১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৯:২১

রোহিঙ্গা ইস্যু : দ্য ডিজেস্টার নেক্সট ডোর

মূল ইংরেজি : প্রফেসর সৈয়দ মুনীর খসরু ড় ভাষান্তর : গোলাপ মুনীর

দুই সপ্তাহ সময়ের মধ্যে মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্য থেকে সীমান্ত অতিক্রম করে তিন লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। বিষয়টি বাংলাদেশের ওপর প্রবল বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। শরণার্থীদের বাধ্য হয়ে আশ্রয় নিতে হয়েছে মিয়ানমার সীমান্তের কাছে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা নোংরা অস্বাস্থ্যকর আশ্রয়শিবিরগুলোয়। ১৩৫টি স্বীকৃত নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর বাইরে রাখা রোহিঙ্গাদের দশকের পর দশক ধরে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ হয়রানি করছে এবং পাগলা কুকুরের মতো তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। সর্বশেষ এই বিতাড়ন চলে গত আগস্টের শেষ দিকে একটি রোহিঙ্গা চরমপন্থী গোষ্ঠীর পুলিশ ফাঁড়ি আক্রমণের পর সামরিক অভিযান চলার প্রেক্ষাপটে। মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের দাবি এই অভিযানে এ পর্যন্ত ৪০০ লোকের প্রাণহানি ঘটেছে। অন্যদের দাবি এ সংখ্যা এর দ্বিগুণ।
চেতনাটি কোথায়?

রোহিঙ্গাদের এই পালিয়ে আসা বেগবান হয়েছে গত দুই সপ্তাহে। কিন্তু রোহিঙ্গারা বছরের পর বছর ধরে নিজভূমি রাখাইন থেকে পালিয়ে অন্যত্র আশ্রয়ের সন্ধানে চেষ্টা চালিয়ে আসছেÑ পাচারকারীদের ভয় উপেক্ষা করে এবং ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় নৌকায় গাদাগাদি অবস্থায় এরা দেশ থেকে পালাচ্ছে। রোহিঙ্গার আশ্রয় চেয়েছে ভারতেও, যেখানে তাদের দূরে রাখা হয়েছে, অস্বীকার করা হয়েছে মৌলিক পরিষেবা এবং কর্তৃপক্ষ তাদের ধরে নিয়েছে ‘অবাঞ্ছিত’ বলে।

অপর দিকে সরকার এদের অভিহিত করছে অবৈধ অভিবাসী ও অনধিকার প্রবেশকারী বলে। আসল ঘটনা হচ্ছে, ভারতের ইতিহাসজুড়ে পাশের দেশের নির্যাতিত শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়ার ব্যাপারে বদান্যতা দেখিয়েছে, শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছে। এদের মধ্যে ছিল পার্সি, তিব্বতি, আফগান, শ্রীলঙ্কান, তামিল ও ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়ে বাংলাদেশীরা। ভারত গর্ব করে এর অতিথিকে দেবতা ভাবার (অতিথিরা দেবতার সমান) ট্র্যাডিশনের জন্য।

সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তার মিয়ানমার সফরের সময় রোহিঙ্গা প্রশ্নে যে অবস্থান নিয়েছেন, তা হতাশাজনক এবং ‘হসপিটালিটি ও ইনকুসিভনেস’ মূল্যবোধের ভারতীয় অবস্থানের সাথে সাংঘর্ষিক। দক্ষিণ এশিয়া, বিশেষ করে বাংলাদেশের ওপর যেখানে এই সঙ্কট নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে, সেখানে প্রত্যাশা ছিল মিস্টার মোদি মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর ও নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী অং সাং সু চির কাছে এই মানবিক সঙ্কটের ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করবেন। তা না করে এর পরিবর্তে তিনি সহমর্মিতা প্রকাশ করেছেন মিয়ানমারের সাথে। তার সফর শেষে যৌথ বিবৃতিতে বলা হয় ÔIndia stands with Myanmar over the issue of violence in the Rakhine state which has led to loss of innocent lives.Õ তা করতে গিয়ে, তিনি এড়িয়ে গেছেন প্রতিবেশী দেশটিতে পরিচালিত বর্বর অপরাধের বিষয়টি। এবং তিনি চোখ বন্ধ রেখেছেন নির্যাতন এড়াতে পালিয়ে আসা শরণার্থীদের অবর্ণনীয় দুর্ভোগ ও এর ফলে সম্পদের সীমাবদ্ধ বাংলাদেশকে চাপে ফেলে দেয়ার বিষয়টির ক্ষেত্রে। বাংলাদেশ হচ্ছে, এমন একটি দেশ, যে দেশটিকে ভারতীয় রাজনীতিবিদ ও কর্মকর্তারা ভারতের প্রতিবেশী দেশের সাথে বন্ধুত্বের রোল মডেল হিসেবে উল্লেখ করে থাকেন।
বাংলাদেশের বোঝা
বাংলাদেশে কর্মরত আন্তর্জাতিক ত্রাণসংস্থা, যেমন ইউএনএইচসিআর (ইউনাইটেড ন্যাশসন’স হাইকমিশন ফর রিফিউজিস) ও বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে প্রতিদিন হেঁটে বা নৌকায় করে আসা বিপুল শরণার্থীকে সহায়তা জোগানো। বাংলাদেশ নিজে বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর দেশ। সেখানে আশ্রয় দেয়া হয়েছে ছয় লাখেরও বেশি রোহিঙ্গাকে। সে তুলনায় যেখানে ভারতে রয়েছে মাত্র ৪০ হাজার রোহিঙ্গা। বাংলাদেশ প্রথম দিকে নাফ নদী বরাবর সীমান্ত খুলে দেয়ার ব্যাপারে দ্বিধান্বিত ছিল। এখন শরণার্থী ঢুকতে দিতে শুরু করেছে।

যদিও ঢাকার আন্তর্জাতিক রেড ক্রস কমিটি প্রস্তাব দিয়েছে, মিয়ানমারের রাখাইনে আন্তর্জাতিক ত্রাণসংস্থার তত্ত্বাবধানে নিরাপদ এলাকা গড়ে তুলেছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত এ ব্যাপারে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশ পরিকল্পনা করছে, মিয়ানমার সীমান্তের কাছে আরো ৬০৭ হেক্টর জমি দেবে শরণার্থীদের জন্য শরণার্থীশিবির নির্মাণ করার জন্য। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সমাজের কাছে আহ্বান জানিয়েছে, শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেয়া এবং তাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস বন্ধে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি বলেছেন : ‘এটি মর্যাদার ওপর আঘাত হানে, যখন একটি দেশের হাজার হাজার মানুষ পালিয়ে যায় অন্য দেশে শরণার্থী হওয়ার জন্য।’
বেড়ার অপর পাশে
গত ৮ সেপ্টেম্বর ইন্দোনেশিয়ায় ওয়ার্ল্ড পার্লামেন্টারি ফোরাম অন সাস্টেইন্যাবল ডেভেলপমেন্ট ঘোষিত বালি ডিকারেশনে স্বাক্ষর থেকে ভারতের বিরত থাকার সিদ্ধান্ত ভারতের মানবাধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন ও সংখ্যালঘুদের প্রতি আচরণ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এই ঘোষণায় আহ্বান জানানো হয় : ‘সব পক্ষকে স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা পুনরুদ্ধারে অবদান রাখতে........রাখাইন স্টেটে ধর্ম ও সম্প্রদায় নির্বিশেষে সব মানুষের মানবাধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে, একই সাথে নিরাপদে মানবিক সাহায্য প্রবেশে সহায়তা দিতে।’ এ ঘোষণায় স্বাক্ষর না করায় প্রতিবেশী দেশের অন্যান্য অংশের সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার নিয়ে কথা বলায় ভারতের নৈতিক কর্তৃত্বকে দুর্বল করা হয়েছে। মজার ব্যাপার হলো, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা এই ডিকারেশনে অংশ নিয়েছে।

