১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১:১৯

বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত প্রতিবেদন

ব্র্যাক ব্যাংকে অনিয়মের পাহাড়

১০০ কোটি টাকার কর ফাঁকি ; অধিক মূল্যে গাড়ি কেনা ; ভুয়া বন্ধকীর মাধ্যমে ঋণ প্রদান

বেসরকারি খাতের ব্র্যাক ব্যাংকে অনিয়মের পাহাড় পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। দুই বছরে ১০০ কোটি টাকার ওপরে কর ফাঁকি, অধিক মূল্যে গাড়ি কেনা, জালিয়াতির মাধ্যমে গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা উত্তোলন, ভুয়া বন্ধকীর মাধ্যমে ঋণ প্রদান করে ব্যাংকের ক্ষতিসাধনের অভিযোগ পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক তদন্ত প্রতিবেদনে ব্র্যাক ব্যাংকে এ অনিয়মের চিত্র উঠে এসেছে। এসব অনিয়মের সাথে দায়ী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে বাংলাদেশ ব্যাংককে অবহিত করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
জানা গেছে, বাধ্যতামূলক সব ব্যাংকই এক বছরের আর্থিক চিত্র বাংলাদেশ ব্যাংককে সরবরাহ করে থাকে। ব্যাংকের সরবরাহকৃত সেই তথ্যের যথার্থ যাচাই-বাছাই করতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নির্ধারিত কিছু ব্যাংক শাখা তদন্ত করে থাকে। ব্র্যাক ব্যাংকের প্রধান শাখাসহ মোট ১৮২টি শাখা রয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক গত বছরে ব্যাংক সরবরাহকৃত আর্থিক প্রতিবেদনের ওপর প্রধান কার্যালয় ও এর ১৬টি শাখার ওপর বিশদ তদন্ত করে। এ তদন্ত প্রতিবেদন চূড়ান্ত করা হয়েছে। প্রতিবেদনে ব্র্যাক ব্যাংকের প্রায় অর্ধশতাধিক বড় অনিয়মের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এ বিস্তর অনিয়মের কয়েকটি খণ্ডচিত্র তুলে ধরা হলো।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুসারে ২০১৪ সালে আয়কর বাবদ ১৭ কোটি ১৭ লাখ ৯৯ হাজার টাকা, পরের বছর ২০১৫ সালে আয়কর বাবদ ৮২ কোটি ৮৩ লাখ ৮৪ হাজার টাকা অর্থাৎ সর্বমোট ১০০ কোটি এক লাখ ৮৩ হাজার টাকা আয়কর খাতে কম পরিশোধ করেছে ব্র্যাক ব্যাংক। এটা ১৯৮৪ সালের আয়কর অধ্যাদেশে বর্ণিত বিধিমালা ৩৫ লঙ্ঘনের মাধ্যমে সরকারের রাজস্ব নির্ধারিত সময়ে কম পরিশোধ করা হয়েছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। এটা বাংলাদেশ ব্যাংকের দৃষ্টিতেও গুরুতর অনিয়ম বলে বলা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে ফাঁকি দেয়া রাজস্ব অবিলম্বে সুদসহ সরকারের কোষাগারে জমা করে এর প্রমাণপত্র বাংলাদেশ ব্যাংকে দাখিল করতে পরামর্শ দেয়া হয়েছে। একই সাথে ভবিষ্যতে এ ধরনের অনিয়ম থেকে বিরত থাকতে ব্যাংকটিকে হুঁশিয়ারি করে দেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে ব্যাংকের কর্মকর্তাদের ব্যবহারে জন্য বাজারমূল্যের চেয়ে অধিক মূল্যে তিনটি গাড়ি কেনার প্রমাণ পাওয়া গেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ লঙ্ঘন করে দু’টি টয়োটা হ্যারিয়ার গাড়ি যার প্রতিটির মূল্য ৭৫ লাখ টাকা করে এবং একটি হন্ডা ব্র্যান্ডের গাড়ি ৪১ লাখ টাকা দিয়ে কেনা হয়েছে। নিয়মবহির্ভূতভাবে অধিক মূল্যে দু’টি হ্যারিয়ার ও একটি হন্ডা ব্র্যান্ডের গাড়ি ক্রয়ের সাথে জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে একটি নিরপেক্ষ তদন্ত পরিচালনা করে তদন্ত প্রতিবেদনের একটি কপি এবং দায়ী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করে বাংলাদেশ ব্যাংককে অবহিত করতে বলা হয়েছে।
