১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১:২২

খুলনা ১৫০ মেগাওয়াট পিকিং পাওয়ার প্লান্ট নির্মাণে ব্যয় বেড়েছে ৮শ’৬০ কোটি টাকা

তিন বছরের প্রকল্প লেগেছে আট বছর

এক দিকে বাড়ছে বিদ্যুতের দাম অন্যদিকে বাড়ছে সরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ ব্যয়। সরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে ব্যয়। পাশাপাশি বাড়ছে প্রকল্প মেয়াদ। জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে টাকার হরিলুট চলছে। আর এ টাকা বিভিন্ন কৌশলে আদায় করা হচ্ছে গ্রাহদের নিকট থেকে। লোকসান গুণছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড আর টাকা যাচ্ছে গ্রাহকের পকেট থেকে। একারণে দফায় দফায় বাড়ানো হচ্ছে বিদ্যুতের দাম। 

সূত্র জানায়, নর্থ-ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেডের (নওপাজেকো) প্রথম দিকে বাস্তবায়িত প্রকল্পের অন্যতম খুলনা ১৫০ মেগাওয়াট পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্ট। তিন বছর মেয়াদি এ প্রকল্প আট বছরে বাস্তবায়ন করেছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) সহযোগী এ প্রতিষ্ঠান। আর এতে বেড়েছে বাস্তবায়ন ব্যয়ও। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় হয়েছে প্রাক্কলনের দ্বিগুণ।
সূত্র জানায়, স্থানীয়ভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনের মাধ্যমে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে ২০০৬ সালের সেপ্টেম্বরে খুলনা ১৫০ মেগাওয়াট পিকিং পাওয়ার প¬ান্ট নির্মাণ প্রকল্পের অনুমোদন দেয় একনেক। খুলনার খালিশপুরের গোয়ালপাড়ায় এ বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়। তবে ডিপিপি অনুমোদন হলেও প্রকল্পের অর্থায়নে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) সঙ্গে চুক্তি হয় ২০০৭ সালে। ঋণ চুক্তির শর্তানুযায়ী প্রকল্পটি পিডিবির অধীনে বাস্তবায়ন না করে নওপাজেকো গঠনের উদ্যোগ নেয়া হয়।
ডিপিপি অনুযায়ী, প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ৮০৩ কোটি ১৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে প্রকল্প সাহায্য ৪৯৩ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। বাকিটা সরকারের অর্থায়ন। এরপর ডিপিপি সংশোধন করে প্রকল্প ব্যয় প্রথমে ১ হাজার ৫৪২ কোটি ২৩ লাখ ও পরে ১ হাজার ৬৬৩ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়। সর্বশেষ সংশোধিত ডিপিপি অনুযায়ী, প্রকল্প সাহায্য বাড়িয়ে ধরা হয় ৫৬৭ কোটি ৫৮ লাখ টাকা।
প্রাথমিকভাবে ২০০৬-এর জুলাই থেকে ২০০৯ সালের জুন পর্যন্ত এ তিন বছরের মধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় নির্ধারণ করা হয়। পরবর্তীতে প্রকল্পের মেয়াদ দুই দফা বাড়ানো হয়। প্রথমবার ২০১০ সালের জুন ও পরে ২০১২ সালের জুনের মধ্যে এটি সমাপ্তের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়। এরপর ডিপিপি সংশোধন করে প্রকল্প সমাপ্তির সময়সীমা ২০১৩ সালের মার্চ পর্যন্ত বাড়ানো হয়। আর সর্বশেষ সংশোধনের পর প্রকল্পের মেয়াদ দাঁড়ায় ২০১৪ সালের জুন পর্যন্ত। ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে বাণিজ্যিকভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করে কেন্দ্রটি।
তবে নওপাজেকোর পক্ষ থেকে দাবী করা হয়, বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বৃদ্ধির ফলে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে যায়। পাশাপাশি বিভিন্ন খাতে মূল্য সমন্বয়ের কারণে ব্যয় বৃদ্ধি ও প্রকল্পের কাজের পরিধি বাড়ার কারণে ডিপিপি দ্বিতীয়বার সংশোধন করা হয়। এছাড়া বৈদেশিক অর্থায়ন প্রাপ্তিতে অনিশ্চয়তা ও দরপত্র মূল্যায়নে জটিলতার কারণে প্রকল্প বাস্তবায়নে সময় লেগেছে বেশি।