২০১৫ সালে মিস্টার মোদি বাংলাদেশ সফরে আসেন। তখন তিনি ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক বর্ণনা করতে বাকপটু বাচনভঙ্গি ব্যবহার করেন। ২০০৯ সাল থেকে বাংলাদেশ আবির্ভূত হয়েছে বাংলাদেশের সবচেয়ে বিশ্বস্ত প্রতিবেশী হিসেবে। ঢাকা সাড়া দিচ্ছে নয়াদিল্লির প্রায় সব নিরাপত্তা উদ্বেগে। এর মধ্যে আছে আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাস বন্ধ করা ও বাংলাদেশের মাটি থেকে ভারতের বিরুদ্ধে পরিচালিত বিদ্রোহী কর্মকাণ্ড বন্ধ করা। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত আজ ভারতের জন্য সবচেয়ে বেশি নিরাপদ। এর ফলে ভারত তার গুরুত্বপূর্ণ সীমান্ত সম্পদ অন্যত্র অন্যান্য উদ্দেশ্যে কাজে লাগাতে পারছে। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশ তিস্তার পানি পায়নি, পায়নি সবচেয়ে বড় প্রতিবেশীর কাছ থেকে সময়মতো মানবিক সহায়তা।
দুর্ভাগ্য, বাংলাদেশ যখন দু’টি সাবমেরিন চীন থেকে কিনল, তখন এটাই নির্দেশ করেÑ দেশ দু’টির মধ্যে অর্থনৈতিক ও প্রতিরক্ষাসংক্রান্ত বন্ধন আরো সুদৃঢ় হচ্ছে। নয়াদিল্লি তখন এর তৎকালীন ইউনিয়ন প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পারিকরকে ঢাকা পাঠায় সামরিক সহযোগিতা বাড়ানোর লক্ষ্যে। এখন বাংলাদেশকে সহায়তায় এই তাৎক্ষণিকতা দেখা যাচ্ছে না, যখন বাংলাদেশকে স্বদেশ থেকে পালিয়ে আসা নির্যাতিত অসহায় শরণার্থীদের সহায়তা দিতে হচ্ছে, এবং যখন তাদের পাশে কেউ নেই। বিশ্ব প্রত্যাশা করে না, মিয়ানমারের অন্য বড় প্রতিবেশী দেশ চীন চলমান বর্বরতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হবে বলে। কিন্তু গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ঊর্ধ্বে তুলে ধরার দেশ হিসেবে ভারতের অনন্য সুযোগ আছে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে মধ্যস্থতা করে স্টেটম্যানশিপ ও আঞ্চলিক নেতৃত্ব প্রদর্শনের। ভারত জাতিসঙ্ঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে প্রণীত ‘অ্যাডভাইজারি কমিশন অন রাখাইন স্টেট’-এর রিপোর্টের ভিত্তিতে এই কাজটি করতে পারত। আর এই কমিশন সেটআপ করেন অন্য কেউ নন, করেছেন সু চি নিজে।
ভারতের সমুদ্র কূটনীতিতে মিয়ানমার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য এবং ভারতের ‘লুক ইস্ট’ পলিসির গুরুত্বপূর্ণ এক অংশী দেশ হচ্ছে মিয়ানমার। সেখানে রোহিঙ্গাদের অমানবিকভাবে দেশ ছেড়ে পালানোর ব্যাপারে ভারতের নিরুদ্বিগ্ন থাকার প্রবণতা থেকে ভারতের নৈতিক নেতৃত্ব দেয়ার অক্ষমতারই প্রতিফলন। প্রতিফলন আছে বিভিন্ন ঘটনায় আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে প্রতিবেশী দেশের প্রভাব খাটানোর ক্ষেত্রে ভারতের অক্ষমতারও।
ভারত কোনো, এর ঈর্ষণীয় সফট পাওয়ার ও দুর্জয় হার্ড পাওয়ার থাকা সত্ত্বেও এ অঞ্চলে আস্থা সৃষ্টি করতে পারেনি, এর বহু কারণের মধ্যে একটি কারণ হচ্ছেÑ বাংলাদেশের মতো বন্ধু দেশসহ অন্য দেশগুলোর সাথেও ভারতের জটিল ভূরাজনীতির ভিত্তি হচ্ছে বরাবর চর্চিত মূল্যবোধের বিপরীতে রাজনৈতিক সুবিধাবাদ (পলিটিক্যাল অপরচুনিজম) ও অর্থনৈতিক স্বার্থ। বিষয়টি নিয়ে ভারতকে ভাবতে হবে। হ
লেখক : আন্তর্জাতিক থিংক ট্যাংক‘দ্য ইনস্টিটিউট অব পলিসি অ্যাডভোকেসি অ্যান্ড গভর্নেন্স’-এর (আইপিএজি) চেয়ারম্যান।
সূত্র : ভারতের ইংরেজি দৈনিক ‘দ্য হিন্দু’, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/251543