১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭, বুধবার, ১০:৫৯

নাফ নদীর শাখা নদীতে হতভাগ্য রোহিঙ্গাদের লাশ আর লাশ

বার্মা-বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকা মংডুর শাহাব বাজারে একটি লাশের নদীর সন্ধান পেয়েছে রোহিঙ্গারা। গত সোমবার বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের একটি দল গোপনীয়ভাবে তাদের গ্রামে খাদ্যদ্রব্য নিতে আসলে পথ হারিয়ে ফেলে। দুর্গম পাহাড়ি পথ মাড়িয়ে সম্মুখে যেতে যেতে একটি নদীর পাড়ে গিয়ে থামে তারা। বাতাসে দুর্গন্ধ ভেসে আসায় নদীর পাড় ধরে এগিয়ে যায় রোহিঙ্গারা। এ সময় নদীর হাঁটুজলে লাশের পর লাশ ভাসতে দেখে ভড়কে যায় দলটি। আমাদের সময়.কম/শীর্ষ নিউজ/রয়টার্স/বিবিসি।

প্রত্যক্ষদর্শী রোহিঙ্গা দলটির ভাষ্য, নারী, শিশু ও পুরুষের অগণিত লাশ পড়ে আছে ওই নদীতে। লাশের বিদ্ঘুটে পচা গন্ধ বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছে। শেয়াল-কুকুরের খাওয়া লাশের হাড়গোড় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বিলের ধারে ও নদীর পাড়ে। সব লাশই রোহিঙ্গার বলে জানান তারা। তাদের ধারণা পাঁচশো’র চেয়ে কম হবে না লাশের সংখ্যা। প্রত্যক্ষদর্শী দলটি আরো জানান, নদীটি টেকনাফের নাফ নদীর কোন শাখা নদী হতে পারে। শাহাব বাজারের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া নদিটির সাতকাইন্না পাড়া এলাকায় লাশগুলো ফেলা হয়েছে বলে আন্দাজ করছে তারা।

উল্লেখ্য, ২৪ আগস্ট থেকে শুরু হওয়া চলমান সেনাবাহিনীর গণহত্যায় হাজার হাজার রোহিঙ্গা হত্যার শিকার হয়েছে। এদের অনেকের লাশ গণকবর দিয়েছে সৈন্যরা। আবার অনেক লাশ জঙ্গলে ও লোকালয় থেকে বিচ্ছিন্ন নদীতে ফেলে দেয়। এ লাশগুলোও সৈন্যরা হত্যা পরবর্তী ফেলে দিয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সূত্র: আওয়ার ইসলাম ও আরাকান টিভি।

বাংলাদেশে ৩ লাখ ৭০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী : জাতিসংঘ
মিয়ানমারে নির্যাতনের শিকার হয়ে ২৫ আগস্ট থেকে ১২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৩ লাখ ৭০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। গতকাল মঙ্গলবার দেয়া এক বিবৃতিতে জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর এ তথ্য জানায়। এতে বলা হয়, ২৫ আগস্টে মিয়ানমার সেনাদের নতুন করে নির্যাতন শুরু হওয়ার পর প্রতিদিন হাজার হাজার মুসলিম রোহিঙ্গা নাফ নদী পার হয়ে বা দুর্গম পাহাড়ি বনাঞ্চল পেরিয়ে বাংলাদেশ সীমান্তে প্রবেশ করছে। এছাড়া রাখাইনে গত মাসে শুরু হওয়া রোহিঙ্গা নিধনে এ পর্যন্ত তিন হাজার নারী-শিশুসহ নানা বয়সের মুসলিম গণহত্যার শিকার হয়েছে বলে আন্তর্জাতিক একাধিক সংস্থার প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। এখনও সেখানে অব্যাহত রয়েছে গণহত্যা, ধর্ষণ ও রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর জ্বালাও- পোড়াও।
ঝুঁকির মুখে দুই লাখের বেশি রোহিঙ্গা শিশু
মিয়ানমার থেকে নির্যাতিত হয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে দুই লাখের বেশি শিশু ঝুঁকির মুখে আছে। জাতিসংঘের শিশু তহবিল-ইউনিসেফ গতকাল এক বিবৃতিতে এ কথা জানিয়েছে। ইউনিসেফ-বাংলাদেশের শিশু সুরক্ষা ইউনিটের প্রধান জঁ লিবির দেওয়া ওই বিবৃতিতে বলা হয়, যেভাবে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের ঢল শুরু হয়েছে তা অভাবনীয়। শুধু ৪ থেকে ১০ সেপ্টেম্বর এই ছয় দিনে ২ লাখ ২০ হাজার মানুষ এসেছে বাংলাদেশে। এ ঢল যে কমবে, এর কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে না। এটি একটি বড় মানবিক বিপর্যয় আর এর বড় শিকার হচ্ছে শিশুরা। প্রাথমিক তথ্য থেকে বলা যায়, মিয়ানমার থেকে এ যাবৎ যত রোহিঙ্গা এসেছে, এর মধ্যে ৬০ শতাংশই শিশু। গত ২৫ আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত অন্তত ৩ লাখ ৩০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছে বলেও বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়। ইউনিসেফের দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়, যেসব শিশু এসেছে, তারা কয়েক দিন ধরে নির্ঘুম। তারা ক্ষুধার্ত ও দুর্বল হয়ে পড়েছে। দীর্ঘ ও বিপদসংকুল যাত্রাপথ পাড়ি দিতে গিয়ে অনেক শিশু অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তাদের জরুরি স্বাস্থ্য পরিষেবা দরকার। পালিয়ে আসা শিশুরা অনেকেই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত বলে ইউনিসেফ জানায়। আন্তর্জাতিক সংস্থাটি মনে করে, এসব শিশুর সুরক্ষা এবং মনস্তাত্ত্বিবক সহায়তা দরকার। এখন প্রতিদিন পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের জন্য একের পর এক শিবির তৈরি হচ্ছে। এসব শিবিরে নিরাপদ পানি এবং মৌলিক স্যানিটেশন-সুবিধা দরকার বলে মনে করে ইউনিসেফ। জঁ লিবি বিবৃতিতে বলেন, ‘যেসব শিশু মা-বাবা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে, আমার বড় শঙ্কা তাদের নিয়ে। এখন পর্যন্ত আমরা ১ হাজার ১২৮ শিশু পেয়েছি, যারা মা-বাবা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে চলে এসেছে। আগামী দিনগুলোতে এ সংখ্যা আরও বাড়বে বলে আমাদের ধারণা।’

রোহিঙ্গা সংকট : ‘সীমান্তে পুঁতে রাখা মাইন পঙ্গু করে দিচ্ছে’ মানুষকে
মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসার সময় সীমান্তে পুঁতে রাখা মাইনের বিস্ফোরণে আহত হয়েছে বহু রোহিঙ্গা মুসলিম। পঙ্গু হয়ে যাওয়া ক’জনের সঙ্গে কথা বলেছে বিবিসি। ১৫ বছর বয়সী মিয়ানমারের এক কিশোরের চিকিৎসা চলছে বাংলাদেশের এক হাসপাতালে। মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসার সময় সীমান্তে পুঁতে রাখা মাইন বিস্ফোরণে দুটো পা হারিয়েছে এই কিশোর। একই হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন আরেক নারী, যিনি জানিয়েছেন সীমান্তে গুলি খাওয়ার পর মাইনের ওপর আছড়ে পড়েন তিনি।
নব্বইয়ের দশকে ওই এলাকায় মাইন পুঁতে রাখা হয়েছিল, কিন্তু সম্প্রতি মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী বাংলাদেশ সীমান্ত বরাবর নিষিদ্ধ এ্যান্টি-পার্সোনাল মাইন পুঁতেছে বলে অভিযোগ তুলে বাংলাদেশি বিভিন্ন সূত্র এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলো। যদিও মিয়ানমারের কর্মকর্তারা এই অভিযোগও অস্বীকার করেছেন।
সম্প্রতি মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর অত্যাচার-নির্যাতন থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে তিন লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা।

জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক প্রধান জেইদ রাদ আল-হুসেইন সোমবার বলেছেন, ‘মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর নিষ্ঠুর-নির্মম অভিযান চলছে। পাশাপাশি তিনি এটাও বলেছেন যে, সেখানে যে হামলা চালানো হচ্ছে তা পাঠ্য বইয়ের জন্য ‘জাতিগত নিধন’ এর একটি অন্যতম উদাহরণ হয়ে থাকবে।
বাংলাদেশে পালিয়ে আসা আহত রোহিঙ্গাদের কয়েকটি হাসপাতালে চিকিৎসা চলছে, একটি হাসপাতালে ঘুরে বিবিসির রিতা চক্রবর্তী দেখেছেন বেশিরভাগই সীমান্তে পুঁতে রাখা মাইনের বিস্ফোরণে আহত হয়েছেন। অনেকের দেহের নানা জায়গায়, কেউ হাত আবার কেউবা পা হারিয়েছেন।

১৫ বছর বয়সী আজিজুল হক, তার দুই পা হারিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন, সাথে আছে তার মা। আজিজুর ভাইও অন্য এক হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে, তারও একই অবস্থা- জানালেন তাদের মা রুশিদা হক। তাদের দেহের ক্ষত এতটাই যে আমার কাছে সেটা মৃত মানুষের মতোই। ওপরওয়ালা যদি তাদের নিয়ে যেত তাহলে ভালো হতো। ছেলেগুলো আমার অনেক কষ্ট করছে বিবিসিকে বলেন রুশিদা হক। বিস্ফোরণে আজিজুল হকের শরীর ক্ষতবিক্ষত হয়ে পড়েছে, দুটো পা নেই, এছাড়া শরীরের অন্যান্য জায়গাতেও আঘাতের চিহ্ন স্পষ্ট। আজিজুলকে বাঁচানোর প্রাণপণ চেষ্টা করছে ডাক্তাররা। কিন্তু তাকে বাঁচানোর আশা ক্ষীণ বলে জানা যাচ্ছে। কারণ আজিজুলের রক্তের গ্রুপ বিরল, ওই গ্রুপের রক্ত কোনো ব্লাড ব্যাংকে পাওয়া যাচ্ছে না। এ কদিন রক্তদাতা পাওয়া গেলেও এখন আর কোনো দাতারও সন্ধান মিলছে না।
অন্যদিকে আহত আরেক নারী সাবেকুর নাহার বিবিসিকে বলেন, মিয়ানমারে তাদের সম্প্রদায়ের লোকজনকে লক্ষ্য করে সেনাবাহিনীর অভিযান শুরুর পর তিন ছেলেকে নিয়ে নিজ গ্রাম থেকে পালান তিনি। যখন সীমান্ত পার হচ্ছিলেন তখনই গুলির আঘাতে মাইনের ওপর পড়ে যান।
আমাদের গুলী ছুঁড়লো এবং তারা মাইনও পুঁতে রেখেছিল সেটার ওপর পড়লাম- বলেন ৫০ বছর বয়সী সাবেকুর নাহার। ছোটখাট দেখতে সাবেকুরের দেহেও নানা ক্ষত রয়েছে।

http://www.dailysangram.com/post/299476