১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৯:২২

প্রয়োজন নিরাপত্তা পরিষদের কঠোর অবস্থান

নিজ দেশে পরবাসী মানুষজন ছুটে পালাচ্ছে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে। আশ্রয় মিলবে সীমানা পেরোলেই বাংলাদেশে। অতীতেও এমনভাবে ওরা আশ্রয় পেয়েছে, অনেকে ফিরেও যেতে পেরেছে নিজ বাসভূমে। মানুষ আসছে নাফ নদী পেরিয়ে, শত সহস্র ছিন্নমূল, বিতাড়িত মানুষ মগের মুল্লুক থেকে। বসতবাটি থেকে উৎপাটিত, ভিটেমাটির অধিকার বঞ্চিত, স্বজন হারানো, লাঞ্ছিত, নির্যাতিত, অপমানিত রোহিঙ্গারা পা বাড়াচ্ছে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে।

‘দূরপ্রাচ্যের দরজা’ বলে পরিচিত পাহাড়ি এলাকা আরাকান দক্ষিণে ছুঁয়েছে বঙ্গোপসাগর। উত্তর-পশ্চিমে রয়েছে বাংলাদেশ, উত্তরে রয়েছে ভারত এবং পূর্বে মিয়ানমার। মিয়ানমারের প্রদেশ হলেও চীন পর্বতমালা থেকে সাগর পর্যন্ত বিস্তৃত আরাকান ইয়োমা বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে এই পাহাড়ি জনপদকে। নদী, পাহাড় মিলিয়ে আরাকানের মোট আয়তন ১৪,৯১৪ বর্গমাইল। রোহিঙ্গা ও মগ মিলিয়ে এলাকার জনসংখ্যা ২০ লাখ। ধর্মীয় বিশ্বাসে যারা মুসলমান তারাই রোহিঙ্গা, আর ধর্মীয় বিশ্বাসে যারা বৌদ্ধ তারাই মগ।

সপ্তম শতাব্দীতে আরবি ব্যবসায়ীরা যখন আরাকানে এসে নোঙর করেন তখন থেকেই এ অঞ্চলে শুরু হয় ইসলাম ধর্মের প্রচার। জেলেদের বসতি আকিয়াবের কালাদান বন্দরেই প্রথম নোঙর করে মুসলমানরা। সেখান থেকে তারা ছড়িয়ে পড়ে অভ্যন্তরে। একই সময়ে তারা নাফ নদীর মোহনায় গড়ে তোলে আরেকটি বন্দর মংডু। সপ্তম থেকে দশম শতাব্দী পর্যন্ত সময়ে ঐতিহাসিক নদী লেমরোর দুই তীরে গড়ে ওঠে বিভিন্ন শহর, যেগুলো বিভিন্ন সময়ে ছিল আরাকানের রাজধানী। কিন্তু আধুনিক শহর আকিয়াবের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যায় ওয়েসালি, লংগ্রেট, পারিস, মরাকুর মতো সমৃদ্ধ জনপদ।

রাজনৈতিক পালাবদলে বিভিন্ন সময়ে আরাকান করতলগত হয়েছে বিভিন্ন বৈদেশিক শক্তির। কখনও মুসলমানরা, কখনও মঙ্গোলরা, কখনও ইরানিরা, কখনও মূররা দখল করে নিয়েছে এ অঞ্চল। এই বৈদেশিক আগ্রাসনের কারণেই আমদানি হয়েছে বিভিন্ন ভাষা, সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রার। এই পরিবর্তনের ধারায় সবশেষে একটি আপাত স্থিতিশীলতা এনেছিল ইংরেজরা।

অবস্থানের দিক দিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ অঞ্চলের অবস্থান। পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন স্থলপথে এ অঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে চীন ও ভারতের। মিয়ানমারের ভেতর দিয়েই রয়েছে চীনে যাওয়ার পথ। আসামের মনিপুরের ভেতর দিয়ে রয়েছে ভারতে যাওয়ার পথ, যার উৎস প্যালেটাওয়া। আরেকটি পথ (যা এখন অবলুপ্ত- এ এলাকায় ছিল এশিয়ার দীর্ঘতম স্থলপথ) চীন থেকে আরাকানের চীন পর্বতমালা হয়ে মধ্য এবং দক্ষিণ এশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত।

ইতিহাস অনেক দীর্ঘ, সে আলোচনার অবকাশ এখানে নেই। শুধু একটি বিষয় প্রযোজ্য- তা হচ্ছে, এ সমস্যার শেষ কোথায় বা কীভাবেই এর সমাধান সম্ভব?

