১১ সেপ্টেম্বর ২০১৭, সোমবার, ১০:৫৮

অনুসন্ধান

বগুড়ায় পুলিশের এত বাড়ি!

বাহিনীপ্রধানের অনুমতি ছাড়া কোনো পুলিশ সদস্য নিজ জেলার বাইরে অন্য কোথাও সম্পদের মালিক হতে পারেন না। কিন্তু বগুড়ায় যাঁরা সম্পদ করেছেন, তাঁরা কোনো অনুমতি নেননি
কারও গ্রামের বাড়ি নওগাঁয়, কারও সিরাজগঞ্জে, কারও জয়পুরহাটে। কারও বা দক্ষিণাঞ্চলের জেলা ভোলায়। তবে সবারই বাড়ি বা জমি আছে বগুড়া শহরে। তাঁরা সবাই পুলিশ বাহিনীর সদস্য। চাকরিজীবনে কোনো না কোনো সময় তাঁরা বগুড়ায় থেকেছেন। বগুড়ায় থাকার সময় এসব বাড়ি বা জমি কিনেছেন। এসব সম্পদ তাঁরা নিজের নামে কেনেন না। কিনেছেন স্ত্রী, সন্তান বা পরিবারের অন্য সদস্যদের নামে। প্রথম আলোর অনুসন্ধানে এ রকম ৩৬ জন পুলিশ সদস্যের খোঁজ পাওয়া গেছে।
পুলিশ প্রবিধান অনুযায়ী, বাহিনীপ্রধানের অনুমতি ছাড়া কোনো পুলিশ সদস্য নিজ জেলার বাইরে অন্য কোথাও সম্পদের মালিক হতে পারেন না। কিন্তু বগুড়ায় যাঁরা সম্পদ করেছেন, তাঁরা কেউই কোনো অনুমতি নেননি।
বগুড়ার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কোনো পুলিশ সদস্য একবার এখানে বদলি হয়ে এলে আর যেতে চান না। বদলি ঠেকিয়ে ঘুরেফিরে একই জেলার এই থানা থেকে সেই থানায় চাকরি করেন। এভাবে দীর্ঘদিন একই থানায় থাকার কারণে মাদক ব্যবসায়ী, চাঁদাবাজ ও অপরাধীদের সঙ্গে তাঁদের সখ্য গড়ে ওঠে। এতে করে অনেকে ‘উপরি আয়ে’ আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যান। সেই অর্থ দিয়েই গোপনে জায়গাজমি বা সম্পত্তি কেনেন।
জানতে চাইলে পুলিশের মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, এভাবে কোনো পুলিশ সদস্য বা কর্মকর্তা জমি বা ঘরবাড়ি কিনতে পারেন না। এটা পুলিশ প্রবিধানের লঙ্ঘন। বাহিনীর সদস্যরা পুলিশ প্রবিধান লঙ্ঘন করে কোনো কিছু করলে তাঁদের বিরুদ্ধে অবশ্যই বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
পুলিশ প্রবিধানের ১১২ (ঙ) ধারায় বলা হয়েছে, ‘পুলিশ অফিসারগণ নিজ জেলা ব্যতীত অন্য কোনো স্থানে ইনসপেক্টর জেনারেলের পূর্বানুমতি ব্যতীত স্বনামে, স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, আত্মীয়স্বজন, চাকরবাকর বা আশ্রিত ব্যক্তির নামে বা বেনামে জমি বা অন্য কোনো স্থাবর সম্পত্তি ক্রয় করতে পারবেন না। নিজ জেলা ব্যতীত অন্য কোনো জেলায় মালিকানা থাকলেও ইনসপেক্টর জেনারেলের পূর্বানুমতি ব্যতীত তাহা বিক্রয় করিতে পারিবেন না।’ ওই ধারায় বলা হয়েছে. প্রতিবছরের মার্চ মাসে তাঁদের সম্পত্তির হিসাব কর্তৃপক্ষের কাছে দাখিল করবেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন পুলিশ কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, সম্পত্তি কেনার ক্ষেত্রে পুলিশপ্রধানের অনুমতি নেওয়ার পুরো ব্যবস্থাটি ভেঙে পড়েছে। বেশির ভাগ পুলিশ সদস্যই অনুমতি না নিয়ে গোপনে স্থাবর সম্পত্তি কেনেন। এসব নিয়ে কোনো নজরদারিও নেই।

