১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৯:২০

সু চির শান্তি ও রক্তাক্ত আরাকান

সৈয়দ মাসুদ মোস্তফা : মিয়ানমারের কথিত গণতন্ত্রকামী নেত্রী অং সান সু চিকে শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখার জন্য শান্তিতে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা করা হয়েছে। কিন্তু তার দেশ মিয়ানমারে সব সময় অশান্তিই বিরাজ করছিল। এমনকি তিনিও কথিত গণতন্ত্রকামী নেত্রীর তকমা নিয়ে দীর্ঘদিন গৃহবন্দীও ছিলেন। বিশ্বের শান্তিকামী মানুষ মনে করেছিল যে, যেহেতু বর্মী গণতন্ত্রের মধ্যমণি অং সান সু চিকেই জান্তা বন্দী করে রেখেছে. তাই সেখানকার গণতন্ত্রও বাক্সবন্দী অবস্থায় আছে। তাই গণতন্ত্রের এই মহান নেত্রী মুক্তি লাভ করলেই দেশের গণতন্ত্র মুক্তি পাবে। গণতন্ত্রকামী মানুষও ফিরে পাবে তাদের নায্য অধিকার। এমনটিই আশা ছিল বিশ্বের শান্তিপ্রিয় ও গণতন্ত্রকামী মানুষের। কিন্তু তিনিও বিশ্ববাসীকে হতাশই করেছেন।
সে আশায় গুড়েবালি পড়তে খুব একটা সময় লাগেনি। জান্তার শাসন থেকে গণতন্ত্রায়নের অংশ হিসেবেই ২০১৫ সালের ৮ নভেম্বর মিয়ানমারে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। যদিও অং সান সু চির দল সে নির্বাচনে কোন মুসলিম বা রোহিঙ্গাকে প্রার্থীতা দেয়নি। তবুও মনে করা হয়েছিল যে, সু চির দল সাধারণ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলে রোহিঙ্গা সমস্যার একটা শান্তিপূর্ণ সমাধান হবে। বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গা শরণার্থীরাও সে আশায় বুক বেঁধেছিলেন। নির্বাচনে অং সান সু চির দল ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠন করতেও সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, রাখাইন রাজ্যে শান্তি ফিরে আসেনি বরং তা আগের তুলনায় অনেক বেশী অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছে। সু চির সরকার সেনাবাহিনীকে সন্তষ্ট রেখেই ক্ষমতায় থাকার নীতির অংশ হিসেবেই রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিষয়ে আগের সরকারের নীতির কোন পরিবর্তন করেনি বরং এ বিষয়ে তারা আরও কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছে। যা আরাকান রাজ্যে ব্যাপক সহিংসতা ছড়িয়ে দিয়েছে।

মিয়ানমার সরকার সব সময়ই আরাকানের বাংলাভাষী মুসলমানদের বাংলাদেশী বলে আখ্যা দিয়ে দীর্ঘদিন পর্যন্ত জুলুম-নির্যাতন চালিয়ে আসছে। তাদেরকে নির্মম ও নিষ্ঠুরভাবে হত্যা এবং বাস্তুভিটা থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে। বাড়িঘরসহ সহায়-সম্পদ আগুন দিয়ে জ¦ালিয়ে দেয়া হচ্ছে। ফলে জীবন বাঁচাতেই বিপন্ন রোহিঙ্গাদের শ্রোত আছড়ে পড়ছে বাংলাদেশের দিকে। বাংলাদেশ এমনিতেই বিশ্বের অন্যতম জনবহুল রাষ্ট্র। তার ওপর আবার রোহিঙ্গাদের ঢল বাংলাদেশের অর্থনীতি, পরিবেশ, পরিস্থিতির ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। তারপরও বাস্তবতাকে বাংলাদেশের মানুষও সরকার উপেক্ষা করতে পারছে না। তাই মানবিক কারণেই নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়াতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। আগে থেকেই বাংলাদেশে প্রায় তিন লাখ রোহিঙ্গা শরনার্থী অবস্থান করছিল বাংলাদেশে। গত ২৫ আগস্ট নতুন করে রোহিঙ্গা নিধন শুরু হওয়ার পর আরও দু’লাখেরও অধিক রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। সীমিত সামর্থের কারণেই বাংলাদেশ তাদের সমস্যা সমাধানে হিমহিম খাচ্ছে। সঙ্গত কারণেই জান বাঁচাতে বাংলাদেশে এসেও তাদেরকে নানাবিধ প্রতিকুলতা সহ মানবেতর জীবন যাপন করতে হচ্ছে।

মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গা মুসলমানদের ভিনদেশী আখ্যা দিলেও এ অভিযোগের সাথে সত্যতার দূরতম সম্পর্ক নেই। ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, ১৪৩০ থেকে ১৭৮৪ সাল পর্যন্ত ২২ হাজার বর্গমাইল আয়তনের রোহিঙ্গা স্বাধীন রাজ্য থাকলেও মিয়ানমারের রাজা বোদাওফায়া এ রাজ্য দখল করার পর বৌদ্ধ আধিপত্য শুরু হয়। ফলে রোসাঙ্গ রাজসভার বাংলা ভাষার কবি-সাহিত্যিকরা যে রাজ্যকে রোসাং ও মুসলিম জনপদ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন তা বৌদ্ধ উগ্রবাদীদের নির্মমতা ও নিষ্ঠুরতায় কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। ফলে রোহিঙ্গা মুসলিমরা এখন নিজ দেশেই পরবাসী, বাস্তহারা ও অধিকারহীন এক যাযাবর জনগোষ্ঠী। যাদের রক্তে প্রতিনিয়ত রঞ্জিত হচ্ছে মুসলিম জনপদ। কোনোভাবেই থামছে না উগ্রবাদীদের জিঘাংসা।
মূলত ‘অহিংসা পরম ধর্ম’-বিদ্বেষহীনতাই প্রকৃত ধর্ম’ বৌদ্ধ ধর্মের প্রধান উপজীব্য হলেও মিয়ানমারের মুসলমানদের ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য নয় বলেই মনে হচ্ছে। অহিংস ধর্মের ধারক-বাহকরা কী কারণে সহিংস ও উগ্র হয়ে উঠলেন তা কারো বোধগম্য নয়। উগ্রবাদীরা হরহামেশাই মুসলমানদের হামলা, দেশ থেকে বিতাড়ন, নির্বিচারে হত্যা, বসতবাড়ি থেকে উৎখাত, নাগরিকত্ব হরণ, ব্যবসা-বাণিজ্য ধ্বংস, মসজিদে আগুন ও পুড়িয়ে মানুষ হত্যাসহ নানাবিধ জুলুম-নির্যাতন চালিয়ে আসছে দীর্ঘকাল ধরে। থামছে না তাদের সাম্প্রদায়িক উন্মাদনা।

এসব মুসলিমবিরোধী দাঙ্গা ও হত্যাযজ্ঞের জন্য প্রধানত উগ্রবাদী ও ধর্মান্ধ বৌদ্ধদের একতরফা দায়ী করা হলেও সর্বসাম্প্রতিক গবেষণায় ভিন্ন চিত্র উঠে এসেছে। প্রাপ্ত এক তদন্ত প্রতিবেদনে জানা গেছে, মিয়ানমার সরকার ও সেনাবাহিনী অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবেই সে দেশে মুসলিমবিরোধী দাঙ্গা-হত্যাযজ্ঞে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে। মূলত ক্ষমতাসীনরা নিজেদের ক্ষমতাকে নিরাপদ ও নিষ্কন্টক রাখতেই মুসলমানদের ওপর উগ্রবাদীদের উসকে দিয়েছে এবং বিশ্ব ইতিহাসকে প্রতিনিয়ত রক্তাক্ত ও কলঙ্কিত করছে।