‘রোহিঙ্গা’ নামে পরিচিত মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যের মুসলিম অধিবাসীদের প্রতি এই নির্যাতন, শোষণ আর জুলুম শুরু হয় মূলত ১৯৪২ সাল থেকে। তখন থেকেই সে দেশের সরকার আরাকান থেকে প্রকৃত মুসলিমদের বিতাড়িত করছে। ১৯৭৭ সাল অবধি আরাকান রাজ্য থেকে অসংখ্য মুসলমান বাংলাদেশ, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে মাতৃভূমির মায়া ত্যাগ করে চলে গেছেন। ১৯৪২-এ যে নির্যাতনের সূত্রপাত আজও তা সমানভাবে অব্যাহত। সে সময়ই জাপানি বাহিনীর পতনের সঙ্গে সঙ্গে এলাকার মগ অধিবাসীরা জাপানিদের ফেলে যাওয়া অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে চড়াও হয় রোহিঙ্গাদের ওপর।

তারপর থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে এই নির্যাতনের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধান খুঁজছে রোহিঙ্গারা। চেষ্টা করেছে আবেদন-নিবেদন জানিয়ে পরিত্রাণ পেতে। কিন্তু কিছুই হয়নি। ১৯৭৮-এ এসে তাদের সেসব পথ একেবারে রুদ্ধ হয়ে যায়।

১৯৪৭ থেকে ১৯৭৬ পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে তারা চেষ্টা করেছে বিভিন্ন কমিশন বা সরকারের কাছে তাদের বক্তব্য তুলে ধরতে। কিন্তু ফল লাভ হয়নি।

১৯৪৭ সালেই চারটি কমিশন বসেছিল এ ব্যাপারে- পালং সংখ্যালঘু সম্মেলন, কেশি কমিশন, রিস উইলিয়ম কমিশন ও শাসনতন্ত্র প্রণয়ন কমিশন। কিন্তু কোনো কমিশনই রোহিঙ্গাদের বিষয়টি তলিয়ে দেখেনি। তাই ১৯৪৭ সালেই তারা প্রধানমন্ত্রী উনু’র কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন আরাকানকে স্বায়ত্তশাসিত মুসলিম প্রদেশ ঘোষণার। কিন্তু কেউ কান দেয়নি। এরপর ১৯৫১, ১৯৫৪, ১৯৫৫, ১৯৫৭, ১৯৬০, ১৯৬৯, ১৯৭০, ১৯৭২, ১৯৭৩, ১৯৭৪, ১৯৭৫ ও ১৯৭৬-এ তারা আবেদন জানিয়েছেন সরকার, রাষ্ট্রপ্রধান ও প্রধানমন্ত্রীর কাছে।

১৯৭০ সালে মগ ও রোহিঙ্গারা যুক্তভাবে নে উইন সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন আরাকানের স্বায়ত্তশাসনের জন্য। তাদের অভিযোগ, শুধু মগরাই তাদের সে অধিকার পেয়েছে ১৯৭৪ সালের ১৫ ডিসেম্বর, রোহিঙ্গারা পায়নি। এ কারণেই পরবর্তী পর্যায়ে রোহিঙ্গাদের বেছে নিতে হয়েছে ভিন্ন পথ। ১৯৭৮-এ এসে নির্যাতনের মাত্রা পৌঁছে চূড়ান্ত পর্যায়ে। এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসেই শুরু হয় ‘নাগামিন অপারেশন’। ৬ ফেব্রুয়ারি ২৫০ জন বহিরাগমন কর্মকর্তা সশস্ত্র হয়ে রেঙ্গুন থেকে উপস্থিত হয় আকিয়াব। অজুহাত একটাই- অধিবাসীদের জাতীয়তা যাচাই করা। উদ্বাস্তুরা জানিয়েছেন, হাতের টিকা দেখেই নাকি যাচাই করা হয়েছে তারা কোন দেশি।