পরিচালনা পর্ষদের তথ্য গোপন করে ৭৮ লাখ ৩৫ হাজার টাকা অধিক মূল্যে চিপ কার্ড কেনার প্রশ্নবিদ্ধ কার্যক্রম অনিয়ম বলে উল্লেখ করা হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনে অপেক্ষাকৃত অধিক মূল্যে চিপ কার্ড কেনার সাথে জড়িত কর্মকর্তাদের শনাক্ত করে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করে বাংলাদেশ ব্যাংককে অবহিত করতে বলা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিভিন্ন গ্রাহকের উপহার প্রদানের জন্য প্রায় ২৭ লাখ টাকা ব্যয়ের একটি অনুমোদন পর্ষদ থেকে গ্রহণ করে ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় গিফট ভাউচারের নামে আড়ং থেকে পণ্য ক্রয়ের সিদ্ধান্তে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিক্রি বৃদ্ধির অপকৌশল গ্রহণ করা হয়েছে। একই সাথে বাংলাদেশ ব্যাংকে কর্মরত কয়েকজন কর্মকর্তাকে অনৈতিক কার্যক্রমে যুক্ত করার অপচেষ্টা করেছে, যা গুরুতর অনিয়ম হিসেবে দেখছে বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রতিবেদনে গিফট ভাউচার সম্পর্কিত অনিয়মে জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করে বাংলাদেশ ব্যাংককে অবহিত করতে বলা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাতমসজিদ রোড শাখার ভাড়াজনিত ব্যয় সমন্বয় তথা সান্ড্রি ক্রেডিটরস ডেবিট অথরিটি সিস্টেমে থাকার সুযোগ জালিয়াতির মাধ্যমে ব্যাংক কর্মকর্তা সাহার মাধ্যমে তার স্ত্রীর হিসাবে স্থানান্তর করে সাড়ে ১৬ লাখ টাকা অত্মসাৎ করা হয়েছে। শাখায় সান্ড্রি ক্রেডিটরস ডেবিট অথরিটি সিস্টেমে কেন রাখা হয়েছে সেটির কারণ ব্যাখ্যা করতে হবে এবং এ ধরনের ত্রুটিপূর্ণ সিস্টেম আর কোনো শাখায় বা অন্য কোনো ক্ষেত্রে রাখা হয়েছে কি না এবং জালিয়াতির মাধ্যমে আত্মসাৎকৃত অর্থ উদ্ধার করে অবহিত করার জন্য ব্যাংককে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যাংকের কর্মকর্তাদের দায়িত্বে অবহেলার সুযোগে মেসার্স গ্লোব সফট ড্রিংকসের ১৯ হাজার ৪৫ মার্কিন ডলার সমপরিমাণ টাকা ক্রিসেন্ট ট্যানারিজের মালিক গোলাম খোরশেদ জালিয়াতির মাধ্যমে আত্মসাৎ করেছেন। প্রতিবেদনে জালিয়াতির অর্থ দ্রুত উদ্ধারের ব্যবস্থা করে গ্লোব সফট ড্রিংকসের পাওনা অতিসত্বর নিয়মানুগভাবে পরিশোধ করে বাংলাদেশ ব্যাংককে অবহিত করতে বলা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যাংকের গুলশান শাখার গ্রাহক ইয়াসমিন এ রহমানের ৫১ লাখ টাকা জালিয়াতির মাধ্যমে আলোচ্য শাখায় কর্মরত কর্মকর্তা তানভির হোসেন (রিলেশনশিপ অফিসার পিন নং ৪১৩০) আত্মসাৎ করেছেন। এ জন্য তানভিরের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে এর হালনাগাদ তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংককে অবহিত করতে বলা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত প্রতিবেদনে ইউনিলিভার বাংলাদেশ- এর ৩০ লাখ টাকা ব্যাংকের অ্যাসোসিয়েট ম্যানেজার সুকুমার রায় তার সেলারি অ্যাকাউন্টে জালিয়াতির মাধ্যমে স্থানান্তর করে আত্মসাৎ করার প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। একই সাথে সুকুমার রায় ইউনিলিভার বাংলাদেশ-এর আরো সাড়ে ৯৪ লাখ টাকা অন্য একটি প্রতিষ্ঠান মেসার্স নাফিসা ট্রেডার্সের হিসাবে নিয়মবহির্ভূতভাবে স্থানান্তর করে আত্মসাৎ করার প্রমাণ পাওয়া গেছে। ইউনিলিভারের এক কোটি সাড়ে ২৪ লাখ টাকা আত্মসাতের সাথে জড়িত কর্মকর্তা সুকুমার রায়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে এর হালনাগাদ তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংককে অবহিত করতে বলা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মূল দলিলে প্রকৃত মালিকের ছবি পরিবর্তন করে ভিন্ন ব্যক্তির ছবি দিয়ে ব্যাংকের অনুকূলে জমির বন্ধকী সম্পাদন, কারখানার মালিকানার তথ্যে জালিয়াতি ও গ্যারান্টরের তথ্যে জালিয়াতি করে শান্তিনগর এসএমই সেলস অ্যান্ড সার্ভিস সেন্টারে গ্রাহক মেসার্স মায়ের দোয়া গার্মেন্টস কর্তৃপক্ষকে গত বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি তিন কোটি টাকা ঋণসুবিধা প্রদান করা হয়েছে। এ ঋণসুবিধা প্রদানের সাথে ব্যাংকের জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দেয়া হয়েছে। একই সাথে ঋণসুবিধা গ্রহণকারী ব্যক্তির কোনো সম্পদ থাকলে তা জামানত হিসেবে গ্রহণ করা, বকেয়া টাকা আদায় এবং গ্রাহকের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলার সর্বশেষ অগ্রগতি নিশ্চিত করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
ব্যাংকের শান্তিনগর, এসএমই এসসি শাখায় মোহাম্মদ কিরণ মিয়ার মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান মেসার্স কিরণ সুজের অনুকূলে মেয়াদি ঋণ তিন কোটি টাকা এবং ওডি এক কোটি ৮০ লাখ টাকা ও ৫০ লাখ টাকা ঋণসুবিধা প্রদানের সময় তৃতীয়পক্ষীয় মালিকানাধীন জমি ব্যাংকের অনুকূলে জালিয়াতির মাধ্যমে বন্ধকী গ্রহণ করা হয়েছে। এ কাজে জড়িত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে হালনাগাদ তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংককে অবহিত করতে পরামর্শ দেয়া হয়েছে। একই সাথে বকেয়া ঋণ আদায়, ঋণের বিপরীতে বিকল্প জামানত (যদি থাকে) বন্ধকীর ব্যবস্থা করে বাংলাদেশ ব্যাংককে অবহিত করতে বলা হয়েছে।
এ বিষয়ে ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অ্যান্ড সিইও সেলিম আর এফ হুসেইনের কাছে বক্তব্য নেয়ার জন্য চেষ্টা করা হয়। তার মোবাইলেও কয়েক দফা ফোন করা হয়। ব্যাংকটির জনসংযোগ বিভাগের সাথেও যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু জনসংযোগ বিভাগের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, স্যার দেশের বাইরে রয়েছেন। এ কারণে এমডির বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/251594