১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭, শুক্রবার, ১১:০৫

বেড়ে যাচ্ছে ঋণ পরিশোধ না করার প্রবণতা

৬ মাসে ২০ ব্যাংকের সুদ মওকুফ ৫০০ কোটি টাকা

ছয় মাসে চার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকসহ ২০ বাণিজ্যিক ব্যাংক সুদ মওকুফ করেছে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে চার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক করেছে ১৭০ কোটি টাকা এবং বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক করেছে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা। বাকি প্রায় ৩০ কোটি টাকার সুদ মওকুফ করেছে অন্যান্য ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের এ হিসেবে ডিসেম্বর ও মার্চ প্রান্তিকের। ব্যাংকিং খাতে সুদ মওকুফের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করার প্রবণতা কমে যাচ্ছে। এতে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বিশ্লেষকদের মতে, রাজনৈতিক প্রভাবের কারণেই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে হলমার্ক, বিসমিল্লাহ ও বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে। আর রাজনৈতিক প্রভাবেই সুদ মওকুফ করা হচ্ছে, যা ব্যাংকিং শৃঙ্খলা পরিপন্থী। ব্যাংকের সুদ মওকুফ করায় এক দিকে যেমন ব্যাংকের আয় কমে যায়, পাশাপাশি নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করেন এমন গ্রাহকদের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এতে বেড়ে যায় ঋণ পরিশোধ না করার প্রবণতা। ঋণ পরিশোধের সংস্কৃতি থেকে বের হওয়া উচিত বলে তারা মনে করেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, ৬ মাসে সবচেয়ে বেশি সুদ মওকুফ হয়েছে রূপালী ব্যাংকের প্রায় ৮৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে গত মার্চ প্রান্তিকে ৩২ কোটি ৯৫ লাখ টাকা এবং ডিসেম্বর প্রান্তিকে ছিল প্রায় ৫৪ কোটি টাকা। আর আলোচ্য ৬ মাসে সোনালী ব্যাংক সুদ মওকুফ করেছে প্রায় ৪৭ কোটি টাকা, অগ্রণী ব্যাংক প্রায় ১৬ কোটি টাকা এবং জনতা ব্যাংক প্রায় ১৬ কোটি টাকা।

বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে আলোচ্য ৬ মাসে সবচেয়ে বেশি সুদ মওকুফ করেছে যমুনা ব্যাংক প্রায় ৫৪ কোটি টাকা, পূবালী ব্যাংক প্রায় ৪৮ কোটি টাকা এবং ব্র্যাক ব্যাংক প্রায় ২৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে মার্চ প্রান্তিকেই সাড়ে ১৪ কোটি টাকা। ইসলামী ব্যাংক প্রায় ১৯ কোটি টাকা, সাউথইস্ট ব্যাংক প্রায় ১৯ কোটি ৮৪ লাখ টাকা এবং ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক ১৩ কোটি ২৩ লাখ টাকা। সব মিলে গত ৬ মাসে বেসরকারি খাতের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সুদ মওকুফ করেছে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা।

জানা গেছে, সাধারণত দু’টি ক্ষেত্রে সুদ মওকুফ করা হয়। একটি হলো, দীর্ঘ দিন ধরে যেসব ঋণ পরিশোধ করা হয় না, এককালীন পরিশোধের শর্তে ওইসব ঋণের কিছু সুদ মওকুফ করা হয়। তবে এ ক্ষেত্রে ব্যাংক যেন লোকসানের সম্মুখীন না হয়, অর্থাৎ মূল বিনিয়োগ ও ব্যয় যেন উঠে আসে সে দিকে খেয়াল রাখা হয়। অপর দিকে ঋণ পুনঃতফসিলের সময় কিছু সুদ মওকুফ করা হয়। এটা করার ফলে এক দিকে ব্যাংকের দীর্ঘ দিনের খেলাপি ঋণ আদায় হয়। এতে ওই ব্যাংকের বিনিয়োগ সক্ষমতা বেড়ে যায়। অপর দিকে আয়ও বাড়ে।

বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ঋণের সুদ মওকুফের ক্ষেত্রে যথাযথ নিয়ম অনুসরণ করা হয় না। বিশেষ করে সরকারি ব্যাংকগুলোতে রাজনৈতিক চাপ থাকে। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ব্যবসায়ীরা ঋণের সুদ মওকুফ করে নেন, যার প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ব্যাংক। কেননা, ব্যাংক আমানতকারীদের সুদ ঠিকই পরিশোধ করতে হয়েছে। কিন্তু ঋণের সুদ আদায় না হওয়ায় বেড়ে গেছে ব্যয়। শুধু সুদ মওকুফের ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক প্রভাব থাকে না, ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রেও রাজনৈতিক চাপ থাকে। যেমন, ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে গ্রাহক ব্যাংকে যে জামানত দেয়, তা যথাযথ হয় না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বন্ধকি জমি বা সম্পদ অতিমূল্যায়িত করা হয়।

চার ব্যাংকের কয়েকজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বিভিন্ন মহল থেকে চাপ আশায় সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোতে সুদ মওকুফ বেড়ে গেছে। এর ফলে ব্যাংকগুলোর আয়ও কমে যাচ্ছে।
রূপালী ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, অতীতের চেয়ে এখন ব্যবসায়ীদের রাজনৈতিক চাপ, স্বজনপ্রীতির ভিত্তিতে সরকারি এ চার ব্যাংকে সুদ মওকুফ বেড়ে গেছে। চাপও রয়েছে সুদ মওকুফ করার। এভাবে অনেকেই পার পেয়ে যাচ্ছেন। সুদ মওকুফ বেশি হওয়ায় ব্যাংকের আয়ও কমে যাচ্ছে।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/251877