খেয়ে না খেয়ে দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে আসছে রোহিঙ্গার স্রোত। এমন ধকল সামলাতে পারছে না শিশুরা।
১২ সেপ্টেম্বর ২০১৭, মঙ্গলবার, ৮:২০

দুর্গম যাত্রা, অপুষ্টি, রোগবালাই

রোহিঙ্গা শিশুরা এখন বিপন্ন

স্বামী-সন্তান নিয়ে সুখের সংসার ছিল নুরভার বেগমের। তাঁদের বাড়ি মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের তামবাজার বৈদ্যপাড়ায়। কিন্তু বাঁচার তাগিদে ৯ দিন আগে স্বামী ও দুই শিশুসন্তান নিয়ে বাড়ি ছাড়েন নুরভার। এর আগের দিন সন্ধ্যায় তাঁদের বাড়ি জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। সন্ধ্যার পর বাড়ি থেকে বের হয়ে রাতে দুর্গম পাহাড়ে লুকিয়ে ছিলেন তাঁরা। এরপর আট দিন কখনো পাহাড়, কখনো টিলাসহ বিভিন্ন স্থানে হেঁটে অবশেষে গত রবিবার সন্ধ্যায় কক্সবাজারের টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে উখিয়ায় আসেন তাঁরা।

গত ৯ দিন অনাহারে-অর্ধাহারে কেটেছে। কখনো পানি বেয়ে, কখনো সমতলে উঠে দিন পার করেছেন তাঁরা। এই কারণে অসুস্থ হয়ে পড়েন নুরভার ও তাঁর চার বছরের শিশুকন্যা ফাতেমা।
গতকাল সোমবার দুপুর দেড়টার দিকে বাংলাদেশ টেলিভিশন উখিয়া উপকেন্দ্রের বিপরীত পাশে প্রধান সড়কসংলগ্ন একটি বেসরকারি সংস্থার চিকিৎসা ক্যাম্পে মা ও মেয়েকে নিয়ে আসেন নুরভারের ছোট ভাই আবদুল জব্বার। ভাগ্নি ফাতেমাকে কোলে করে এনে সেখানকার চিকিৎসককে দেখান।

জব্বার বললেন, ‘আমার বড় বোনও (নুরভার বেগম) অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। ’
দেখা গেছে, মামার কোলে সর্দি-কাশি ও জ্বরে ছটফট করছে ফাতেমা। আর মেয়ের পাশে মাটিতে বসে আছেন মা নুরভার বেগম। মাটিতে বসে আছেন—প্রশ্ন করতেই তিনি বললেন, ‘আমি তো আর দাঁড়াতে পারছি না। ৯ দিন হেঁটেছি। যেসব জায়গা দিয়ে হেঁটেছি, পানি পার হয়ে এখানে এসেছি, সেসব জায়গায় কেউ কোনো দিন হাঁটেনি!’
কাঁদতে কাঁদতে নুরভার বলেন, ‘ওরা মানুষ নয় (মিয়ানমার সেনাবাহিনী)। মানুষ হলে এভাবে গুলি করে এত মানুষকে হত্যা করত না। রাস্তা দিয়ে আসতে পারিনি। তাহলে আজ আর এখানে আসতে পারতাম না। গুলির হাত থেকে বেঁচে এসেছি। এখন অসুস্থ হয়ে পড়েছি। আমরা মা ও মেয়ে দুজনই জ্বর ও সর্দি-কাশিতে আক্রান্ত। ’
রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রাথমিক চিকিৎসা সহায়তার এই ক্যাম্পে গিয়ে দেখা গেছে দীর্ঘ লাইন। জ্বর, কাশি, সর্দি, নিউমোনিয়াসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে অনেক রোহিঙ্গা আসছে। বেশির ভাগই নারী-শিশু। ক্যাম্পের ব্যানারে লেখা আছে, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই। ’

