১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১:০৮

২৮৫ কোটি টাকা পাচার

মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির আড়ালে ভুয়া দুটি প্রতিষ্ঠানের নামে প্রায় ২৮৫ কোটি টাকা পাচার করা হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠান দুটির নাম মেসার্স হেনা এগ্রো লিমিটেড ও মেসার্স এগ্রো বিডি লিমিটেড। এর মধ্যে একটি রাজধানীর খিলক্ষেত এবং অন্যটি পুরান ঢাকার কেরানীগঞ্জে অবস্থিত বলে কাগজপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে। অস্তিত্বহীন এসব প্রতিষ্ঠান প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জালিয়াতি করে অসাধু কাস্টমস কর্মকর্তার যোগসাজশে মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে পণ্য এনেছে। পাচারকারীদের ধরতে মাঠে নেমেছেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) গোয়েন্দারা। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ খবর জানা গেছে।

গোয়েন্দা সূত্র বলছে, প্রতিষ্ঠান দুটি শিল্প স্থাপনের নামে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির ঘোষণা দিয়ে আমদানি করেছে অ্যালকোহল, সিগারেট, এলইডি টিভি, ফটোকপি মেশিন, পোশাক-পরিচ্ছদ, বাচ্চাদের খেলনা, গুঁড়া দুধ ইত্যাদি। অর্থাৎ এক পণ্যের নাম করে অন্য পণ্য আনা হয়েছে। চীন থেকে ৯০টি কনটেইনারে এসব পণ্য আনা হয়। শুল্ক কর্তৃপক্ষ ধারণা করছে, মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে আনা ওইসব পণ্যের আনুমানিক মূল্য প্রায় এক হাজার কোটি টাকা। সূত্র বলেছে, ওই পরিমাণ পণ্য আমদানির বিপরীতে ওভার ইনভয়েসের (অতি মূল্যায়িত) মাধ্যমে ২৮৫ কোটি টাকা দেশ থেকে পাচার করা হয়েছে। পাচারের সঙ্গে জড়িতদের শনাক্তের চেষ্টা চলছে। দোষীদের বিচারের আওতায় আনা হবে। এ বছরের মার্চ থেকে এপ্রিলের মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ওইসব পণ্য খালাস হয়। বর্তমান কাস্টমস আইনে মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে পণ্য আমদানি করা মানি লন্ডারিং আইন লঙ্ঘনের শামিল। এ অপরাধে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে জেল-জরিমানার বিধান রয়েছে।

তদন্ত সূত্র জানায়, রাজধানীর খিলক্ষেতের ডমুনীতে একটি এক্সেসরিজ ফ্যাক্টরি
স্থাপন করা হবে বলে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য এলসি খোলে অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠান মেসার্স হেনা এগ্রো লিমিটেড। গোয়েন্দা কর্তৃপক্ষ পণ্য খালাসের সময় পরীক্ষা করে দেখেছে কনটেইনারের ভেতরে মেশিনারিজের পরিবর্তে এলইডি টিভি, অ্যালকোহল, হার্ডবোর্ড, ফটোকপি মেশিনসহ অন্যান্য পণ্য রয়েছে। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা সরেজমিন পরিদর্শন করে দেখেছেন ডুমনীতে এ ধরনের কোনো শিল্প নেই। সূত্র জানায়, এলসি বা ঋণপত্র খোলার সময় ফ্যাক্টরি মালিকের নাম উল্লেখ করা হয় আবদুল মোতালেব। আসলে ওই নামে নির্দিষ্ট ঠিকানায় কেউ নেই। পুরানা পল্টনের আইএফআইসি ব্যাংক শাখায় এ ঋণপত্র খোলা হয়।

