১২ সেপ্টেম্বর ২০১৭, মঙ্গলবার, ৮:১৬

৫৭ ধারার ৬৫ ভাগ অভিযোগই মিথ্যা

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের (আইসিটি অ্যাক্ট) বিতর্কিত ৫৭ ধারার মামলায় চলতি বছরের এপ্রিলে সিনিয়র সাংবাদিক আহমেদ রাজুকে গ্রেফতার করেছিল রমনা থানা পুলিশ। একদিনের রিমান্ডেও নেওয়া হয় তাকে। গত ২৩ আগস্ট সাইবার ট্রাইব্যুনালের রায়ে মামলাটি খারিজ হয়ে যায়, আদালত অভিযোগ থেকে খালাস দেন ওই সাংবাদিককে। মামলা না টিকলেও মাঝখানে পুলিশি রিমান্ডসহ নানা হয়রানির শিকার হতে হয় তাকে। শুধু আহমেদ রাজুর এ মামলা নয়_ আইসিটি অ্যাক্টের ৬৫ ভাগ মামলার অভিযোগের প্রমাণ না মেলায় আদালতে তা খারিজ হয়ে গেছে। তা ছাড়া পুলিশের তদন্তে অন্তত ২১ ভাগ মামলার অভিযোগের সত্যতাও মিলছে না। ঢাকায় দেশের একমাত্র সাইবার ট্রাইব্যুনাল আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর অফিস ও পুলিশ সূত্রে এসব তথ্য মিলেছে।

অবশ্য এর পরও আইসিটি অ্যাক্টে মামলা থেমে নেই। যদিও পুলিশপ্রধান গত ২ আগস্ট এ আইনের ৫৭ ধারায় মামলা নেওয়ার আগে পুলিশ সদর দপ্তরের অনুমতি নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন থানাগুলোকে। এর আগের দিনই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরে সাংবাদিক সীমান্ত খোকনের বিরুদ্ধে ৫৭ ধারায় মামলা হয়।

সাইবার ট্রাইব্যুনালের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম শামীম সমকালকে বলেন, ২০১৩ সালে ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম শুরুর পর এখন পর্যন্ত ৮২৫টি মামলা বিচারের জন্য এসেছে। এর মধ্যে ৩৭৫টি মামলার বিচার কার্যক্রম শেষ করে ট্রাইব্যুনাল রায় দিয়েছেন। যার ৩৫ ভাগ মামলার সাজা নিশ্চিত করা গেছে। অপর ৬৫ ভাগ মামলা প্রমাণ করা সম্ভব না হওয়ায় আদালত তা খারিজ করে দিয়েছেন। সাইবার ট্রাইব্যুনালে বিচারের জন্য আসা মামলার ৯০ ভাগই আইসিটি অ্যাক্টের ৫৭ ধারার মামলা।

নিজস্ব এজলাস নেই আদালতের : সাইবার ট্রাইব্যুনাল সূত্র জানায়, চলতি বছরের আগস্ট মাস পর্যন্ত আইসিটি অ্যাক্টে ৪৫০টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। গত পাঁচ বছরেও নিজস্ব এজলাস (বিচারকক্ষ) না পাওয়ায় অন্য একটি আদালতের সঙ্গে ভাগাভাগি করে সাইবার ট্রাইব্যুনাল চলছে। এতে বিচার কার্যক্রমে ধীরগতি রয়েছে, যা কাটিয়ে উঠতে মাঝেমধ্যে সন্ধ্যা পর্যন্তও বিচার কার্যক্রম চালাতে হচ্ছে। এ ট্রাইব্যুনালের নিজস্ব মালখানাও নেই।

এদিকে পুলিশ সদর দপ্তরের সাইবার ক্রাইম সম্পর্কিত মামলার পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, ২০১৩ সাল থেকে চলতি বছরের জুন মাস পর্যন্ত আইসিটি অ্যাক্টে করা মামলাগুলোর
মধ্যে ৯২৭টি মামলার অভিযোগপত্র জমা দিয়েছে পুলিশ। এসব অভিযোগপত্রের মধ্যে অভিযোগের সত্যতা না মেলায় ১৭৯ মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ, তদন্ত শেষ হওয়া মামলার ২১ শতাংশ অভিযোগেরই সত্যতা পাননি তদন্ত কর্মকর্তারা। কোনো কোনো ঘটনায় আসামির নাম-ঠিকানা না পাওয়াতেও চূড়ান্ত রিপোর্ট দেওয়া হয়েছে।
মামলা খারিজের নেপথ্যে :আইসিটি

অ্যাক্টের মামলার ৬৫ ভাগই খারিজ হয়ে যাওয়ার বিষয়ে সাইবার ট্রাইব্যুনালের পিপি নজরুল ইসলাম শামীম সমকালকে বলেন, পুলিশের তদন্তে গাফিলতির কারণে মামলাগুলোতে সাজা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। আইসিটি বিশেষজ্ঞ পুলিশ কর্মকর্তারা মামলার তদন্ত না করায় অভিযোগপত্রে অনেক ফাঁক থেকে যায়। অনেক মামলার সাক্ষীও হাজির করা সম্ভব হয় না। তিনি বলেন, আইসিটি অ্যাক্টের মামলা আপসযোগ্য নয়। তবে বিচার শুরু হলে দেখা যায়, বাদী ও আসামি কৌশলে আপস-মীমাংসা করে ফেলছেন। এতে আদালতে সাক্ষী আসছেন না, এলেও তারা সঠিকভাবে সাক্ষ্য দিচ্ছেন না। এতেও আসামি খালাস পেয়ে যাচ্ছে।

