১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১:১৬

মামলার ফাঁদে ২৯ হাজার কোটি টাকা

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিপোর্টে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের দুর্দশার চিত্র

অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে খুঁড়িয়ে চলছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো। দীর্ঘদিন ধরে টানতে হচ্ছে বিপুল অঙ্কের ঘাটতির বোঝা। কর্মকর্তাদের যোগসাজশে গণলুট হওয়া ২৯ হাজার কোটি টাকা আটকে আছে মামলার ফাঁদে। বিপুল অঙ্কের এ অর্থ আদায়ে ১৮ হাজার ১৪৮টি মামলা হলেও গত দেড় বছরে নিষ্পত্তি হয়েছে মাত্র ৫২৮টি এবং আদায় হয়েছে মাত্র ৪৩২ কোটি টাকা। ঋণগ্রহীতাদের নানা কূটকৌশলে বাকি টাকা ঝুলে আছে অর্থঋণ আদালতে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঋণগ্রহীতারা বারবার রিট করে মামলা দীর্ঘায়িত করছে। ফলে অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে অর্থ আদায়। মূলত রিটকে ঋণ পরিশোধ না করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। এ নিয়ে ব্যাংকাররা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন। একটি মামলার বিপরীতে ১০টি রিট হয়ে যাচ্ছে। ব্যাংকাররা এজন্য ঋণ আদায়ে আইন পরিবর্তনের ওপর জোর দিয়েছেন। তারা বলছেন, রিট করার আগে ঋণগ্রহীতার ঋণের অর্ধেক অর্থ পরিশোধের বিধান করা উচিত। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পর্যালোচনা প্রতিবেদন বলছে, গত জুন পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২৬ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা। এর বাইরে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর ঋণ অবলোপন আছে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। তথ্য বলছে, সবচেয়ে বড় আর্থিক ঝুঁকিতে আছে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক। গত জুন পর্যন্ত খেলাপি ঋণ ছিল ১১ হাজার ৪২১ কোটি টাকা। এটা মোট ঋণের ৩৪ দশমিক ৫০ শতাংশ। এছাড়া প্রভিশন ও মূলধন ঘাটতি তো আছেই। ব্যাংকটির এ সর্বনাশের জন্য দায়ী করা আছে বিগত দিনের পরিচালনা পর্ষদ ও এমডিদের।
তথ্য অনুযায়ী, অর্থঋণ আদালতে আটকে থাকা ২৯ হাজার কোটি টাকার মধ্যে সোনালী ব্যাংক শীর্ষে। জুন পর্যন্ত ব্যাংকটির ৩ হাজার ৮৯২টি মামলার বিপরীতে আটকা পড়েছে ১৪ হাজার ৬৭৭ কোটি টাকা। এছাড়া প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা ঋণ অবলোপনের মধ্যে গত ছয় মাসে সোনালীর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮৪৩ কোটি টাকা। কিন্তু আদায় হয়েছে মাত্র ৭৬ কোটি টাকা। এটা লক্ষ্যমাত্রার ৯ শতাংশ।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি মেটাতে বছরের পর বছর বিপুল অঙ্কের টাকা জোগান দিচ্ছে সরকার। এরই মধ্যে ৫ হাজার ২১০ কোটি টাকার জোগান দেয়া হয়েছে। এরপরও সোনালী ব্যাংকের ২ হাজার ৬১৯ কোটি টাকার মূলধন ঘাটতি রয়েছে। রূপালীর ঘাটতি রয়েছে ৭৪১ কোটি টাকা। সূত্র বলছে, গত বছরের ডিসেম্বর শেষে সোনালী ব্যাংকে লোকসানি শাখা ছিল ২৩৩টি। চলতি বছরের জুন শেষে লোকসানি শাখা হয়েছে ২৮৫টি। সে হিসাবে ছয় মাসে লোকসানি শাখা বেড়েছে ৫২টি। জানতে চাইলে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ যুগান্তরকে বলেন, খুব বেশি অগ্রগতি নেই। খেলাপি, মূলধন ঘাটতি, প্রভিশন ঘাটতি আগের অবস্থায় রয়েছে। তবে চেষ্টা করছি সংকট কাটিয়ে উঠতে। তিনি বলেন, বিপুল পরিমাণ অর্থ আটকে আছে অর্থঋণ আদালতে। বছরের পর বছর ঝুলে আছে এসব মামলা। তার মতে, একটি বিশেষ আদালত বা ট্রাইব্যুনাল গঠন করা ছাড়া এসব মামলা নিষ্পত্তি করা সম্ভব হবে না।
সূত্র জানায়, রূপালী ব্যাংকের ২৮ দশমিক ৫০ শতাংশ বা ৪ হাজার ৭৬০ কোটি টাকা ঋণখেলাপি রয়েছে। এর বাইরে অবলোপনও রয়েছে অনেক। এসব অর্থ উদ্ধারে ব্যাংকটি ২ হাজার ৮৬৬ জন মন্দ গ্রাহকের বিরুদ্ধে অর্থঋণ আদালতে মামলা করেছে। টাকার পরিমাণ ২ হাজার ৫৯৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে গত দেড় বছরে ব্যাংকটি ১৫৪টি মামলা নিষ্পত্তি করে পেয়েছে মাত্র ২৭ কোটি টাকা। এর বাইরে বিপুল পরিমাণ ঋণ অবলোপনের মধ্যে গত ছয় মাসে রূপালী ব্যাংকের আদায়ের লক্ষ্য ছিল ১০২ কোটি টাকা। কিন্তু আদায় করেছে মাত্র ৭ কোটি টাকা। এটা লক্ষ্যমাত্রার ৭ শতাংশ। রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আতাউর রহমান প্রধান যুগান্তরকে বলেন, মামলা করে টাকা আদায় করা যাবে না। কারণ একটা মামলা করলে রিট হচ্ছে ৮টি। তার মতে, ভালো গুণের চর্চা, ঋণ ফেরত দেয়ার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। সব মিলিয়ে ভেতর থেকে পরিবর্তন না হলে মামলা দিয়ে টাকা আদায় করা যাবে না। অপরাধীরা মামলায় বেশি আগ্রহী। কারণ মামলা করলে রিট করা যাবে বারবার। এতে কেটে যাবে বছরের পর বছর।

https://www.jugantor.com/first-page/2017/09/14/155311/