বগুড়ায় সম্পত্তি কেনার আগে এসব কর্মকর্তা কোনো অনুমতি নিয়েছিলেন কি না, তা জানতে পুলিশ সদর দপ্তরের সংস্থাপন শাখায় যোগাযোগ করা হয়। সংস্থাপনের কর্মকর্তারা কয়েক দিন ধরে অনুমতির কাগজপত্রের খোঁজ করেন। এরপর ওই
শাখার অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক হাবিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, বগুড়া জেলা থেকে কেউ কখনো জমি, ফ্ল্যাট বা অন্য কোনো স্থাবর সম্পত্তি কেনা বা বেচার জন্য কোনো অনুমোদন চাননি। বগুড়া জেলা পুলিশ সুপারের কাছেও আবেদন পড়েনি। তিনি বলেন, অনুমোদন না নিয়ে সম্পত্তি কেনা হলে সেটা পুলিশ প্রবিধান অনুসারে অপরাধ বলে বিবেচিত হবে।
সরেজমিন খোঁজ
বগুড়া পুলিশ লাইনসের পেছনে লতিফপুর কলোনির বালুবিশা পুকুরপাড়ে ঢুকতেই চোখে পড়ে ‘ক্ষণিকের আশ্রয়’ নামের একটি পাঁচতলা বাড়ি। অন্য সব বাড়ি থেকে এর গেটের নকশায় ভিন্নতা আছে। মালিকের খোঁজ করতেই একজন বললেন, এটা পুলিশের বাড়ি।
নিচতলায় কলবেল চাপতেই এক নারী বেরিয়ে এলেন। তাঁর মুখে শোনা গেল, বাড়িটির মালিক তাঁর স্বামী পুলিশের সহকারী উপপরিদর্শক সাইফুল ইসলাম। এ বাড়িতেই তাঁদের পরিবার থাকে। তাঁর এক ছেলেও পুলিশের কনস্টেবল। আর স্বামী সাইফুল থাকেন নারায়ণগঞ্জে তাঁর কর্মস্থলে। গ্রামের বাড়ি নওগাঁ হলেও বগুড়ায় কর্মরত থাকার সময় সাইফুল এই বাড়ি করেন। জানতে চাইলে সাইফুল বলেন, ‘ভাই, বাড়ি আমি করেছি, তবে জমি আমার স্ত্রীর নামে।’ নিজে আয়কর দেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা ছোট কর্মচারী, আয়কর আর কী দিব?’

বগুড়া সদর থানা ও শাজাহানপুর থানার সাবেক পরিদর্শক (তদন্ত) আতিয়ার রহমানের বাড়ি জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল উপজেলায়। বর্তমানে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ থানায় ওসি হিসেবে তিনি কর্মরত। বগুড়ায় থাকার সময় শহরের ফুলবাড়ী এলাকায় বেশ কিছু জায়গা কেনেন। জানতে চাইলে আতিয়ার রহমান, তাঁর বাবা ৬ শতক জায়গা কিনেছেন। তাঁর নিজের কোনো বাসা বা জায়গা নেই।
গাবতলী মডেল থানা ও শিবগঞ্জ থানার সাবেক ওসি আবদুর রশিদ সরকারের বাড়ি সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে। এখন তিনি র্যা ব সদর দপ্তরে আছেন। বগুড়া শহরের নুরানী মোড় এলাকায় একটি বাড়ি করেন তিনি। জানতে চাইলে রশিদ সরকার বলেন, ‘বগুড়ায় বদলি হওয়ার আগেই আমার স্ত্রী বাড়িটি করেছেন। এই বাসার মালিক আমি নই।’
বগুড়া সদর ও নন্দীগ্রাম থানায় ওসির দায়িত্বে ছিলেন হাসান শামিম ইকবাল। বর্তমানে বগুড়া সিআইডির এএসপি পদে কর্মরত। শহরের জলেশ্বরীতলা এলাকায় দুটি ফ্ল্যাট কিনেছেন তিনি। তবে জানতে চাইলে বলেন, ‘দুটি নয়, আমার একটি ফ্ল্যাট আছে। মেয়ের পড়ালেখা ও স্ত্রীর অসুস্থতার জন্য এটা কিনেছি।’

