টাকা। অথচ ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ না করে দর্শকের ভূমিকা পালন করে। এছাড়া সরকার ভারতীয় প্রতিষ্ঠানকে ডায়ালাইসিস রোগীপ্রতি ১৭০০ টাকা ভুর্তকি (সাবসিডি) দিচ্ছে। এভাবে দেশের রোগীদের ভুর্তকি দিলে গণস্বাস্থ্যের মতো প্রতিষ্ঠান আরও কম খরচে এ সেবা দিতে পারবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক এবিএম ফারুক যুগান্তরকে বলেন, দাম নির্ধারণের বিষয়টি ওষুধ প্রশাসনের আওতাধীন। তাই দাম নির্ধারণের সময় তাদের উচিত যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ করা। যাতে কোম্পানি ক্ষতিগ্রস্ত না হয় এবং দেশের মানুষ সুলভে ওষুধ পেতে পারে।

এ প্রসঙ্গে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের মহাপরিচালক মো. রুহুল আমিন যুগান্তরকে বলেন, যে কোনো ওষুধ বা চিকিৎসা সরঞ্জাম উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান দেশের বাজারে তাদের পণ্য বিক্রির জন্য প্রশাসন থেকে নির্দিষ্ট মূল্য অনুমোদন করিয়ে নেয়। এটি নির্ভর করে তাদের উৎপাদন খরচ, বিপণন ইত্যাদির ওপর। কিন্তু তারা অন্য দেশে কী দামে বিক্রি করবে সেটা তাদের বিষয়। এখানে ওষুধ প্রশাসনের কোনো ভূমিকা নেই।

https://www.jugantor.com/last-page/2017/09/15/155541