ডুয়াল ফুয়েলভিত্তিক ১৫০ মেগাওয়াট সক্ষমতার এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে গ্যাস টারবাইন স্থাপনসহ প্রকল্পের কার্যক্রমের মধ্যে উলে¬খযোগ্য হলো গ্যাস বুস্টার ক্রয়, স্টেপ আপ ট্রান্সফরমার ও ১৩২ কেভি সুইচ গিয়ারসহ যন্ত্রপাতি সংগ্রহ, ডিস্ট্রিবিউটেড কন্ট্রোল সিস্টেম, ডুয়াল ফুয়েল সাপ¬াই সিস্টেম, তিনটি তৈলাধান নির্মাণ, পাওয়ার ইভ্যাকুয়েশন ফ্যাসিলিটি, গ্যাস আরএমএস স্থাপন, ১৩২ কেভি ওভারহেড লাইন রিলোকেশন, ভবন নির্মাণ ইত্যাদি।
জানা গেছে, ১৫০ মেগাওয়াট বলা হলেও বিদ্যুৎকেন্দ্রটির রেটেড ক্যাপাসিটি ১৫৮ দশমিক ৫ মেগাওয়াট। চাহিদার ভিত্তিতে কেন্দ্রটির উৎপাদন কমানো বা বাড়ানো হয়। এখন পর্যন্ত বিদ্যুৎকেন্দ্রটির সর্বোচ্চ উৎপাদন হয়েছে ২০১৪ সালের ১২ নভেম্বরে, যার পরিমাণ ছিল ১৮১ মেগাওয়াট। তবে পিকিং পাওয়ার প¬ান্ট হলেও অতিরিক্ত বিদ্যুৎ চাহিদা মেটাতে এটি বেজলোডে চালানো হয়। ডুয়াল ফুয়েল এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রধান জ্বালানি গ্যাস আর বিকল্প জ্বালানি ডিজেল।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকল্পটির মেয়াদ তিনবার বাড়ানো হয়েছে এবং দুবার সংশোধন করা হয়েছে। অনুমোদিত সময়ের চেয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নে ১৬৬ শতাংশ বেশি সময় লেগেছে। এতে প্রকল্পের সুফল পেতে বিলম্ব হয়েছে। এছাড়া প্রথম অনুমোদিত ডিপিপির তুলনায় প্রকল্প ব্যয় বেড়েছে ১০৭ শতাংশ। ভবিষ্যতে ডিপিপি প্রণয়ন ও প্রকল্প বাস্তবায়নে সতর্কতার সুপারিশ করেছে আইএমইডি। আর বেজলোডে চালানো এ কেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ ব্যবস্থা না থাকায় ডিজেল ব্যবহার অত্যন্ত ব্যয়বহুল বলে পর্যবেক্ষণে জানিয়েছে সংস্থাটি।
সামগ্রিক বিবেচনায় বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির ব্যয় বাড়েনি বলে দাবি করে নওপাজেকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী এএম খোরশেদুল আলম এশটিন গণমাধ্যমকে বলেছেন, বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির মেয়াদ ও জ্বালানি ব্যবহারের হার বিবেচনায় নিলে প্রকৃতপক্ষে ব্যয় বাড়েনি। কারণ কেন্দ্রটির ইফিশিয়েন্সি বেশি। প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্বের অন্যতম কারণ স্থান বরাদ্দে সময়ক্ষেপণ। এছাড়া ঋণদাতা সংস্থার বিভিন্ন শর্তের কারণে দরপত্র মূল্যায়নেও দেরি হয়েছে।
সূত্র জানায়,খুলনার এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি এরই মধ্যে ২২৫ মেগাওয়াট কম্বাইন্ড সাইকেলে রূপান্তর করা হয়েছে। এতে ব্যয় হয় ৭৩১ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। এজন্য চুক্তি করা হয় ২০১৪ সালের মার্চে। বাণিজ্যিকভাবে এটির উৎপাদন শুরুহয় ২০১৬ সালের জুনে। প্রকল্পটির ঠিকাদার ছিল চীনের সাংহাই ইলেকট্রিক গ্রুপ।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. ম. তামিম বলেন, শুধু বিপিডিবি কেন, যেকোনো প্রতিষ্ঠানের কাছেই এমন দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প বাস্তবায়ন কাম্য নয়। অনেক দেশেই প্রকল্প বান্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতার আশঙ্কা দেখা দিলে তা বাতিল করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে মাঝপথেও প্রকল্প বাতিলের নজির আছে। কারণ এতে লোকসানের যে ঝুঁকি থাকে, তা বহন করার চেয়ে প্রকল্প বাতিল করা শ্রেয়। তবে এক্ষেত্রে নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্তের প্রয়োজন হয়।

http://www.dailysangram.com/post/299617-