১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭, শুক্রবার, ১১:০৬

চামড়ার দাম নিয়ে কারসাজি দুই কোটি গরিব বঞ্চনার শিকার

এবারের কোরবানির ঈদে পশুর চামড়া নিয়ে ব্যাপক কারসাজি হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ঈদের কয়েক দিন নানান পাঁয়তারা করে ট্যানারি মালিকেরা শেষ পর্যন্ত বাড়তি দামেই চামড়া কিনেছেন বলে জানা গেছে। অভিযোগে প্রকাশ, মাঠপর্যায় থেকে নামমাত্র মূল্যে চামড়া কিনে ব্যবসায়ীরা দুই কোটি গরিব মানুষকে তাদের পাওনা থেকে বঞ্চিত করেছেন। সরকারের নির্লিপ্ততার সুযোগে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন মধ্যস্বত্বভোগীরা। টানাহেঁচড়ার মাঝে প্রয়োজনীয় লবণ না দেয়া এবং উপযুক্ত পদ্ধতিতে সংরক্ষণ না করায় ২০ থেকে ৩০ শতাংশ চামড়া নষ্ট হয়েছে বলেও জানান সংশ্লিষ্টরা।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ঈদের আগে সংবাদ সম্মেলন করে ৫০ থেকে ৫৫ টাকা ফুট দরে চামড়া কেনার যে ঘোষণা ট্যানারি সমিতির পক্ষ থেকে দেয়া হয়েছিল তা বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগই তারা নেননি। ফলে ঈদের দিন পাড়া-মহল্লায় চামড়া কেনার মতো কোনো লোকই পাওয়া যায়নি। অনেক কোরবানিদাতা সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করে চামড়া বিক্রি করতে না পেরে শেষ পর্যন্ত এতিমখানা বা মাদরাসায় পাঠিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু ট্যানারি মালিকেরা চামড়া না কেনায় এবং পোস্টার আড়তে ক্রেতা না থাকায় তারাও নামমাত্র মূল্যে চামড়া বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন। ফলে ঈদের দিন যে চামড়া ৫০০ থেকে ৬০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে কোরবানির এক সপ্তাহ না যেতেই ট্যানারি মালিকেরা ফড়িয়াদের কাছ থেকে সে চামড়া কিনে নিচ্ছেন দ্বিগুণ দামে।
রাজধানীর রামপুরা এলাকার কোরবানিদাতা আবদুল কাইয়ুম গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, কোরবানিকৃত পশুর চামড়া বিক্রিলব্ধ টাকা কোনো সমর্থ্যবান ব্যক্তি ভোগ করতে পারেন না। কাজেই এটা গরিব-মিসকিনের হক। দেশের সব গরিব-মিসকিন যেহেতু সংগঠতি নয় সেহেতু তাদের স্বার্থ নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের। গত দুই বছর সরকার কোরবানির পশুর চামড়ার দাম নির্ধারণের বিষয়টি ব্যবসায়ীদের ওপর ছেড়ে দেয়ার পর আগের বছরের তুলনায় কম দাম ঠিক করেন তারা। আর এবার যে মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে, তা গতবারের চেয়েও কম। কিন্তু ঈদের দিন তারা কৌশল করে ঘোষিত মূল্যও দেয়নি। পরে ঠিকই ফড়িয়াদের কাছ থেকে বেশি দামে চামড়া কিনেছেন ট্যানারি মালিকেরা। এভাবে সরকারের নির্লিপ্ততার সুযোগে একশ্রেণীর ব্যবসায়ী গরিব-মিসকিনের হক আত্মসাৎ করেছেন বলে দাবি করেন তিনি।

বিভিন্নপর্যায়ের ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কোরবানির পশুর চামড়া বাসাবাড়ি থেকে আড়ত হয়ে ট্যানারি মালিকদের কাছে পৌঁছতে অন্তত পাঁচবার হাতবদল হয়। হাতবদলের বিভিন্নপর্যায়ে কারসাজির মাধ্যমে আর্থিক সুবিধা নিয়েছেন মওসুমি ব্যবসায়ী ও মধ্যস্বত্বভোগীরা। চামড়া ব্যবসায় সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাবেই এমনটি ঘটেছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। অভিযোগ রয়েছে, কোরবানির দিন ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলার প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে মাঠপর্যায়ের বেশির ভাগ চামড়া কম দামে কিনে নিয়েছেন। এ সিন্ডিকেটে যোগ দিয়েছেন বিভিন্ন ট্যানারি মালিকও। তারা দালাল-ফড়িয়ার মাধ্যমে চামড়া কিনে লবণজাত ও প্রক্রিয়াজাতকরণের উদ্দেশ্যে তা সরাসরি নিয়ে গেছেন সাভারের চামড়া শিল্পনগরীতে।