বাংলাদেশকে ১৯৯১-এ এসে আরেকবার মোকাবেলা করতে হয়েছে রোহিঙ্গা সমস্যা। সমস্যার আংশিক সমাধান হলেও পুরো সমাধান হয়নি। উদ্বাস্তু হয়ে আসা অনেকেই মিলে গেছেন এ দেশীয়দের সঙ্গে, আবার অনেকেই পাড়ি জমিয়েছেন বিদেশে- পাকিস্তান, সৌদি আরব, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায়।

বর্তমানে যে সমস্যা তৈরি হয়েছে তার তিনটি দিক রয়েছে : মানবিক, অর্থনৈতিক-সামাজিক ও রাজনৈতিক। মানবিক দিক থেকে বাংলাদেশ ওদের মাথাগোঁজার ঠাঁই দিয়েছে। অর্থনৈতিক-সামাজিকভাবে সমস্যাটিকে বাংলাদেশ আপাতত মোকাবেলা করতে পারলেও দীর্ঘদিন তা করতে পারবে না। অতীতেও এবং বর্তমানে কক্সবাজারসহ আশপাশের এলাকায় প্রতিবেশ ব্যবস্থার যে ক্ষতি হয়েছে তা পুষিয়ে নেয়া প্রায় অসম্ভব। তবে কঠিন হচ্ছে রাজনৈতিক সমস্যার দিকটি। আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতির প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ কীভাবে এ সমস্যার মোকাবেলা করবে?

ইতিমধ্যে এটা প্রায় স্পষ্ট যে, চীন, ভারত, রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের জাতীয় স্বার্থের আলোকে এ সমস্যার বিবেচনা করছে। দশ-পনেরো লাখ মানুষের জীবন সেখানে মূল্যবান নয়। অতীতে আমরা দেখেছি প্রায় ৮ লাখ মানুষকে হত্যা করার দৃশ্যপটে রুয়ান্ডার ব্যাপারে বিশ্বসমাজ উদ্যোগী হয়েছে।

বিস্ময় হচ্ছে, বাংলাদেশ আইপিইউ ও সিপিএর নেতৃত্বে থাকার পরও অতি সম্প্রতি ইন্দোনেশিয়ার বালিতে অনুষ্ঠিত একটি পার্লামেন্টারি সম্মেলনে ভারত মিয়ানমারকে নিন্দা করতে রাজি হয়নি। চীনও যুক্তরাজ্যের উদ্যোগে সাড়া দিতে রাজি হয়নি। বাস্তবতা বিচার করলে এবং তথ্য দিয়ে আলোচনা করলে দেখা যাবে চারটি দেশ- ভারত, চীন, রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে মিয়ানমারের ওপর কোনো চাপ দিতে চায় না- কারণটা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক। মিয়ানমারের রাজনীতি এখনও সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত। সেনাবাহিনীর সঙ্গে বিস্তৃত সহযোগিতার মাধ্যমে এরা মিয়ানমারের রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে।

অবশ্য এটাই শেষ কথা নয়। এর বাইরেও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরাম আছে, সংস্থা আছে- যেখানে এ বিষয়টি তুলে ধরার জন্য সরব কূটনীতি প্রয়োজন। কসোভোতে নৃতাত্ত্বিক পরিশুদ্ধির অভিযানকে ঠেকানোর জন্য আন্তর্জাতিক সিদ্ধান্তে ন্যাটোর নেতৃত্বে বোমা অভিযান পরিচালিত হয়েছিল। মিয়ানমারের ক্ষেত্রে কি তেমন কিছু ভাবা যেতে পারে?

