টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপের ওপারে মংড়– এলাকার গর্জনদিয়া রোহিঙ্গা মুসলিম গ্রামে আগুন দেয় মিয়ানমার বাহিনী। প্রাণভয়ে ওপার থেকে পালিয়ে আসছে রোহিঙ্গারা
১২ সেপ্টেম্বর ২০১৭, মঙ্গলবার, ১১:৩৭

রাখাইন জ্বলছে চলছে গণহত্যা

ফের মাইন বিস্ফোরণে নিহত ৪ : আজ মঙ্গলবারের মধ্যে অবশিষ্ট রোহিঙ্গাদের দেশ ত্যাগ করতে মাইকিং; মংডু নাইক্ষ্যংদিয়া পয়েন্ট থেকে ডাবল লাইনের কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ শুরু

এখনো আগুন জ্বলছে মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী জেলা মংডুর সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে। গতকাল সোমবারও নাফ নদীর এপারে শাহপরীর দ্বীপ থেকে সেখানে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়ার দৃশ্য চোখে পড়েছে। একদিকে মিয়ানমার সেনাবাহিনী মংডুর আকাশে হেলিকপ্টারে টহল দিয়ে মুসলিম পাড়াগুলো লক্ষ্য করে মর্টার সেল নিক্ষেপ করছে, অপরদিকে স্থলে সেনা সদস্যরা রাখাইনদের সহায়তায় রোহিঙ্গা মুসলমানদের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিচ্ছে। বর্বরতা থেকে বাঁচতে এখনো বানের পানির মতো রোহিঙ্গা মুসলমানরা নাফ নদী পার হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে এ দেশে প্রবেশ করা মুসলমানদের নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছে দিচ্ছে এখানকার সাধারণ মানুষ এবং কিছু স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান। তারা সহায় সম্বলহীন রোহিঙ্গা মুসলমানদের খাবার, পোশাক, চিকিৎসা, অর্থ এবং অস্থায়ী বাসস্থানের ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। শত শত মানুষ এই রোহিঙ্গা মুসলমানদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছে। তারা যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে।

রাখাইনে জ্বলছে একের পর এক রোহিঙ্গা গ্রাম : গত ২৪ আগস্ট থেকেই একের পর এক জ্বলছে রাখাইনের রোহিঙ্গা গ্রামগুলো। গতকালও সেই দৃশ্য চোখে পড়েছে। সকালে টেকনাফের শাহপরী দ্বীপের হাড়িয়াখালী ভাঙ্গার মোড়ে গিয়ে দেখা যায় দূরে মংডুর কয়েকটি গ্রামে আগুন জ্বলছে। আরো কাছে থেকে দেখার জন্য শাহপরী দ্বীপ পার হয়ে নাফ নদীর কিনারে গিয়ে দেখা যায় একের পর এক গ্রাম দাউদাউ করে জ্বলছে। জেটিতে উঠে নাফ নদীর মাঝখানে বাংলাদেশ সীমানার শেষভাগে গেলে সেই দৃশ্য আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ওই জেটির ওপরই পাওয়া যায় মংডুর গজ্জনদিয়ার রবিউল্লাহকে। তিনি নদীর ওপারের দিকে আঙুল দেখিয়ে কাঁদছিলেন। ওই সময় যে পাড়াটি জ্বলছিল সেখানেই রবিউল্লাহর বাড়ি। দিন সাতেক আগে ধনসম্পদ সবকিছু ফেলে দিয়ে সাতজনের পরিবার নিয়ে তিনি কোনোমতে বাংলাদেশ সীমানায় ঢুকে চলে আসেন টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপে। কিন্তু তার পঙ্গু ফুপু বত্তাজলকে নিয়ে আসতে পারেননি। গতকাল দুপুরে যখন তার পাড়ায় আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হয় তখন তিনি জেটির ওপরে দাঁড়িয়ে কাঁদছিলেন আর বলছিলেন সব শেষ হয়ে গেল। ওপারে যে মুসলমানরা এখনো আটকা পড়ে আছে তারা মোবাইলে জানিয়েছেন তার বাড়িঘরসহ পুরো এলাকায় আগুন লাগানোর খবরটি। রবিউল্লাহ বলেন, তাদের পাড়ায় সেনা বাহিনীর ৩০০ সদস্য ঢুকে পুরো এলাকায় পেট্রোল দিয়ে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। স্থানীয় বৌদ্ধ মগরা সেনা সদস্যদের মুসলমানদের বাড়ি চিনিয়ে দিতে সহায়তা করেছে। একই সময় আগুন জ্বলতে দেখা যায় খুইন্ন্যাপাড়া, হাইছসুরতা, বাঘগুনা ও নুরুল্লাপাড়াসহ বিভিন্ন মুসলিম পাড়ায়। একের পর এক এই পাড়াগুলোতে আগুনের লেলিহানশিখা জ্বলে উঠছিল। গজ্জনদিয়ার রবিউল্লাহ বলেছেন, তিনি জানতে পেরেছেন হেলিকপ্টারে টহল দিয়ে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সদস্যরা আকাশ থেকে মর্টারসেল নিক্ষেপ করছে মুসলিম পাড়াগুলো লক্ষ্য করে। গজ্জনদিয়ার সৈয়দ হোসেন ও মীর আহমেদ বলেন, মিলিটারিরা হেলিকপ্টারে করে উপর থেকে গুলি করে। তাদের পাড়ায় ৭৬৫টি ঘর ছিল। কোরবানির পরদিন তাদের পাড়ার সব ঘর পুড়িয়ে দেয়। এখনো সেখানে সেনা আক্রমণ চলছে। গতকাল তারা পরিবার পরিজন নিয়ে টেকনাফে আসেন।

