১১ সেপ্টেম্বর ২০১৭, সোমবার, ১০:৫৯

র্যা বের হেফাজতে বন্ধু হানিফের মৃত্যু

তুলে নেওয়ার ছয় মাস পরও সোহেলের খোঁজ নেই

হানিফ মৃধা ও সোহেল হোসেনছয় মাস আগে বরিশালে চরমোনাই পীরের ওরস থেকে বাড়ি ফিরছিলেন দুই বন্ধু হানিফ মৃধা ও তাঁর বন্ধু সোহেল হোসেন (মন্টু)। পথে নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুর এলাকা থেকে গাড়িতে করে তাঁদের তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ১৬ দিন পর র্যা বের হেফাজতে হানিফ মৃধার মৃত্যু হয়। কিন্তু এখনো খোঁজ মেলেনি সোহেল হোসেনের।
২৭ ফেব্রুয়ারি হানিফ ও সোহেলকে তুলে নেওয়া হয়েছিল। র্যা ব এ ঘটনা খতিয়ে দেখার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দুই পরিবারকে আশ্বাসও দিয়েছিল। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, এ বিষয়ে র্যা ব কোনো পদক্ষেপই নেয়নি। ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিছু সিসি ক্যামেরার ফুটেজ থাকলেও তা খতিয়ে দেখা হয়নি।

হানিফের মৃত্যুর বিষয়ে র্যা ব-১ বলছে, ১৭ মার্চ র্যা ব সদর দপ্তরের ফোর্সেস ব্যারাকে আত্মঘাতী হামলার দিন রাজধানীর বিমানবন্দর এলাকা থেকে সন্দেহভাজন হিসেবে হানিফকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। র্যা ব অফিসে নেওয়ার পর বুকে ব্যথা শুরু হলে তাঁকে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে তাঁর মৃত্যু হয়। আর সোহেলের বিষয়ে তাদের কিছু জানা নেই।
যদিও হানিফের পরিবার মনে করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাই তাঁকে তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং তাঁদের নির্যাতনেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে। আর সোহেলের পরিবারের বিশ্বাস, তিনি এখনো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের কাছেই রয়েছেন।

হানিফের গাড়ির ব্যবসা ছিল। তাঁর বাড়ি বরগুনার আমতলীর আমড়াগাছিয়ায়। পরিবার নিয়ে থাকতেন রাজধানীর রায়েরবাজারের শাহ আলী গলিতে। তিন স্ত্রীর ঘরে তাঁর ছয়টি কন্যাসন্তান রয়েছে। আর সোহেল গুলশান-২ নম্বরে পুরোনো ফার্নিচারের ব্যবসা করতেন। তাঁর বাড়ি বরগুনার তালতলী থানার ছোট বাইজরা গ্রামে। স্ত্রী ও এক ছেলেকে নিয়ে থাকতেন যাত্রাবাড়ীর ধলপুরে। দুজনই হঠাৎ করে অর্থবিত্তের মালিক হন বলে তাঁদের পরিচিতজনেরা জানিয়েছেন।
হানিফ ও সোহেলের পরিবার বলছে, বরিশালে চরমোনাই পীরের মাহফিল শেষে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি হানিফ ও সোহেল লঞ্চে ফিরে আসেন। কাঁচপুর সেতুর কাছে নেমে দুজন যখন হানিফের গাড়িতে উঠতে যাবেন, তখন সাত-আটজন নিজেদের ডিবি পরিচয় দিয়ে একটি গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়। তারা হানিফের গাড়িচালক জুয়েলকে মারধর করে পূর্বাচলে ফেলে গাড়িসহ হানিফ ও সোহেলকে নিয়ে চলে যায়।

হানিফ ও সোহেলের ‘নিখোঁজের’ বিষয়ে ৪ মার্চ হানিফের ভাই মো. হালিম মৃধা সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় জিডি করেন। মো. হালিম প্রথম আলোকে বলেন, ২৭ ফেব্রুয়ারি রাতেই কালো কাচে ঢাকা একটি সাদা গাড়িতে করে র্যা ব পরিচয়ধারী কয়েকজন হানিফের রায়েরবাজারের বাসায় এসে তল্লাশি চালায়। যাওয়ার সময় তারা হানিফের মোটরসাইকেল নিয়ে যায়। এরপর১৫ মার্চ দুটি গাড়িতে করে র্যা ব পরিচয়ধারী বেশ কয়েকজন আবার আসে। তারা জানায়, হানিফ একটি অন্যায় কাজে সহযোগিতা করেছেন। এরপর হানিফের ব্র্যাক ও ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের চেক বই এনে ৬ লাখ ৭০ হাজার টাকার চেকে সই করিয়ে নেয়। এ ছাড়া হানিফের ক্রেডিট কার্ডও নিয়ে গেছে তারা। ওই কার্ডে আড়াই লাখ টাকা পর্যন্ত উত্তোলন সীমা ছিল।
হালিম বলেন, হানিফের মোটরসাইকেল নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য সিসি ক্যামেরার ফুটেজে রয়েছে। সে সময় বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে তা প্রচারও করা হয়েছিল। তা ছাড়া ব্যাংকগুলোর অধিকাংশই সিসি ক্যামেরার আওতাধীন। এসব ফুটেজ খতিয়ে দেখলেই র্যা ব পরিচয়ে যারা তাদের বাসায় এসেছিল, তাদের শনাক্ত করা যেত। কিন্তু র্যা ব বা পুলিশ কিছুই করেনি।
এদিকে সোহেলের নিখোঁজ হওয়ার এক সপ্তাহ পর তাঁর ছেলে আবির হোসেনের স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। আর্থিক অনটনের কারণে তার স্ত্রী নিপা বেগম ধলপুরের ভাড়া বাসা ছেড়ে দিয়েছেন এ মাসেই। ছেলেকে নিয়ে তিনি এখন থাকেন বরগুনায় শ্বশুরবাড়িতে।

নিপা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, প্রায়ই বিভিন্ন নম্বর থেকে ফোন করে বলে তারা সোহেলের সন্ধান জানে। কিন্তু একটি ফোনেরও সত্যতা তাঁরা পাননি। তবে তিনি বিশ্বাস করেন, সোহেল র্যা ব বা পুলিশের কাছেই আছেন। আজ হোক কাল হোক তিনি ছাড়া পাবেন।
সোহেলের মা মমতাজ বেগম ও তাঁর স্ত্রী-সন্তান গত ২০ মার্চ র্যা ব-১-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল সারওয়ার বিন কাশেমের সঙ্গে দেখা করেন। সে সময় তিনি ঘটনাটি খতিয়ে দেখার আশ্বাস দিয়েছিলেন। তবে নিপা বলেন, ওই দিনের পর র্যা বের পক্ষ থেকে কেউ তাঁদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করেনি।
জানতে চাইলে র্যা ব-১-এর অধিনায়ক সারওয়ার বিন কাশেম প্রথম আলোকে বলেন, সোহেলের খোঁজ তাঁরা করেছিলেন। কিন্তু কোনো সন্ধান পাননি। এখনো সন্ধান চলছে। হানিফের পরিবারের অভিযোগও তাঁরা খতিয়ে দেখছেন। ভিডিও ফুটেজগুলো খতিয়ে দেখা হয়েছে কি না, এমন প্রশ্নের কোনো সদুত্তর তিনি দিতে পারেননি।

http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1318956