ওই সংস্থার স্বাস্থ্য কর্মকর্তা শাহ মোহাম্মদ নুরুল বশর বললেন, কয়েক দিন ধরে বিভিন্ন রোগে আক্রান্তের হার বেড়ে গেছে। এখন প্রতিদিন গড়ে দুই হাজারের বেশি রোগী এখানে আসছে চিকিৎসার জন্য। বেশির ভাগই নারী-শিশু।
দুপুর ১২টার দিকে কুতুপালং বাজারে একটি ফার্মেসিতে গিয়ে দেখা যায়, শফিক আলম নামে এক রোহিঙ্গা তাঁর ৯ মাসের অসুস্থ ছেলে আবদুল্লাহকে নিয়ে এসেছেন। শফিক চিকিৎসককে বললেন, গত পাঁচ দিন ধরে তাঁর ছেলে জ্বর, ডায়রিয়া ও কাশিতে ভুগছে। চিকিৎসক আবদুল মজিদ থার্মোমিটার দিয়ে পরীক্ষা শেষে জানালেন, জ্বর ১০৩ ডিগ্রি। তাত্ক্ষণিক একটি ইনজেকশন দিলেন।
নুরুল হক ও আনোয়ার বেগম তাঁদের দুই বছরের ছেলে আবদুল হাফেজকে নিয়ে এসেছিলেন একই ফার্মেসিতে। নুরুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘রবিবার রাত ২টা থেকে ছেলের জ্বর, সঙ্গে ডায়রিয়া। মিয়ানমার থেকে এখানে আসার সময় বৃষ্টিতে ভিজেছি। রোদও ছিল। এখানে আসার পর থেকে আমিও জ্বরে পড়েছিলাম। এখন ছেলের জ্বর-কাশি। ওখানে ডাক্তার কিভাবে দেখাব। প্রাণ নিয়ে এখানে এসেছি। ’
জানা গেছে, গতকাল সকাল ৭টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত এই ফার্মেসিতে প্রায় ২০০ জন রোহিঙ্গা চিকিৎসা নিতে এসেছে। বেশির ভাগই শিশু-কিশোর।
ফার্মেসির চিকিৎসক আবদুল মজিদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ঈদের আগের দিন থেকে শুরু হয়েছে রোগীর চাপ। বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রতিদিন গড়ে ৩০০-৩৫০ জন এখানে চিকিৎসা নিতে আসছে। বেশির ভাগই রোহিঙ্গা। নারী ও শিশুর সংখ্যাই বেশি। জ্বর, ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, আমাশয়সহ বিভিন্ন রোগে ভুগছে। শুধু এই ফার্মেসিতে নয়, কুতুপালং বাজারে আরো ২৭টি ফার্মেসি আছে। সবকটিতে একই অবস্থা। গত দুই দিনে রোগী আরো বেড়েছে।
খালেদা বেগম তাঁর দুই মাস বয়সী শিশু নুরুকে নিয়ে গতকাল দুপুর ১২টা ৪০ মিনিটে বালুখালী পানবাজার এলাকার একটি বেসরকারি সংস্থার কার্যালয়ে যান চিকিৎসার জন্য। খালেদা বেগম বললেন, ‘পাঁচ দিন ধরে আমার ছেলে ডায়রিয়া ও সর্দি-কাশিতে ভুগছে। ’ সেখানে নুরুকে দেখা তানভির নামে এক সেবক বলেন, ‘অতিরিক্ত শ্বাসকষ্ট রয়েছে শিশুটির। তাকে নেবুলাইজ করা প্রয়োজন। তাকে আমরা উখিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাচ্ছি চিকিৎসার জন্য। আমাদের বালুখালী ক্যাম্পে প্রতিদিন গড়ে ১৫০ জন এবং স্বাস্থ্য উপকেন্দ্রে গড়ে ৬০ থেকে ৭০ জন চিকিৎসা নিচ্ছে। এর মধ্যে বেশির ভাগই রোহিঙ্গা। ’

জীবন বাঁচাতে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের অনেকে এখন বিভিন্ন রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে। অনেকে বলেছে, দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে তাদের অনাহারে-অর্ধাহারে থাকতে হয়েছে। পানিতে সাঁতার কেটে, হেঁটে আসার সময় রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তাদের মধ্যে নারী ও শিশুরা মারাত্মক পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। গতকালও থেমে থেমে টেকনাফ ও উখিয়ায় বৃষ্টি হয়েছে। আবার বিকেলে ছিল রোদ। রোদ-বৃষ্টিতে ঠাণ্ডা-গরমে অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। উখিয়ায় সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা রোহিঙ্গাদের চিকিৎসা কার্যক্রমে এগিয়ে এলেও তাদের উন্নত চিকিৎসা প্রয়োজন।
উখিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তা ডা. মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ গতকাল সন্ধ্যায় কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মিয়ানমারের শিশু-কিশোরদের আমাদের দেশের তুলনায় অপুষ্টির হার বেশি। সর্দি, কাশি, জ্বর ও আমাশয়ে আক্রান্ত অনেক রোগী এখানে চিকিৎসা নিচ্ছে। চিকিৎসাসেবা থেকে কেউ বঞ্চিত হচ্ছে না। সবাই প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা পাচ্ছে। রোহিঙ্গারা দীর্ঘদিন ধরে ঠিকমতো খেতে পারেনি। এই কারণে পুষ্টিহীনতা রয়েছে। ’

বালুখালীর আরেকটি বেসরকারি সংস্থায় গতকাল দুপুর ২টার দিকে গিয়ে দেখা গেছে, বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশু-কিশোর। সেখানে পুষ্টিহীনতায় ভোগা ছয় মাস থেকে ৫৯ মাস বয়সী শিশুদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া প্রসূতিপূর্ব এবং প্রসূতি-পরবর্তী নারীদেরও চিকিৎসার পাশাপাশি বিভিন্ন ওষুধপত্র দেওয়া হচ্ছে।
বিকেল ৩টার দিকে বালুখালী পানবাজার এলাকার একটি ফার্মেসিতে গিয়ে দেখা যায়, সেখানেও অনেক রোগী। বেশির ভাগই রোহিঙ্গা। এ ছাড়া উখিয়ার ওই এলাকার প্রায় ১০ কিলোমিটার পথ গত দুই দিন ঘুরে রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হতে দেখা গেছে। স্থানীয়রা বলেছে, রোহিঙ্গা পরিবারগুলোর সদস্যরা এখন জ্বর, কাশি ও সর্দিতে আক্রান্ত।

 

http://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2017/09/12/541620