গণহত্যা চলছেই : মিয়ানমারে মুসলিম রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন এবং গণহত্যা অব্যাহত রয়েছে। ওখান থেকে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য যারা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন তাদের অনেকেই গতকাল লোমহর্ষক সেই গণহত্যার বর্ণনা দেন। তারা বলেছেন, মানুষ ধরে গলা কেটে পেট্রোল দিয়ে আগুনে পুড়ে ফেলা হয়েছে। গুলি করে যেখানে যাকে হত্যা করা হয়েছে সেখানেই তাকে পুঁতে ফেলা হয়েছে মাটির নিচে। সেখাকার সেনাবাহিনী আর স্থানীয় মগদের কেউই মুসলমানেদের প্রতি কোনো মানবিকতা দেখাচ্ছে না।

মেরুল্লা বাহারছড়ার মো: হোসেন বলেন, তার জামাই ইউনুসকে গুলি করে হত্যার পর মাথার খুলিটি উঠিয়ে ফেলে। পরিবারের অন্য সদস্যরা গোপন স্থান থেকে এগুলো দেখছিলেন। পরে মিয়ানমার সেনাবাহিনী এবং রাখাইনরা চলে যাওয়ার পরে গোপনে জামাই ইউনুসের লাশটি নিয়ে কোনো রকমে নামাজে জানাজা শেষ করে দাফন দিয়ে পরিবারের লোকজন নিয়ে পালিয়ে চলে আসেন। সঙ্গে তার মেয়ে হুমায়রা ও তার পাঁচ দিনের সন্তানও রয়েছে। সেবরাংয়ের এক বাড়িতে শিশু সন্তান নিয়ে হুমায়রা আশ্রয় নিয়েছেন। ওই এলাকারই বাসিন্দা ছলিমুল্লাহ বলেন, স্থানীয় একজন কোরআনে হাফেজ ছিলেন, যার নাম মৌলভী এনায়েত উল্লাহ। দুর্বৃত্তরা তাকে ধরে হত্যার পরে তার যৌনাঙ্গ ও অণ্ডকোষ কেটে ফেলে। এভাবেই বর্বরতা চলছে বলে অভিযোগ করেন তারা। বাগগুনার সাইফুল বলেন, তার পরিবারের সাতজনকে নিয়ে এ দেশে আসতে পেরেছেন। তিনি মংডুর নলবনিয়ার ওয়াজিউল্লাহর বরাত দিয়ে বলেন, তার দেখা মতে অন্তত ৫০ জনকে হত্যা করা হয়েছে।
বানের পানির মতো আসছেন নির্যাতিতরা : মংডুর সাহাবপাড়ার নুরুল হকের স্ত্রী ফাতেমার কোলে আট দিনের শিশু সন্তান। শাহপরী দ্বীপ থেকে ট্রলারে সাবরাং ভাঙ্গার মুখে এসেছেন। শিশু সন্তানটি কোলে নিয়ে কোনোমতে ট্রলার থেকে নেমে রাস্তার ওপর শুয়ে পড়েন। দেখেই বোঝা যাচ্ছিল ফাতেমার শরীরে আর কিছু নেই। সাত দিনে পেটে দানাপানি পড়েনি। সন্তান কোলে এই সাত দিন হেঁটে এসে দালালদের মাধ্যমে নাফ নদী পার হয়েছেন। নিরাপদ আশ্রয়ে পা দিয়েই তিনি অচেতন হয়ে পড়েন। কিছুক্ষণ পর তার হুঁশ ফেরে। নুরুল হক ও ফাতেমার মতো গতকালও হাজার হাজার নির্যাতিত রোহিঙ্গা দলে দলে সীমান্ত অতিক্রম করেছে। এই সংখ্যা কত হবে তার হিসাব নেই কারো কাছে। তবে স্থানীয় সূত্রগুলো বলেছে, তাদের ধারণা এই শাহপরীর দ্বীপ পার হয়েই প্রতিদিন ৩০ থেকে ৫০ হাজার রোহিঙ্গা মুসলিম ঢুকছে বাংলাদেশে।