অভিযুক্ত অন্য প্রতিষ্ঠানটির ঠিকানা উল্লেখ করা হয় বুড়িগঙ্গা নদীর ওপারে কেরানীগঞ্জ। খোরশেদ আলম নামে ওই ব্যক্তি স্টিল ফ্যাক্টরি স্থাপনের কথা বলে যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য এলসি খুলেছেন। কনটেইনারের ভেতরে পাওয়া গেছে বাচ্চাদের খেলনা, পোশাক-পরিচ্ছদ, হার্ডবোর্ডসহ অন্যান্য পণ্য। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, ভ্যাট রেজিস্ট্রেশন, প্রতিষ্ঠান দুটির নাম-ঠিকানা, আমদানির জন্য প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টসহ সবকিছুই ভুয়া বলে প্রমাণ পেয়েছেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। এ প্রক্রিয়ায় কাস্টমস কর্মকর্তাদের যোগসাজশ আছে বলে মনে করেন গোয়েন্দারা। কারণ এসব পণ্য খালাসের সময় স্ক্যানিং করার কথা থাকলেও তা করা হয়নি। এ ছাড়া কনটেইনার খুলে পণ্য পরীক্ষা করা হয়নি। সূত্র বলেছে, পণ্যভর্তি ৯০ কনটেইনারের মধ্যে ১২টি পরীক্ষা করা হয়। বাকিগুলো পর্যায়ক্রমে খুলে দেখা হবে।

এনবিআর সূত্র বলেছে, সাধারণত শূন্য শুল্ক বা যেসব পণ্যে শুল্কের হার কম থাকে সেসব পণ্য আমদানিতে মিথ্যা ঘোষণা দেওয়া হয় বেশি। বর্তমানে শিল্পে ব্যবহৃত ক্যাপিটাল মেশিনারিজ বা মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি শুল্ক শূন্য থেকে দুই শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে বলেছে, সম্প্রতি মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি অনেক বেড়েছে। গত অর্থবছরে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি আগের বছরের তুলনায় ৪৫ শতাংশ বেড়েছে। গত অর্থবছরে ৫ বিলিয়ন বা ৫০০ কোটি ডলার মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি হয়। এনবিআরের একটি সূত্র বলেছে, শিল্প স্থাপনের নামে যে পরিমাণ মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি হয়, বাস্তবে তার প্রতিফলন দেখা যায় না। যে কারণে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির আড়ালে অর্থ পাচারের ঘটনা বাড়ছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, অনেক আমদানি পণ্যে কাস্টমস ডিউটি থাকে না। এর পরও সেসব পণ্যের আমদানি অতি মূল্যায়িত (ওভার ইনভয়েস) দেখানো হচ্ছে। এর মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রার একটি অংশ বাইরে পাচার হচ্ছে।

বিভিন্ন সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তেও শিল্পের মূলধনী যন্ত্রপাতি ভর্তি কনটেইনারে পাওয়া গেছে ছাই, ইট, বালি, পাথর। এর আগে শুল্ক গোয়েন্দাদের একাধিক তদন্তে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরে খালি কনটেইনার আমদানির ঘটনাও ধরা পড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, বিদেশি ঋণের অপব্যবহার ও মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির আড়ালে দেশ থেকে অর্থ পাচার হচ্ছে, তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। তবে অর্থ পাচার ঠেকাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সতর্ক পদক্ষেপ নিচ্ছে।
বিনিয়োগের ধীরগতির মধ্যেও মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি বৃদ্ধির বিষয়টি অর্থনীতিবিদদের কেউ কেউ সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখছেন। তাদের মতে, এর মাধ্যমে অর্থ পাচার হতে পারে। নানা কারণে অর্থ পাচার বাড়ছে বলে মনে করেন তারা। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, সম্প্রতি মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি বেশি হচ্ছে। এখানে বেশি মূল্য দেখানো হচ্ছে। বিষয়টি খতিয়ে দেখা উচিত।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, দেশে কার্যত নতুন বিনিয়োগ হচ্ছে না। তবু মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি বেড়ে যাওয়া কোনো ভালো লক্ষণ নয়। তিনি বলেন, অনেক সময় ওভার ইনভয়েসিং হয়ে থাকে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু করার থাকে না। এনবিআরের সহযোগিতা নিয়ে যন্ত্রপাতির মূল্য পুনর্মূল্যায়ন করা যেতে পারে। অনেক সময় পুরনো যন্ত্রপাতি নতুন বলে চালিয়ে দেওয়া হয়। আবার যে পরিমাণ যন্ত্রপাতিতে ঋণপত্র খোলা হয়, তার চেয়ে অনেক কম আনা হয়।

http://www.samakal.com/economics/article/1709754/