পানিজট-যানজট যেন নগরবাসীর পিছু ছাড়ছে না
১২ সেপ্টেম্বর ২০১৭, মঙ্গলবার, ৭:৫৭

ফের ডুবলো রাজধানী

ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় গতকাল সোমবার সকাল সাতটা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত চার ঘন্টায় ৭৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে আবহাওয়া অধিদফতর। আর এদিনের ভারি বৃষ্টিতে ফের ডুবলো রাজধানী। পানিজটের সাথে যানজট মিলে নগরবাসীকে আরেক দফা নাস্তানাবুদ করলো। বৃষ্টি আর দুর্ভোগ নিয়ে শুরু হয় সকাল বেলা, কিন্তু এর রেশ ছিল রাত পর্যন্ত। স্কুল-কলেজ ও অফিসগামী থেকে শুরু করে খেটে খাওয়া মানুষ সকলের যাপিত জীবনে আরেকবার ধাক্কা লাগে। এর আগেও কয়েকবার ভারী বর্ষণে প্লাবিত হয়েছিল রাজধানী, সীমাহীন দুর্ভোগ-বিড়ম্বনা পোহাতে হয়েছে নাগরিকদের।

রাজধানীতে শেষ ভাদ্রে গতকাল ‘আষাঢ়ে বর্ষণ’ হয়। এদিন সকালে যেন নেমে এসেছিল সন্ধ্যা। আকাশ ছিল কালো মেঘে ঢাকা। সকাল ৭টা বাজতে না বাজতেই শুরু হয় মুষলধারে বৃষ্টি এবং বজ্রপাত। টানা এক ঘণ্টা চলে ভারি বৃষ্টিপাত। সকাল থেকে শুরু হওয়া বৃষ্টিতে সমস্যায় পড়েন অফিসগামী লোকজন ও স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা। ভারী বর্ষণের কারণে রাজধানীর বেশির ভাগ এলাকায় পানি জমে। প্রধান প্রধান সড়কগুলোতেও পানি জমে যাওয়ায় যানবাহন চলে ধীরগতিতে। পানিজটের কারণে রাস্তায় গাড়ির দীর্ঘ সারি পড়ে যায়। ফলে ভোগান্তিতে পড়তে হয় লোকজনকে। পানির কারণে হেঁটে যাওয়ারও কোনও উপায় নেই। তাই বাধ্য হয়েই গাড়িতে বসে থাকতে হয়। আবার পানি ভেঙে যানবাহনগুলোতে উঠতেও পারছিলেন না বাসস্টপে দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীরা। আবার মুষলধারে বৃষ্টি ও ধ্রিম ধ্রিম বজ্রপাতে অনেকে জরুরি প্রয়োজনেও বাসা থেকে বের হতে পারেনি বা হননি। বিকেল নাগাদ অধিকাংশ এলাকায় পানি নেমে গেলেও যানজটও ছিল প্রায় সবখানে।
চলতি মওসুমে এ নিয়ে পাঁচবার ভারি বর্ষণ দেখল রাজধানীবাসী। এসময় পানিমগ্নতায় নাগরিক দুর্ভোগও ছিল চরমে। গতকালের আগে সর্বশেষ ৩ আগস্ট রাজধানীতে তিন ঘণ্টায় ১২৩ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়। বর্ষার শুরুতে গত ১২-১৩ জুন ২৪ ঘণ্টায় ১৩৯ মি.মি. বৃষ্টি হয় ঢাকায়। ১৩ জুলাই বৃষ্টি রেকর্ড হয় ১০৩ মি.মি.। গত ২৬ জুলাই রাতে মাত্র ৬৭ মিলিমিটারের বৃষ্টিতে নগরবাসীকে পানিজট ও যানজটের তীব্রতার মুখোমুখি হতে হয়েছিল।

আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, মওসুমি বায়ু সক্রিয় থাকায় ভারী বৃষ্টিপাত হচ্ছে। শুধু রাজধানীতে নয়, সারা দেশেই মওসুমি বায়ু সক্রিয় রয়েছে। সকাল সাতটা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত টানা ৪ ঘণ্টায় ঢাকায় ৭৮ মিলিমিটার মুষল বৃষ্টিতে পানিবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। সকাল ৯টা পর্যন্ত ৬৬ মি.মি. বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। আবহাওয়ার পূর্বাভাসে আরো বলা হয়, আগামী ২৪ ঘন্টায় রংপুর, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম ও সিলেটেও ভারী বৃষ্টিপাতের আশঙ্কা রয়েছে। আবহাওয়া চিত্রের সংক্ষিপ্তসারে বলা হয়, মওসুমি বায়ুর অক্ষ রাজস্থান পাঞ্জাব , হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশ, বিহার এবং হিমালয় পাদ দেশীয় উত্তারাঞ্চল হয়ে আসাম পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। মওসুমি বায়ু বাংলাদেশের ওপর মোটামুটি সক্রিয় এবং উত্তর বঙ্গোপসাগরে মাঝারি অবস্থায় বিরাজ করছে।
বৃষ্টির কারণে এদিন রাজধানীর রামপুরা, শান্তিনগর, মালিবাগ, চৌধুরীপাড়া, মৌচাক, আরামবাগ, মিরপুর, আগারগাঁও, মতিঝিল, আরামবাগ, ফকিরাপুল, পল্টন, কাওরান বাজার, গ্রীন রোড, ইন্দিরা রোড, পুরান ঢাকার বেশকিছু স্থানে পানিবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। আগের বৃষ্টিমুখর দিনের মতো এদিনও ধানমন্ডি ২৭-এ পানি জমে যায়। অফিসকালীন সময়ে সাভার, গাবতলী হয়ে আসা গাড়িগুলো রাস্তায় ঘণ্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে আছে। এই যানজটের মধ্যে অফিস যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন ব্যাংক কর্মকর্তা গোলাম রাব্বি। তিনি বলেন, আমি কলেজ গেটে এতক্ষণ মানে এক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে ছিলাম। কোনও যানবাহন পায়নি। ভিজে যাওয়ায় এখন বাসায় ফিরে যাচ্ছি। আমার মতো অনেকেই সকাল ৮টা থেকে গাড়ির জন্য দাঁড়িয়ে ছিলেন। এই পানিজটের মধ্যে অফিসের গাড়ি কয়টায় আসবে তার ঠিক নাই। তিনি আরও বলেন, আমাদের তবু অফিসের গাড়ি আছে, সাধারণ যাত্রীরা তো গাড়িই পাচ্ছেন না। ভিজছে, এত বৃষ্টি যে ছাতায়ও কাজ হচ্ছে না।

গোলাম রাব্বি বলেন, যে কোনো ভাবে অফিস করতে হবে। ছাতা আছে তারপরও পুরো ভিজে গেছি। কী আর করার, এভাবে অফিস করতে হবে। তিনি আক্ষেপের সঙ্গে বলেন, শহরটাকে ঠিক করতে হবে।
শংকরের বাসা থেকে অফিসের গাড়ির জন্য বের হয়ে ১০ মিনিট অপেক্ষা করতেই পুরো ভিজে গেছেন বলে জানান সায়ান। তিনি বলেন, অসহনীয় হয়ে উঠছে পরিস্থিতি। আমাদের কারুরই মাথাব্যথা নাই। অফিসের জন্য বের হলাম। ভিজে একবার পোশাক চেঞ্জ করে আবারও আসলাম। ল্যাপটপ ভিজে একাকার।
ভারী বৃষ্টিতে মিরপুরের বিভিন্ন এলাকায় পানি জমে গেছে। কোথাও হাঁটু পানি, আবার কোথাও কোমর পানি জমে আছে। কালশীর দোকানি রহমান বলেন, পুরা বর্ষা ব্যবসা বলতে গেলে বন্ধ। ঈদের পর কাল দোকান খুলে দুপুরে বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছি। আজকে যে অবস্থা তাতে সারাদিনই মনে হচ্ছে দোকান বন্ধ রাখতে হবে।
মিরপুর থেকে ফার্মগেটে যাওয়ার পথে ভোগান্তিতে পড়ার কথা জানান বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা সায়মা আক্তার। তিনি সাধারণত বাসেই চলাচল করেন, তবে বৃষ্টির ফলে প্রতি বাসে উপচেপড়া ভিড়ের কারণে উঠতে পারেননি। অগত্যা তিনগুণ বেশি ভাড়ায় রিকশায় ফার্মগেইটের পথ ধরেন। তিনি বলেন, বৃষ্টি হলেই বাসে জায়গা পাওয়া যায় না। আর এ সুযোগে রিকশাওয়ালারা দাম বাড়িয়েছে।
নিউ মার্কেট ও পিলখানার বিডিআর গেইট এলাকায় প্রায় কোমর পানি জমার কথা জানান বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী ফজলুর রহমান। তিনি বলেন, নীলক্ষেতে থেকে বিজিবি গেইট পর্যন্ত কোমর পরিমাণ পানি। নিউ মার্কেটের ভেতরেও মার্কেটের ভেতরেও পানি ঢুকছে। যানবাহনের অভাবে অতিরিক্ত ভাড়ায় রিকশা ও ভ্যানে চড়ে রমনার পুলিশ কনভেনশন হলে যাওয়ার কথা জানান তিনি।
দুইবার রিকশা পরিবর্তন করে পশ্চিম রাজাবাজারের বাসা থেকে আগারগাঁওয়ের আইডিবি ভবনের অফিসে যান এটুআই কর্মকর্তা নাজমুল আলম। তিনি বলেন, বৃষ্টির কারণে পশ্চিম রাজাবাজার, পূর্ব রাজাবাজার ও ইন্দিরা রোডের বিভিন্ন সড়কে পানিবদ্ধতা তৈরি হয়। জাতীয় সংসদ এলাকার পূর্বদিকের সড়কের একটি অংশেও পানিবদ্ধ হয়।
রাস্তায় পানি জমে থাকায় মিরপুর রোড, মগবাজার থেকে মহাখালীগামী সড়ক, ডিআইটি রোড ও প্রগতি সরণিতে যানজট সৃষ্টি হয়। এই বিরূপ আবহাওয়ার মধ্যে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী আর জীবিকার তাগিদে পথে নামা মানুষকে যানবাহন না পেয়ে ভুগতে হয়। কোনো গাড়িতে উঠতে পারলেও যানজটে আটকে থাকতে হয় দীর্ঘ সময়।