আন্তর্জাতিক বাজার পর্যালোচনায় দেখা যায়, আমাদের পাশের দেশ ভারতে বর্তমানে প্রতি বর্গফুট গরুর কাঁচা চামড়ার মূল্য প্রায় ৯০ টাকা, যা বাংলাদেশের নির্ধারিত দরের প্রায় দ্বিগুণ। অথচ দেশে চামড়ার ক্রয়মূল্য টানা তিন বছরের মতো কমিয়েছেন ট্যানারি মালিকেরা। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে করা বৈঠকে দেয়া ঘোষণা অনুযায়ী এ বছর ট্যানারি ব্যবসায়ীরা ঢাকায় প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়া কেনার কথা ৫০ থেকে ৫৫ টাকায়। ঢাকার বাইরে এ দাম নির্ধারণ করা হয় ৪০ থেকে ৪৫ টাকা। এ ছাড়া সারা দেশে খাসির চামড়া ২০ থেকে ২২ এবং বকরির চামড়া ১৫ থেকে ১৭ টাকায় সংগ্রহ করার ঘোষণা দেয়া হয় ঈদের আগে। কিন্তু ঈদের দিন চামড়ার বাজারে কৃত্রিম ক্রেতা সঙ্কট সৃষ্টি করে সুবিধাবাদীরা নামমাত্র মূল্যে চামড়া কিনে নিয়েছেন। এর মাধ্যমে মূলত দেশের দুই কোটি গরিব, মিসকিন, এতিম, অসহায় মানুষকে বঞ্চিত করা হয়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
২০১৩ সালের কথা। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি বর্গফুট প্রক্রিয়াজাত চামড়ার দাম ছিল দেড় ডলার। তথা ১২০ টাকা। তখন দেশের বাজারে প্রতি বর্গফুট কাঁচা চামড়ার দাম ছিল ৮০ থেকে ৯০ টাকা। কাঁচা চামড়ার ক্রয়মূল্য এবং প্রক্রিয়াজাত চামড়ার রফতানিমূল্যের মধ্যে পার্থক্য ছিল ৩০ থেকে ৪০ টাকা। চামড়ার কারবারি, প্রক্রিয়াজাতকারী ট্যানারি মালিক এবং রফতানিকারকেরা তখনো লাভ করবেন। আর বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে ‘এ’ গ্রেডের প্রতি বর্গফুট ফিনিশড ও ক্রাস্ট চামড়া বিক্রি হচ্ছে দুই ডলার ১০ সেন্টের ওপরে অর্থাৎ ১৬০ থেকে ১৮০ টাকায়। অথচ মাঠপর্যায় থেকে প্রতি বর্গফুট চামড়া কেনা হচ্ছে ৪০ থেকে ৪৫ টাকায়। বিভিন্ন প্রক্রিয়া শেষ করে প্রতি বর্গফুট চামড়া ফিনিশড বা ক্রাস্টপর্যায়ে আনতে খরচ হয় ৮০ থেকে ১০০ টাকা। অথচ এসব চামড়া বিদেশে রফতানি হচ্ছে উৎপাদন খরচের প্রায় দ্বিগুণ দামে। তারপরও কোরবানির ঈদে আরো কম দামে চামড়া কিনে ট্যানারি মালিকেরা গরিব মানুষের পেটে লাথি মেরেছেন বলে দাবি করেন ক্ষতিগ্রস্তরা।
ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রতি বছর ২২ কোটি বর্গফুট চামড়া পাওয়া যায়। এর মধ্যে ৬৪ দশমিক ৮৩ শতাংশ গরুর চামড়া, ৩১ দশমিক ৮২ শতাংশ ছাগলের, ২ দশমিক ২৫ শতাংশ মহিষের এবং ১ দশমিক ২ শতাংশ ভেড়ার চামড়া। এর অর্ধেকের বেশি আসে কোরবানি ঈদের সময়। তবে এবার চামড়া সংগৃহীত হয়েছে অনেক কম। এর কারণ হিসেবে ঈদের দিন কম পশু জবাই হওয়া এবং অযতœ-অবহেলায় প্রচুর চামড়া নষ্ট হওয়ার কথা জানান সংশ্লিষ্টরা।

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/251876