মিয়ানমার সরকার দৃষ্টি অন্যত্র সরানোর জন্য দেশের ভেতর গড়ে ওঠা বিভিন্ন সশস্ত্র সংগঠনকে দায়ী করছে। কিন্তু এ সংগঠনগুলো আজকে গড়ে ওঠেনি। দু-একটি সংগঠনের অস্তিত্ব বর্তমানে প্রকাশ্যে এসেছে বলে মনে হতে পারে এরা সাম্প্রতিক সময়ে গড়ে উঠেছে। কিন্তু এদের প্রায় সব কটি গড়ে উঠেছে গত শতাব্দীর সত্তরের দশকে।

মিয়ানমারের অভ্যন্তরে যেসব জাতিসত্তা রয়েছে তাদের সঙ্গে সরকারের সুসম্পর্ক নেই। এ জন্যই এসব জাতিসত্তা নিজেদের অধিকারের জন্য গড়ে তুলেছে একক ও যৌথ সংগঠন। কিন্তু মিয়ানমার সরকার এদেরকে বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে আখ্যায়িত করে। জাতীয় সীমানার বাইরে এদের যোগাযোগ অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত। আর এ কারণেই ভারত মিয়ানমারের ভেতরে অনুপ্রবেশ করে বিদ্রোহী দমনের জন্য। এসব সংগঠন সম্পর্কে বিভিন্ন আলোচনা চলছে। কিন্তু এদের কারণেই রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসী, মুসলমান জঙ্গি- এসব অভিযোগে অভিহিত করে দেশ থেকে বিতাড়নের কোনো অধিকার মিয়ানমার সরকারের নেই।

বাংলাদেশ সরকারের সামনে এ সমস্যার সমাধানে বেশকিছু পথ খোলা আছে। প্রথমেই এ জন্য প্রয়োজন জাতীয় ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ অবস্থান। এ জন্য প্রধানমন্ত্রী সব দলকে একটি সভায় আমন্ত্রণ জানাতে পারতেন। ঐক্যবদ্ধভাবে না হলেও প্রতিটি দল একই সময়ে একটি অভিন্ন বিবৃতি দিতে পারত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ওপর চাপ প্রয়োগের জন্য। মনে রাখা প্রয়োজন, রোহিঙ্গা বিতাড়নের প্রশ্নে অহিংসায় বিশ্বাসী বৌদ্ধরাও একমত।

রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে আন্তর্জাতিক উদ্যোগ, বিশেষভাবে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের কাঠোর অবস্থান ভিন্ন অন্য কোনো পথ নেই। কিন্তু এ ধরনের আলোচনার পরিসমাপ্তি সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। নিরাপত্তা পরিষদের সব সদস্যকে এ প্রশ্নে একটা ন্যূনতম সমঝোতায় পৌঁছাতে হবে। আর আন্তর্জাতিক মহলের লক্ষ্য যদি হয়ে থাকে বাংলাদেশসহ এ অঞ্চলে অস্থিতিশীলতা, নিরাপত্তা সংকট তৈরি করা, সেটা ভিন্ন কথা।

রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের সময় কয়েকটি বিষয়ে বিবেচনায় রাখতে হবে। যাতে এর ফলে রোহিঙ্গাদের মৌলিক অধিকার ও ব্যক্তি স্বাধীনতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা যায়; ধর্ম, চিন্তা, সংস্কৃতি ও জমায়েতের অধিকার প্রদান করা যায়; জীবন, স্বাধীনতা ও ব্যক্তির নিরাপত্তা প্রদান করা যায়; চলাচল ও বাসস্থানের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা যায় এবং ধর্ম-বর্ণ-জাত, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব মানুষকে সমঅধিকার ভোগের নিশ্চয়তা প্রদান করা যায়।

মাহফুজ উল্লাহ : শিক্ষক ও সাংবাদিক

https://www.jugantor.com/window/2017/09/14/155357