মংডুর বাহারছড়ার সলিমুল্লাহ বলেন, এভাবে তাদের মতো হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন এ দেশে আসছে। মংডুর শিকদার পাড়ার হোসেন জোহর এবং সৈয়দ হোসেন জানান, তারা একই পরিবারের মোট ১০ সদস্য টেকনাফ এসেছেন। এ রকম হাজার হাজার পরিবার আছে। তারা জানান, তাদের পাড়ায় ৪০০ এর মতো বাড়ি ছিল। অত্যাচারে অনেকেই নিহত হয়েছেন। তাদের পাড়ার অন্তত ১০ জনকে গুলি করে বা গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে। বাকি যারা ছিল প্রায় সব পরিবারই পাড়া ছেড়ে পালিয়েছে। তাদের মধ্যে ইিেতামধ্যে অনেকেই নাফ নদী পার হয়ে বাংলাদেশে পৌঁছে গেছে।
মংডুর রাজার বিলের লামার পাড়ার আমান উল্লাহ তার পুরো পরিবার নিয়ে টেকনাফ সাবরাং এসে পৌঁছেছেন গতকাল সকালে। তার মা নুর হাজাহানকে পিঠে করে বহন করছেন নাতি এনায়েত উল্লাহ। সাত দিন হেঁটে দাদীকে কাঁধে করে এভাবে বাংলাদেশে পৌঁছান এনায়েত উল্লাহ। তারা জানান, তাদের পাড়ায় ৪৯০টি ঘর ছিল। কোনো ঘরই এখন আর মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে নেই। সব ঘর মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে বর্মি বাহিনী আর মগরা। মানুষকে ধরে ধরে তারা গলা কেটে হত্যা করছে। আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিচ্ছে। আমান উল্লাহ বলেন, তাদের পাড়ার ১০০ মানুষও নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছতে পারেনি। ২৪ আগস্টই তাদের পাড়া মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে। তাদের চোখের সামনে অনেককে হত্যা করা হয়েছে।
অর্থাভাবে এখনো অনেকে আটকে আছে ও পাড়ে : নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য ছুটে আসা রোহিঙ্গা মুসলমানদের মধ্যে অনেকেই এখনো নাফ নদীর ও পাড়ে আটকা পড়ে আছে। বিশেষ করে যাদের কাছে টাকা নেই তারা নাফ নদী পার হতে পারছে না। নদী পার হতে জনপ্রতি কমপক্ষে মিয়ানমার মুদ্রায় এক লাখ এবং বাংলাদেশী টাকায় সাড়ে তিন হাজার টাকা লাগছে। যাদের অর্থকড়ি আছে তাদের পার করতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাংলাদেশী টাকায় ২০ হাজার টাকাও নিচ্ছে। আর যারা টাকা দিতে পারছে না তাদের পার করা হচ্ছে না।
নাফ নদী পার হয়ে শাহপরীর দ্বীপ এসে সাবরাং ভাঙ্গারাস্তা পর্যন্ত আসতে আরো অন্তত ১০০ টাকা লাগছে জনপ্রতি। এই টাকাও অনেকের কাছে নেই।

