১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭, বুধবার, ১১:৩৩

চিকিৎসকদের পদোন্নতিতে অনিয়মের ছড়াছড়ি

চিকিৎসক কাজী শফিকুল হালিমকে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব প্রিভেনটিভ অ্যান্ড সোশ্যাল মেডিসিনের (নিপসম) মহামারি বা এপিডেমিওলজির সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিভাগীয় পদোন্নতিবিষয়ক কমিটি। এই পদোন্নতির জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তৈরি করা যোগ্য ব্যক্তিদের তালিকার (ফিট লিস্ট) ১ নম্বরে ছিলেন চিকিৎসক মো. ইকবাল কবির। তাঁকে পদোন্নতি দেয়নি কমিটি।

মো. ইকবাল কবির বলেছেন, তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের সক্রিয় কর্মী নন। আর কাজী শফিকুল হালিম বলেছেন, তিনি ছাত্রলীগের রংপুর মেডিকেল কলেজ শাখার সভাপতি ছিলেন এবং বর্তমানে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) প্রকাশনাবিষয়ক সম্পাদক।
অভিযোগ উঠেছে, রাজনৈতিক বিবেচনায় শফিকুল হালিমকে পদোন্নতি দেওয়ায় বঞ্চিত হয়েছেন মো. ইকবাল কবির।

পবিত্র ঈদুল আজহার ছুটির আগে পাঁচ শতাধিক চিকিৎসককে সহকারী অধ্যাপক থেকে সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি দেয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, কোরবানির সময় চিকিৎসকেরা একটু বাড়তি খুশিতে থাকবেন, তাই পদোন্নতির ঘোষণা ঈদের ছুটির আগেই দেওয়া হয়েছিল।
তবে পদোন্নতির জন্য তৈরি ফিট লিস্ট ও পদোন্নতি পাওয়া কর্মকর্তাদের তালিকা পাশাপাশি রাখলে দেখা যায় যে শুধু চিকিৎসক ইকবাল নন, বঞ্চিত হয়েছেন আরও অনেক চিকিৎসক। এই সংখ্যা প্রায় ২০০। তাঁদের ঈদের ছুটি বা ভবিষ্যৎ কর্মজীবনের কথা ভাবেনি প্রশাসন।

বিএমএর সাবেক মহাসচিব ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সহ-উপাচার্য অধ্যাপক রশীদ-ই-মাহবুব বলেন, সার্বিকভাবে স্বাস্থ্য খাতে যে দুর্বৃত্তায়ন চলছে, যোগ্যদের পদোন্নতি না দেওয়া তারই ধারাবাহিকতা। যোগ্যকে বাদ দিয়ে অযোগ্যকে পদোন্নতি দেওয়ার প্রবণতা বিএনপি আমলে দেখা গিয়েছিল। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেও তা অব্যাহত আছে। এই প্রবণতা চিকিৎসা শিক্ষা ও চিকিৎসাসেবার জন্য দক্ষ জনবল তৈরির পথে বড় বাধা।

এ ব্যাপারে পদোন্নতি কমিটির সভাপতি ও স্বাস্থ্যসচিব সিরাজুল হক খান ৭ সেপ্টেম্বর নিজ কার্যালয়ে প্রথম আলোকে বলেন, পদোন্নতির ব্যাপারে কমিটির সামনে যেসব কাগজপত্র ছিল, তার ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। যোগ্য কাউকে বঞ্চিত করা হয়নি। যাঁরা পদোন্নতি পাননি, তাঁদের কেউ কেউ বঞ্চনার অভিযোগ তুলতেই পারেন।

যোগ্যতা লঙ্ঘন
অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পদোন্নতির আগে জ্যেষ্ঠতা, অভিজ্ঞতা ও প্রকাশনার ওপর ভিত্তি করে ফিট লিস্ট করা হয়। ফিট লিস্টের কাগজপত্রে দেখা যায় মো. ইকবাল কবির ১৭তম বিসিএস পাস করে ১৯৯৫ সালে চাকরিতে যোগ দেন। তাঁর পাঁচটি প্রবন্ধ আন্তর্জাতিক জার্নালে এবং তিনটি প্রবন্ধ দেশি জার্নালে ছাপা হয়েছে। কাজী শফিকুল হালিম ২০তম বিসিএস পাস করে ২০০১ সালে চাকরিতে যোগ দেন। তাঁর একটি প্রবন্ধ আন্তর্জাতিক জার্নালে ও ছয়টি প্রবন্ধ দেশি জার্নালে ছাপা হয়েছে। জ্যেষ্ঠতাসহ অন্যান্য যোগ্যতার বিবেচনায় তালিকার শীর্ষে ছিলেন চিকিৎসক ইকবাল।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে পাওয়া শফিকুল হালিমের জীবনবৃত্তান্তে দেখা যায়, তিনি পিএইচডি ডিগ্রিধারী। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তিনি এখনো পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেননি। এ ব্যাপারে শফিকুল হালিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে জমা দেওয়া কাগজপত্রে বলা আছে আমি পিএইচডি করছি।’ অন্যদিকে এপিডেমিওলজির সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পেলেও এ বিষয়ে তাঁর কোনো স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেই।
ইকবাল কবিরের এপিডেমিওলজিতে স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি ডিগ্রি—দুটিই আছে। তবে তিনি পদোন্নতি না পাওয়ার বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। শুধু বলেন, এমন ঘটনা আগেও ঘটেছে। তাঁর সঙ্গে এমবিবিএস পাস করা বন্ধুরা অনেক আগেই অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পেয়েছেন।