মূলত রোহিঙ্গা আদিবাসী জনগোষ্ঠী পশ্চিম মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের একটি উল্লেখযোগ্য নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী। এরা ইসলাম ধমের্র অনুসারি। রোহিঙ্গাদের আলাদা ভাষা থাকলেও তা অলিখিত। মিয়ানমারের আকিয়াব, রেথেডাং, বুথিডাং, মংডু, কিয়ক্টাও, মাম্ব্রা, পাত্তরকিল্লা এলাকায় এদের বাস। প্রায় ৮ লাখ রোহিঙ্গা মিয়ানমারে বসবাস করে। মিয়ানমার ছাড়াও ৫ লক্ষের অধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশ এবং সৌদি আরবে বাস করে বলে ধারণা করা হয়, যারা বিভিন্ন সময় মিয়ানমার সরকারের নির্যাতনের কারণে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। জাতিসংঘের তথ্যমতে, রোহিঙ্গারা বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে নির্যাতিত জনগোষ্ঠী।
বর্তমান মিয়ানমারের রোহিং (আরাকানের পুরনো নাম) এলাকায় এ জনগোষ্ঠীর বসবাস। রাখাইন প্রদেশের উত্তর অংশে বাঙালি, পার্সিয়ান, তুর্কি, মোগল, আরবীয় ও পাঠানরা বঙ্গোপসাগরের উপকূল বরাবর বসতি স্থাপন করেছে। তাদের কথ্য ভাষায় চট্টগ্রামের স্থানীয় উচ্চারণের প্রভাব রয়েছে। উর্দু, হিন্দি, আরবি শব্দও রয়েছে। রাখাইনে দুটি সম্প্রদায়ের বসবাস ‘মগ’ ও ‘রোহিঙ্গা’। মগরা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। মগের মুল্লুক কথাটি বাংলাদেশে পরিচিত। দস্যুবৃত্তির কারণেই এমন নাম হয়েছে ‘মগ’দের। এক সময় তাদের দৌরাত্ম্য ঢাকা পর্যন্ত পৌঁছেছিল। মোগলরা তাদের তাড়া করে জঙ্গলে ফেরত পাঠায়। উল্লেখ্য, ১৪৩০ থেকে ১৭৮৪ সাল পর্যন্ত ২২ হাজার বর্গমাইল আয়তনের রোহিঙ্গা স্বাধীন রাজ্য ছিল। মিয়ানমারের রাজা বোদাওফায়া এ রাজ্য দখল করার পর বৌদ্ধ আধিপত্য শুরু হয়।

১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি মিয়ানমার স্বাধীনতা অর্জন করে এবং বহুদলীয় গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু হয়। সে সময়ে পার্লামেন্টে রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধিত্ব ছিল। এ জনগোষ্ঠীর কয়েকজন পদস্থ সরকারি দায়িত্বও পালন করেন। কিন্তু ১৯৬২ সালে জেনারেল নে উইন সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করলে মিয়ানমারের যাত্রাপথ ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হতে শুরু করে। রোহিঙ্গাদের জন্য শুরু হয় দুর্ভোগের নতুন অধ্যায়।
আর তখন থেকে রাখাইন জনগোষ্ঠীর ওপর জুলুম-নির্যাতনের সূত্রপাত হয়। কখনো থেমে থাকেনি বৌদ্ধ উগ্রবাদীদের এই নিষ্ঠুরতা ও নির্মমতা। ফলে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও বৌদ্ধ জঙ্গীদের হাতে হাজার হাজার রোহিঙ্গারা প্রাণ হারায়। লক্ষ লক্ষ মানুষ বাস্তুহারা হয়ে পড়ে। শুধুমাত্র ২০১২ সালের ১৪ জুন সংঘটিত দাঙ্গায় অন্তত ১৬০০ ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়। দাঙ্গায় কমপক্ষে ৩০ হাজার মানুষ উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়েছে এবং রাখাইন রাজ্য স্থাপিত ৩৭টি আশ্রয় শিবিরে অন্তত অর্ধ লক্ষ বনি আদম আশ্রয় নেয়। স্থানীয় সূত্রের বরাতে বলা হয়, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রাখাইনদের সহায়তায় মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী নাসাকা, পুলিশ ও লুন্টিন বাহিনী এসব হত্যাকান্ড ও লুটতরাজের ঘটনা ঘটিয়েছে। মাত্র ৬ দিনের ব্যবধানে নিহত হয়েছিল ৪ শতাধিক মুসলমান, যা ইতিহাসের সকল বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতাকে হারা মানায়।

২০১৫ সালের মার্চ মাসে আবারও পরিকল্পিত দাঙ্গা শুরু করা হয়। মেইকতিলা শহরে বৌদ্ধ ও মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে বড় ধরনের দাঙ্গার ঘটনা ঘটে। সহিংসতায় কমপক্ষে ১০ জনের প্রাণহানি ঘটে। কয়েকটি মসজিদের ওপর হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। গত ১ মে উগ্রবাদী বৌদ্ধদের হামলায় নতুন করে অন্তত ২টি মসজিদ ও ২ শ’ ঘড়বাড়ি ধ্বংস করা হয়েছে। যা উগ্রবাদীদের নৃশংসতার প্রমাণ বহন করে।

মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের বিতাড়ন ও হত্যা করেই তারা ক্ষান্ত হয়নি বরং মুসলিম জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নতুন ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছে। এমনিতেই তো হাজার হাজার মুসলমানের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। এমনকি তাদেরকে ২০১৫ সালের ৮ নভেম্বর সাধারণ নির্বাচনে প্রার্থী হতে দেয়া হয়নি। আর এ ব্যাপারে তদানীন্তন ক্ষমতাসীন দল ইউএসডিপি এবং বর্তমান ক্ষমতাসীন অং সান সূ চির নেতৃত্বাধীন বিরোধী দল ন্যাশনাল লিগ অব ডেমোক্র্যাসি (এনএলডি) একাট্টা। যদিও গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী অং সান সু চিকে উদারনৈতিক গণতন্ত্রবাদী মনে করা হতো। কিন্তু তিনি নিজের ব্যক্তিত্ব দিয়ে তা প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন।

মূলত গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু করতে মিয়ানমারের জন্য এ নির্বাচন কঠিন পরীক্ষা হিসেবেই বিবেচিত হচ্ছে। দেশটিতে ২০১০ সাল থেকেই বদলাতে শুরু করেছে রাজনৈতিক দৃশ্যপট। তবে সেনাবাহিনীর মদদপুষ্ট সরকারের ছত্রছায়ায় ২০১১ সাল থেকেই কট্টর বৌদ্ধ গোষ্ঠীগুলো সুবিধা পেয়ে আসছে। যার ফলশ্রুতিতে দেশের রাজনীতিতে তাদের সীমাহীন প্রভাব লক্ষণীয়। আর এ প্রভাব আশঙ্কাজনকভাবে ক্রমবর্ধমান। হয়তোবা এ কারণেই এ নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারেননি রাখাইন মুসলিমরা। শুধু কি তাই! ২০১৫ সালের গোড়ার দিকে মিয়ানমার সরকার লাখ লাখ রোহিঙ্গা মুসলিমদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়ায় এ জনগোষ্ঠীর অনেকেই ভোটাধিকার প্রয়োগেরও সুযোগ পাচ্ছেন না। ফলে তাদের মানবাধিকার আজ ভূলুন্ঠিত। সর্বোপরি বিশ্ববিবেকও রীতিমতো নীরব।
সেনাশাসিত মিয়ানমারে ২৫ বছরের মধ্যে প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচনে সুকৌশলে মুসলিমদের বাদ দেয়া হয়েছে। প্রায় ৩০ লাখ রোহিঙ্গা মুসলিমকে ভোটার না করার পাশাপাশি বড় দলগুলোতে কোন মুসলিম প্রার্থী রাখা হয়নি। দেশটির নোবেলজয়ী গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী অং সান সুচির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসি (এনএলডি) থেকে কোন মুসলিম প্রার্থীকে মনোনয়ন দেয়া হয়নি। অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খোদ সু চির নির্দেশেই দলের মধ্যে মুসলিমদের কাটছাঁট করা হয়েছে। মূলত দেশটির উগ্রপন্থী বৌদ্ধদের মুসলিমবিরোধী মনোভাবের কারণেই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে গণতন্ত্রপন্থী দলটি। ফলে উদার গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এখন রীতিমতো প্রশ্নবিদ্ধ। কারণ, স্থানীয় ও জাতীয় নির্বাচনে এনএলডির ১,১৫১ জন প্রার্থীর মধ্যে একজন মুসলিম ছিল না। যদিও দেশটিতে ৫০ লাখ মুসলিমের বসবাস। দেশটির মোট জনসংখ্যার তুলনায় তা প্রায় ৪ থেকে ১০ শতাংশের মধ্যে।
গত বছরের অক্টোবরে মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে নতুন করে সহিংসতা শুরু হয়। এর কারণ হিসেবে আরাকারন সলভেশন আর্মির মিয়ানমার বাহিনীর ওপর কথিত হামলার অভিযোগ উত্থাপন করা হয়। মূলত এ হামলার সাথে রোহিঙ্গাদের কোন সম্পৃক্ততার কথা নিরপেক্ষ সূত্র থেকে যাচাই করা যায়নি। কিন্তু কথিত এ হামলাকে ভিত্তি ধরেই মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও বৌদ্ধ সন্ত্রাসীরা আরাকানে মুসলিম হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে। শত শত নিরাপরাধ সাধারণ রোহিঙ্গা মুসলিমকে জীবন্ত আগুনে পুড়িয়ে, ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে ও গুলী চালিয়ে হত্যা হত্যা করা হয়। বাড়ী-ঘর, মসজিদ-মাদরাসা, ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ করে নারকীয় তান্ডব চালানো হয়। জীবন বাঁচাতে ভাগ্যাহত রোহিঙ্গারা ক্ষেত-খামার ও পাহড়ে আশ্রয় গ্রহণ করে। এমনকি তারা সীমান্ত অতিক্রম করে লাখ লাখ রোহিঙ্গা নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ে। নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের আহাজারী ও আর্তনাদে আকাশ বাতাশ ভারী হয়ে ওঠে।