শহরের জহুরুলনগর এলাকায় ‘শাহাব ভিলা’ নামের পাঁচতলা বাড়ি নির্মাণ করেছেন বগুড়া সদর থানা ও মোকামতলা তদন্তকেন্দ্রের সাবেক এসআই আবদুর রাজ্জাক। তিনি নওগাঁ সদর থানায় কর্মরত। ওই বাসায় গেলে তাঁর ছোট ছেলে শাহাব বলেন, তাঁর বাবা বাসায় নেই, কর্মস্থলে আছেন। ফোনে যোগাযোগ করা হলে এসআই রাজ্জাক বলেন, সারা জীবনের সঞ্চয় দিয়ে তিনি আড়াই শতক জমি কিনে বাড়িটি করেছেন। তাঁর স্ত্রীও বগুড়া শহরে চাকরি করেন। তিনি ছাড়া তাঁর শ্বশুরবাড়ির লোকজনও এই বাড়িতে থাকেন।

গাবতলী মডেল থানার ওসি খায়রুল বাশার এর আগে বগুড়া সদর থানায় টহল উপপরিদর্শক (সদর ফাঁড়ি পুলিশ) ছিলেন। ওই সময় তিনি গণ্ডগ্রামে একটি বাড়ি করেন। শহরের আলতাফুন্নেছা খেলার মাঠসংলগ্ন জলেশ্বরীতলায় একটি ফ্ল্যাটও কিনেছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বাড়ি কোথায় দেখলেন? এটা তো একটা টিনশেড। দুটো রুম। তা-ও আমার শ্বশুর মিসেসকে দিয়েছেন। জলেশ্বরীতলার ফ্ল্যাট তো আমার শ্বশুরের।’
বগুড়া সিআইডির পরিদর্শক আবদুল মান্নানের বাড়ি ভোলা জেলায়। বগুড়ায় ডিবি ও শাজাহানপুর থানায় ওসি হিসেবে দীর্ঘদিন কর্মরত ছিলেন তিনি। বগুড়া পৌরসভা-সংলগ্ন জেলখানা সড়কে গাজী টাওয়ারের ছয়তলায় একটি ফ্ল্যাট এবং শহরের মালতিনগর এলাকায় ৫ শতাংশ জমি আছে তাঁর। জানতে চাইলে মান্নান বলেন, ‘আমি বাড়ি করিনি। মালতিনগরে একটা জমি কিনেছি, সেটাও পাঁচ শতক মাত্র।’

বগুড়ার সাবেক এসআই সানোয়ার হোসেন বর্তমানে নওগাঁ জেলার ধামইরহাট থানার পরিদর্শক (তদন্ত) হিসেবে কর্মরত। মোকামতলা তদন্তকেন্দ্রের ইনচার্জ থাকাকালে নাশকতার মামলায় গ্রেপ্তার-বাণিজ্যের অভিযোগ ওঠে তাঁর বিরুদ্ধে। শহরের লতিফপুর এলাকায় দুটি বাড়ি ও ফুলতলা এলাকায় কিছু জমি কেনেন তিনি। জানতে চাইলে এসআই সানোয়ার বলেন, ‘ফুলতলায় শাশুড়ি বাড়ি করেছেন, ওটা আমার বাড়ি নয়। আমি লতিফপুরের বাসায় ভাড়া থাকি ১২ বছর।’
নন্দীগ্রাম থানার সাবেক ওসি ফাসির উদ্দিন দীর্ঘদিন ধরে বগুড়ায় চাকরি করেছেন। নন্দীগ্রামে থাকার সময় মামলা নিয়ে বাণিজ্য করার অভিযোগে তাঁকে প্রত্যাহার করা হয়েছিল। বগুড়ায় থাকার সময় তিনি শহরের রহমাননগর এলাকার অ্যামিকাস হাউজিংয়ে একটি ফ্ল্যাট কেনেন। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ফ্ল্যাটটা আমার শাশুড়ির। শ্বশুর মারা গেছেন। শাশুড়ি একা থাকতে পারেন না। তাই খুলনার জমি বিক্রি করে উঠলেন আমার সঙ্গে। ওনার তো আর কেউ নেই। আমার মিসেস আর একটা মেয়ে। সে কানাডায় থাকে।’