সহায় সম্বলহীন হয়ে ফিরছে রোহিঙ্গারা : রোহিঙ্গারা যারা নিজ ভূমি ছেড়ে এ দেশে আসছে তারা সঙ্গে কিছুই আনতে পারেনি। বিশেষ করে অর্থকড়ি-মূল্যবান মালামাল সবই ফেলে রেখে আসতে হয়েছে। নাফ নদী পর্যন্ত যারা জীবন নিয়ে কোনোমতে আসতে পারছে তাদের শরীর তল্লাশি করে সবকিছু রেখে দিচ্ছে সেখানকার দুর্র্বৃত্তরা। আর এ দেশে যখন আসছে তাদের শরীরের পোশাক ছাড়া আর অবশিষ্ট কিছুই থাকছে না। গজ্জনদিয়ার রবিউল্লাহ বলেন, তার কোটি টাকার সম্পদ ছিল। দোতলা দালান, একটি হাই-এস গাড়ি, ব্যবসা। সবকিছু ফেলে রেখে কোনোমতে শরীরের পোশাক নিয়ে এ পাড়ে আসতে হয়েছে। এখন তিনি নিঃস্ব। মন্ডুর নলবুনিয়ার মো: আলী বলেন, আসার পথে অস্ত্র দেখিয়ে ডাকাতি করে সবকিছু নিয়ে যায়। মংডুর খিলইদমের মাহমুদুল হাসান তার বৃদ্ধা মা মাছুমাকে নিয়ে টেকনাফ এসেছেন। তিনি বলেন, পরিবারের আরো তিনজন নিয়ে জীবন বাঁচিয়ে কোনোমতে এ দেশে এসেছেন। সঙ্গে কিছুই আনতে পারেননি।

সাহায্য করছে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা ও ব্যক্তি : গতকাল টেকনাফের সাবরাং এবং শাহপরীর দ্বীপ এলাকা ঘুরে দেখা যায়, বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা ও ব্যক্তি উদ্যোগে রোহিঙ্গা মুলসমানদের সাহায্য করা হচ্ছে। যে যা পারছেন সহায়তার হাত বাড়িয়েছেন অসহায় নির্যাতিত এই মানুষদের প্রতি। ১০০-৫০০ যে যা পারছেন দিচ্ছেন। কেউ তাদের অস্থায়ী ক্যাম্প করার জন্য পলিথিনসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম দিচ্ছেন। কেউ তাদের বেঁচে থাকার জন্য খাবার ও পানীয় দিচ্ছেন। আবার কেউ কেউ তাদের অর্থ দিচ্ছেন। সব মিলিয়ে যারা এ পাড়ে আসছেন নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য তারা যাতে কোনোভাবে বেঁচে থাকতে পারেন সেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন এ দেশের মানুষ। সাবরাং ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক ইউপি সদস্য আব্দুস সালাম বলেন, তারা যে যেভাবে পারছেন অসহায় মানুষকে সাহায্য করছেন।
দেখা মিলছে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যদের : বানের পানির মতো রোহিঙ্গা মুসলমানরা এ দেশে প্রবেশ করলেও তাদের নিরাপত্তার জন্য পর্যাপ্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য নেই বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয় লোকজন। গতকাল পুরো সাবরাং ও শাহপরীর দ্বীপ ঘুরে পুলিশের একজন সদস্য চোখে পড়েনি। স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনুপস্থিতির কারণে যেকোনো অঘটন ঘটে যেতে পারে। এমনকি যারা ওপারে নির্যাতিত হয়ে আশ্রয়ের জন্য এপারে আসছেন তাদের নিরাপত্তাও বিঘিœত হতে পারে।