মামলা তদন্তে নেই লজিস্টিক সাপোর্ট : জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) সহেলী ফেরদৌস সমকালকে বলেন, পুলিশ একটি মামলায় সব ধরনের সাক্ষ্য-প্রমাণ ও আলামতের ভিত্তিতে আদালতে অভিযোগপত্র দেয়। তবে আইসিটি অ্যাক্টের মামলার তদন্তে তথ্য-প্রমাণ নিশ্চিত হতে ফরেনসিক ল্যাব দরকার। সেখানে বিশেষজ্ঞ দরকার। যা এখনও পুরোপুরি গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। তা ছাড়া সাইবার ক্রাইমের অভিযোগগুলোর তথ্যপ্রমাণ জোগাড় করাও কঠিন। এ ধরনের মামলা তদন্তে যে ধরনের লজিস্টিক সাপোর্ট প্রয়োজন তা নেই। তিনি বলেন, মামলার তদন্ত প্রতিবেদনে এসব সমস্যার খানিকটা ছাপ থাকলেও তদন্ত কর্মকর্তাদের গাফিলতির কথা সঠিক নয়। সমস্যাগুলো কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা চলছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের সাইবার ক্রাইম ইউনিটের একজন কর্মকর্তা সমকালকে জানান, সাইবার ক্রাইম তদন্তে তাদের অনেক লজিস্টিক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এর পরও তাদের সাইবার বিশেষজ্ঞরা এ ধরনের বিশেষায়িত অপরাধ সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে আদালতে অভিযোগপত্র দেন। অনেক ঘটনায় শাস্তিও নিশ্চিত হচ্ছে।

'আইনটিকে ভালো ব্যবহার করার সুযোগ নেই' : আইসিটি অ্যাক্টে মামলা বৃদ্ধি ও সাজা কম হওয়ার বিষয়ে ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ূয়া সমকালকে বলেন, এ আইনটিকে ভালো ব্যবহার করার সুযোগ নেই। এর বিধিব্যবস্থা মানুষকে হয়রানি ছাড়া আর কিছুই দিতে পারছে না। বিচার শেষ হওয়া অর্ধেকের বেশি মামলা আদালতে টিকছে না- এটা তারই প্রমাণ।
জ্যোতির্ময় বড়ূয়া বলেন, আইসিটি অ্যাক্টে জামিন হয় না, সাজা বেশি হয়; এসব কারণে অন্য আইনে মামলা করার সুযোগ থাকলেও শুধু ওই আইনটিতেই মামলা করা হচ্ছে। এতে মামলার সংখ্যাও বাড়ছে। রায় যাই হোক, বাদীর উদ্দেশ্যই থাকে আসামিকে যত দিন সম্ভব কারাগারে রাখা। হয়রানি করা। তা না হলে আইসিটি অ্যাক্টে এত মামলা হতো না।

অভিযোগপত্র দেওয়া গেছে মাত্র অর্ধেকের : গণমাধ্যম কর্মীসহ বিভিন্ন মহল থেকে আইসিটি অ্যাক্টের ৫৭ ধারার সমালোচনা করে তা বাতিলের দাবি জানানো হচ্ছে। পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১২ সালে সারাদেশের থানাগুলোতে এ আইনে মামলা ছিল মাত্র ১৯টি। অথচ চলতি বছরের প্রথম এক মাসেই এ আইনে মামলা হয়েছে ৩৫২টি। গত ছয় বছরে দেশে আইসিটি অ্যাক্টে করা মামলা দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৪১৭টিতে। তবে এসব মামলার মধ্যে পুলিশ মাত্র অর্ধেকটির তদন্ত শেষ করে অভিযোগপত্র দিতে পেরেছে। মামলাগুলোর মোট আসামি ২ হাজার ৮৭৩ জনের মধ্যে পুলিশ গ্রেফতার করতে পেরেছে ১ হাজার ৪৯২ জনকে।

পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, দেশে সাইবার ক্রাইম বেড়ে যাওয়ায় মামলার সংখ্যাও বাড়ছে। ফেসবুকে নারীদের নিয়ে আপত্তিকর ছবি ও অশ্লীল ভিডিও পোস্টের অভিযোগে ৫৭ ধারায় সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে। তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আপত্তিকর মন্তব্য প্রচার, অনলাইনে মানহানিকর সংবাদ প্রচারের অভিযোগেও ৫৭ ধারায় মামলা হচ্ছে। পাশাপাশি হ্যাকিং ও অনলাইনে প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে আইসিটি অ্যাক্টের ৫৫ ও ৫৬ ধারায় মামলা হয়ে থাকে।

পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানায়, ২০১২ সালে করা ১৯টি মামলার মধ্যে ১৫টিতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। ২০১৩ সালে ৪৮টি মামলার মধ্যে ৪৩টিতে, পরের বছর ১৪৯টির মধ্যে ৯৯টিতে, ২০১৫ সালে ৩০৩টির মধ্যে ২১৫টিতে, পরের বছরের ৫৪৬টির মধ্যে ৩২৭টিতে এবং চলতি বছরের জুন পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন থানায় করা ৩৫২টির মধ্যে ৪৯টিতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে।

http://www.samakal.com/bangladesh/article/1709606