সার্জারিতে ফিট লিস্টে ৮০ জনের নাম আছে। পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে ৩৬ জনকে। তালিকার প্রথম তিনজন পদোন্নতি পাননি। সব মিলিয়ে ২৬ জনের ক্ষেত্রে তালিকা লঙ্ঘন করা হয়েছে।
নিউরোসার্জারিতে ফিট লিস্টে ১২ জনের নাম ছিল। পদোন্নতি হয়েছে ৬ জনের। তালিকার ৩ নম্বরে থাকা প্রার্থী ১৩তম বিসিএস পাস করা কর্মকর্তা। তাঁর পদোন্নতি হয়নি। পদোন্নতি হয়েছে তালিকার ১১ নম্বরে থাকা প্রার্থীর। তিনি ২১তম বিসিএস পাস করা কর্মকর্তা।

এ রকম অনিয়মের অভিযোগ আছে সাইকিয়াট্রি, বক্ষব্যাধি, স্ত্রীরোগ, প্রসূতিসহ প্রায় প্রতিটি শাখার চিকিৎসকের পদোন্নতির ক্ষেত্রে। পদোন্নতির কাগজপত্র প্রস্তুত করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সেই কাগজপত্রের ওপর ভিত্তি করে পদোন্নতির সিদ্ধান্ত নেয় বিভাগীয় পদোন্নতি কমিটি। পদোন্নতি পাওয়া ব্যক্তিদের ১০ সেপ্টেম্বর কর্মস্থলে যোগ দিতে বলা হয়েছিল। নতুন পদে যোগ দিয়েই তাঁদের অন্যদের থেকে জ্যেষ্ঠ হয়ে যাওয়ার কথা।
পাওয়া না-পাওয়া
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রথমত বিএনপি-সমর্থিত চিকিৎসকদের সংগঠন ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ড্যাব) সদস্য বা ড্যাবের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা আছে এমন চিকিৎসকদের পদোন্নতি হয়নি। দ্বিতীয়ত, রাজনীতি করেন না এমন চিকিৎসকেরা পদোন্নতি পাননি। তৃতীয়ত, আওয়ামী লীগ-সমর্থিত চিকিৎসকদের সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সক্রিয় সদস্য নন বা বিএমএর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নন এমন চিকিৎসকেরাও বাদ পড়েছেন।
এ ব্যাপারে বিএমএর মহাসচিব অধ্যাপক ইহতেশামুল হক চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘পদোন্নতির কিছু ক্ষেত্রে যে ব্যত্যয় ঘটেছে, তা বিএমএর নজরেও পড়েছে। আমরা মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করেছি যোগ্যদের পদোন্নতি দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় নিতে।’ আর স্বাচিপের সভাপতি অধ্যাপক ইকবাল আর্সলান বলেন, পদোন্নতির প্রক্রিয়ায় স্বাচিবের প্রভাব ফেলার কোনো সুযোগ নেই।
চাকরি শেষ
শুধু যে এবারই পদোন্নতি নিয়ে অনিয়ম হলো, তা নয়। এর আগে মেডিকেল কর্মকর্তা ও অধ্যাপকদের ক্ষেত্রেও হয়েছে। ভুক্তভোগী চিকিৎসকেরা বলছেন, ভবিষ্যতে এই প্রবণতা বন্ধ হবে তার কোনো লক্ষণ নেই। যাঁরা কম যোগ্যতা নিয়ে সহযোগী অধ্যাপক হয়েছেন, তাঁরা আবারও কম যোগ্যতা ও কম অভিজ্ঞতা নিয়ে অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পাবেন এমন আশঙ্কা আছে।
সম্প্রতি সরকারি চাকরি থেকে অবসরে গেছেন চিকিৎসক নূরজাহান বেগম। অধ্যাপক পদে তো দূরের কথা, সহযোগী অধ্যাপক পদেও তাঁর পদোন্নতি হয়নি। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার প্রকাশনাসহ সব ধরনের যোগ্যতা ছিল। শুধু সক্রিয়ভাবে রাজনীতি করতে পারিনি, মিছিল-মিটিং করিনি তাই পদোন্নতি পাইনি।’
অধ্যাপক রশীদ-ই-মাহবুব বলেন, যোগ্য মানুষ যোগ্য স্থানে যেতে না পারলে মানসিকভাবে আহত হন। তাঁরা কাজে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। তাতে সেবাবঞ্চিত হয় সাধারণ মানুষ। স্বাস্থ্য খাতে বাংলাদেশের যে অগ্রগতি হয়েছে, এ ধরনের অনিয়মের কারণে তা ব্যাহত হবে।

http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1321886