উখিয়া (কক্সবাজার) থেকে হুমায়ুন কবির জুশান জানান, মিয়ানমার সীমান্তে ফের স্থলমাইন বিস্ফোরণে চার রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গেছে। গতকাল সোমবার সকালে মিয়ানমার সীমান্তে দিয়ে এ পারে আসার সময় তিনজন রোহিঙ্গা এবং ১২ বছর আগে থেকে বাংলাদেশে অবস্থানরত উখিয়ার চাকবৈঠা গ্রামের গুরা মিয়া সীমান্ত এলাকা থেকে গরু কিনতে গেলে ওয়ালিডং চাল বেপারির ঢালা ৪১ নম্বর পিলার এলাকায় এই ঘটনা ঘটে। তিনি উখিয়ায় অবস্থানকারী রতœা পালং ইউনিয়নের চাকবৈঠা গ্রামের আব্দুল মাজেদের ছেলে গুরা মিয়া বলে স্থানীয়রা শনাক্ত করেছেন। গতকাল সোমবার সকাল ৭টায় তার আত্মীয়স্বজনরা নিহতের লাশ উদ্ধার করেন। দুপুরে নামাজে জানাজা শেষে তার লাশ স্থানীয় কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। তার বড় ভাই আলী আহমদ জানান, আমার ভাইকে উদ্ধার করে নিয়ে আসার সময় ওখানে আরো একজন রোহিঙ্গা নাগরিকের লাশ দেখতে পেয়েছি। মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে কতুপালং বস্তিতে আশ্রয় নেয়া মংডুর সাহাব বাজার এলাকার আবুল হাসান জানান, ওয়ালিদং পাহাড়ের ৩৯-৪০ নম্বর পিলারের মাঝামাঝি এলাকায় আরো দুই রোহিঙ্গার লাশ পড়ে থাকতে দেখেছি। মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী পুরো সীমান্ত এলাকাজুড়ে রোহিঙ্গাদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে বাধা সৃষ্টি করতে স্থলমাইন পুঁতে রাখছে বলে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা জানিয়েছেন।

উখিয়া রতœা পালং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান খাইরুল আলম চৌধুরী সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, তিনি জানতে পেরেছেন তার ইউনিয়নে বসবাসকারী এক রোহিঙ্গা নাগরিক স্থলমাইন বিস্ফোরণে মারা গেছেন। এ ব্যাপারে কক্সবাজার ৩৪ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল মঞ্জুরুল হাসান খান সাংবাদিকদের জানান, তিনি এই বিষয়ে খোঁজখবর নিচ্ছেন।
কক্সবাজার (দক্ষিণ) সংবাদদাতা আরো জানান, আরাকানে ত্রিমুখী নৃশসংতা থেকে প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাশূন্য গ্রামে মাইন পুঁতছে মিয়ানমারের সেনারা। পাশাপাশি রোহিঙ্গাশূন্য গ্রামে লাল পতাকা উড়িয়ে দিয়েছে।
অপর দিকে টেকনাফের সেন্টমার্টিনের পূর্ব-দক্ষিণের মিয়ানমারের সীমান্ত ঘেঁষা নাইক্যংদিয়া থেকে ডাবল লাইনের কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের পাশাপাশি সীমান্তজুড়ে কাঁটাতারের বেড়াসংলগ্ন এলাকায় স্থলমাইন পুঁতছে সেনারা। এ ছাড়া সীমান্ত বাহিনীর পাশাপাশি সেনারা যৌথ টহল দিচ্ছে। সে দেশের রাখাইন শ্রমিকরা ইট, বালু আর রড মজুদ করছে।
পালিয়ে যাওয়া রোহিঙ্গারা পরবর্তীতে যাতে স্বদেশে ফিরতে না পারে সে লক্ষ্যেই মিয়ানমারের বাহিনী এই অপতৎপরতা শুরু করেছে বলে সীমান্তের সূত্রগুলো জানিয়েছে।