নাশকতার মামলার আসামির কাছ থেকে ঘুষ হিসেবে জমি নিয়ে সমালোচিত হয়েছিলেন তৎকালীন শাজাহানপুর থানার ওসি মাহমুদুল আলম। জামায়াত নেতার নাম অভিযোগপত্র থেকে বাদ দেওয়ার কথা বলে তিনি পাঁচ শতক জমি লিখে নেন। তবে সেই জমির দলিল করা হয় ওসির দুই ভাই মাহবুবুর রহমান তালুকদার ও শাহিন রেজার নামে। এ নিয়ে ২০১৩ সালের ২২ ডিসেম্বর প্রথম আলোয় একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে মাহমুদুল আলমকে বরিশাল রেঞ্জে প্রত্যাহার করা হয়।
বগুড়া সদর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আছলাম আলীর বাড়ি নওগাঁ জেলায়। একই থানায় প্রথমে উপপরিদর্শক এবং পরে পরিদর্শক হিসেবে পাঁচ বছরের বেশি সময় আছেন তিনি। শহরের মাদক ব্যবসায়ী মতিন-তুফানের সঙ্গে তাঁর সখ্যের অভিযোগ আছে। সম্প্রতি বগুড়া শহরের লতিফপুর জামিল মাদ্রাসার পেছনে ৫ শতাংশ জমি কিনেছেন তিনি।
জানতে চাইলে আছলাম আলী বলেন, তাঁর কোনো ফ্ল্যাট নেই। ১২ জন মিলে ১০ শতক জমি কিনেছিলেন। তবে জমি কিনলে যে অনুমতি নিতে হয়, সেটা জানা ছিল না।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, উত্তরাঞ্চলের ১৬টি জেলার প্রবেশদ্বার হলো বগুড়া। এসব জেলার সব ধরনের যানবাহন চলে বগুড়ার ওপর দিয়ে। এই যানবাহন থেকে তোলা চাঁদার ভাগ পুলিশের কাছেও আসে। আরও আছে মাদক ব্যবসা, বছরজুড়ে জুয়া চালানো এবং ব্যাটারিচালিত রিকশা থেকে তোলা চাঁদার অর্থ। এমনও উদাহরণ আছে, একজন কনস্টেবল বা এএসআই এই জেলায় যোগদান করে থানার ওসি পর্যন্ত হয়েছেন, কিন্তু জেলা ছাড়েননি।

বগুড়ায় ছাত্রী ধর্ষণ মামলার আসামি শ্রমিক লীগের বহিষ্কৃত নেতা তুফান সরকার, তাঁর ভাই তালিকাভুক্ত মাদক ব্যবসায়ী মতিন সরকারের সঙ্গেও এ রকম অনেক পুলিশ কর্মকর্তার দহরম-মহরমের অভিযোগ রয়েছে। তাঁরা পুলিশকে হাত করে দিনের পর দিন মাদক ব্যবসা চালিয়ে গেছেন। কিন্তু ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারা সেই অভিযোগ কানে তোলেননি।
যোগাযোগ করা হলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, সবাই চলছে নিজের মতো করে। আইন আছে কিন্তু তার প্রয়োগ হচ্ছে না, এ কারণে কেউ আর আইনের তোয়াক্কাও করছেন না। আসলে যাঁরা আইন প্রয়োগ করবেন, তাঁরা নিজেরাই এসব করে এসেছেন। এখন তাঁরা কী করে প্রতিরোধ করবেন?

http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1318711