গত ২৫ আগস্ট থেকে রাখাইন রাজ্যে নতুন করে সহিংসতা শুরু হয়। আবারও আরাকান সলভেশন আর্মি কর্তৃত পুলিশ চৌকিতে হামলার অভিযোগ করা হয়। কিন্তু মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও বৌদ্ধ সন্ত্রাসীরা কথিত সলভেশন আর্মির কেশ্রাগ্র ষ্পর্শ করেত পারেনি বরং সে ঘটনার সূত্র ধরেই সাধারণ রোহিঙ্গাদের ওপর নারকীয় হত্যাযজ্ঞ ও নির্মম নিধনযজ্ঞ শুরু করে। আগের ঘটনার সূত্র ধরেই জীবন্ত পুড়িয়ে, কুপিয়ে ও গুলী করে করে হত্যা এবারও হত্যা অব্যাহত আছে। মুসলমানদের বাড়িঘর, মসজিদ-মাদরাসা ও ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠান লুটপাত ও অগ্নিসংযোগ চলছে যুগপৎভাবে। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সাথে উগ্রবাদী বৌদ্ধ জঙ্গীরাও নরহত্যায় মেতে ওঠেছে। যা হালাকু খানের বাগদাদ ধ্বংসের নির্মমতাকেও হার মানিয়েছে। এমন নির্মম ও নিষ্ঠুর গণহত্যা বিশ্ববাসী আর কখনো প্রত্যক্ষ করেনি।

নির্যাতিত ও নিপীড়িত রোহিঙ্গা মুসলমানরা নিরাপদ আশ্রয়ে নানা প্রতিকুলতা অতিক্রম করেই সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে ঢুকছে। কিন্তু থেমে নেই মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও বৌদ্ধ সন্ত্রাসীদের নির্মম এবং নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ। জাতিসংঘের পরিসংখ্যান অনুযায়ি সাম্প্রতিক সহিংসতায় সহ¯্রাধিক রোহিঙ্গা নিহত হয়েছেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অং সান সু চির সরকার ক্ষমতাসীন থাকার পরও রাখাইন রাজ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার কোন আলামত দেখা যাচ্ছে না বরং তিনিই এখন শান্তির প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছেন। বিশ্বব্যাপী তাকে নিয়ে সমালোচনার ঝড় ওঠেছে।
এমনকি তার নোবেল পুরস্কার প্রত্যাহারেরও আবেদন জানানো হয়েছে। কিন্তু তিনি রাখাইনে সহিংসতা বন্ধে কোন কার্যকর ব্যবস্থা তো গ্রহণ করছেনই না বরং এসব সহিংসতার অভিযোগ অস্বীকার করে উল্টো সহিংসতার জন্য রোহিঙ্গাদের দায়ি করে নিজের কদর্য ও কুৎসিত চেহারা বিশ্ববাসীর কাছে উন্মুক্ত করেছেন। সম্প্রতি তুর্কি প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোগানের সাথে টেলিফোনে আলাপকালে বলেছেন, তার সরকার আরাকানে সরকার স্বার্থে কাজ করছে এবং তিনি সহিংসতার খবরকে শুধু অতিরঞ্জিতই নয় বরং গুজব বলে উল্লেখ করেছেন। যা বিশ্ববাসীকে বিক্ষুব্ধ ও হতাশ করেছে। রোহিঙ্গা হত্যাযজ্ঞের বিষয়ে গণমাধ্যমে যে সচিত্র খবরাখবর আসছে তা তিনি অস্বীকার করবেন কীভাবে? মিথ্যাচারেরও তো সীমা থাকা দরকার। তাই বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের প্রশ্ন এই নির্মমতার শেষ কোথায় ? শান্তির দূত সু চি শান্তি বলতে কী বোঝেন ?

http://www.dailysangram.com/post/299607