ইতোমধ্যে আরকানে চলমান নৃশংসতা থেকে প্রাণে বাঁচতে পালিয়ে আসার পথে স্থলমাইন বিস্ফোরণে অনেকেই প্রাণ হারিয়েছে। অনেকেই পঙ্গু হয়ে সীমান্তের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে। রোহিঙ্গারা আর যাতে স্বদেশে ফিরতে না পারে সে জন্য সীমান্তে কড়া সতর্ক পাহারায় মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষীরা। ফিরতে চাইলেই গুলি করছে রোহিঙ্গাদের লক্ষ্য করে। ঈদুল আজহার দিন শনিবার নো ম্যান্স ল্যান্ডে আশ্রয় নেয়া এক রোহিঙ্গা দম্পতি টেকিবনিয়ার ওয়াচিপং ফিরে যায়। পথে ওই রোহিঙ্গা দম্পতিকে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষীরা গুলি করে ও গলা কেটে হত্যা করে। পরে স্থানীয় রোহিঙ্গারা লাশ উদ্ধার করে দাফন করে।

এ দিকে শুধু রোহিঙ্গা বিতাড়ন নয়, আগ্রাসী ভূমিকা নিয়েছে মিয়ানমারের বাহিনী। তারা কথিত বাংলাভাষী, তা সে মুসলিম, হিন্দু বা খ্রিষ্টান যাই হোক না কেন, কাউকে রাখবে না। একজন রোহিঙ্গাও যাতে অবস্থান করতে না পারে এমন মিশনে কাজ করছে তারা।
আরকান রাজ্যে আজ ১২ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবারের মধ্যে অবশিষ্ট রোহিঙ্গা দেশ ত্যাগ করতে মাইকিং করে এ আহ্বান জানানো হচ্ছে। শনিবার বিকেলে শুরু হওয়া মাইকিং গতকাল সোমবার সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত চলে মংডু, রাচিদং ও বুচিদং তিনটি শহরের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। মিয়ানমার ছাড়ার মাইকিংয়ে সেনাবাহিনীর তরফ থেকে বলা হচ্ছে যে, ১২ সেপ্টেম্বরের মধ্যে মিয়ানমারে অবস্থানকারী সব রোহিঙ্গাকে দেশত্যাগ করতে হবে।
চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, মিয়ানমারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সীমান্তে পুঁতে রাখা মাইনে আহত দুই যুবকসহ আরো পাঁচ রোহিঙ্গা চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। রোববার রাতে টেকনাফের কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে তাদের চট্টগ্রামে নিয়ে আসা হয়।

আহতরা হলেন মোহাম্মদ ইউসুফ নবী, মোহাম্মদ হাসান, নূর হোসেন, মোহাম্মদ মামুন ও সোহানা। গত ১৯ দিনে মোট ৯১ জন রোহিঙ্গা চট্টগ্রাম মেডিক্যালে চিকিৎসা নিতে আসে যাদের অধিকাংশই গুলিবিদ্ধ হয়েছে অথবা বিস্ফোরণে দগ্ধ হয়েছে। এরমধ্যে দুইজন মারা গেছে।
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক জহিরুল ইসলাম বলেন, টেকনাফের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে মেডিসিন স্যঁ ফ্রঁতিয়ের (এমএসএফ) হাসপাতাল থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাদের চট্টগ্রামে আনা হয়েছে। এদের মধ্যে ইউসুফ ও হাসান সীমান্তে স্থলমাইন বিস্ফোরণে আহত হয়েছে। আর শিশু সোহানা আক্রান্ত হয়েছে হামে। এ ছাড়া শারীরিকভাবে অসুস্থ নূর হোসেন। মামুন সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন।

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/251077