ট্রাফিক দক্ষিণের উপ-পুলিশ কমিশনার রিফাত রহমান শামীম বলেন, মৎস্য ভবনের সামনে, শাহবাগ, বেইলি রোড, শান্তিনগর, আজিমপুর চৌরাস্তা, আজিমপুর, নাজিম উদ্দিন রোড এসময় এলাকায় পানি ছিল। তবে গাড়ির গতি শ্লথ। তবে একেবারে থেমে থাকে না।
আবহাওয়াবিদ মুহাম্মদ আরিফ হোসেন জানান, সক্রিয় মওসুমি বায়ুর প্রভাবে আজ মঙ্গলবার রাজশাহী, ময়মনসিংহ, ঢাকা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের কোথাও কোথাও ভারি (৪৪ মিলিমিটার - ৮৮ মিলিমিটার) থেকে অতি ভারী (>= ৮৯ মিলিমিটার) বর্ষণ হতে পারে। ভারি থেকে অতি ভারি বৃষ্টির কারণে সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের পাহাড়ী এলাকার কোথাও কোথাও ভূমিধসের শঙ্কা রয়েছে।

সেপ্টেম্বর মাসের দীর্ঘমেয়াদী পূর্বাভাসে আবহাওয়া অধিদফরের পরিচালক সামছুদ্দিন আহমেদ জানান, চলতি মাসে বাংলাদেশে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হতে পারে। তবে মাসের প্রথমার্ধে দেশের পূর্বাঞ্চলে স্বাভাবিক অপেক্ষা বেশি বৃষ্টিপাতের শঙ্কা রয়েছে। এ মাসে বঙ্গোপসাগরে ১-২ টি মওসুমি নিম্নচাপ সৃষ্টি হতে পারে বলেও পূর্বাভাস রয়েছে বলে জানান তিনি।
এদিকে দেশের অভ্যন্তরীণ নদীবন্দরসমূহের জন্য আবহাওয়া পূর্বাভাসে উল্লখ করা হয়- রংপুর, দিনাজপুর, রাজশাহী, পাবনা, বগুড়া, টাংগাইল, ময়মনসিংহ, ঢাকা, ফরিদপুর, যশোর, কুষ্টিয়া, খুলনা, বরিশাল, পটুয়াখালী, নোয়াখালী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার এবং সিলেট অঞ্চলসমুহের উপর দিয়ে দক্ষিণ/দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে ঘণ্টায় ৪৫-৬০ কিলোমিটার বেগে অস্থায়ীভাবে দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে। সেই সাথে বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। এসব এলাকার নদীবন্দরসমূহকে ১ নম্বর সতর্ক সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।

এদিকে দেশের বিভিন্ন নদীর ৯০টি পানি সমতল স্টেশনের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী ৪৫টি পয়েন্টের পানি বৃদ্ধি ও ৪২টির হ্রাস পেয়েছে। গতকাল সকাল ৯ টা পর্যন্ত পূর্ববর্তী ২৪ ঘন্টায় ৯০টি পানি সমতল স্টেশনের পর্যবেক্ষন অনুযায়ী ৭ পয়েন্টের পানি বিপদ সীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়া ৩টি পয়েন্টে অপরিবর্তিত রয়েছে। নদীর পরিস্থিতি সম্পর্কে বন্যা পূর্বভাস ও সতর্কীরন কেন্দ্রের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আজ এ কথা জানানো হয়েছে। ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, পদ্মা ও কুশিয়ারা নদীসমুহের পানি সমতল বৃদ্ধি পাচ্ছে, অপরদিকে গঙ্গা ও সুরমা নদী সমুহের পানি সমতল হ্রাস পাচ্ছে। ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদীর পানি সমতল বৃদ্ধি আগামী ৪৮ ঘন্টায় অব্যাহত থাকতে পারে। গঙ্গা নদীর পানি সমতল হ্রাস আগামী ৭২ ঘন্টায় অব্যাহত থাকতে পারে। এছাড়া আগামী ২৪ ঘন্টায় পদ্মা নদীর পানি স্থিতিশীল থাকতে পারে। গতকাল সকাল ৯ পর্যন্ত পূর্ববর্তী ২৪ ঘন্টায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া ১৫০ মিলিমিটার, ভৈরববাজার ১৪২ মিলিমিটার, পাবনা ১২২ মিলিমিটার, ঢাকা ১১৪ মিলিমিটার ও গাইবান্ধা ৯৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।

http://www.dailysangram.com/post/299390