১১ সেপ্টেম্বর ২০১৭, সোমবার, ১০:৫৪

কমিশন গঠন ফাইলবন্দি

নিয়ন্ত্রণহীন ব্যাংকিং খাত

সরকারি কয়েকটি ব্যাংকে বিপর্যয় বেশি, যেন দেখার কেউ নেই * সম্ভবত খোদ অর্থ মন্ত্রণালয়ই কমিশন গঠন করতে চাইছে না

কোনোভাবেই ব্যাংকিং খাতের অনিয়ম-দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। আর সরকারি ব্যাংক হলে তো কথা-ই নেই। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ঋণের নামে ইচ্ছেমতো লুটপাট চলছে। নিয়মনীতির তোয়াক্কা নেই। যার অনন্য দৃষ্টান্ত বেসিক ব্যাংক। প্রতিষ্ঠানটির সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চুর কারণেই অত্যন্ত শক্তিশালী এ ব্যাংকটি আজ দেউলিয়ার পথে।

এভাবে শুধু বেসিক ব্যাংক নয়, বাচ্চুদের মতো প্রভাবশালীদের কারণে পুরো ব্যাংকিং খাত বিপর্যস্ত। কিন্তু বড় বিস্ময়, ব্যাংক লুটপাটকারী দুর্নীতিবাজদের শাস্তি হয় না। এসব ব্যাংকখেকোর খুঁটির জোর কোথায়, তা আজও অজানা ও রহস্যঘেরা।

আর বেসরকারি ব্যাংকের ঋণ পরিচালকরা ভাগ-বাটোয়ারা করে নিয়ে যাচ্ছেন। ১০ বছর আগে যা কল্পনায়ও আসেনি। অথচ আজ অবলিলায় তা হচ্ছে। রক্ষকদের সহায়তায় দেদার টাকা পাচারের অভিযোগ তো আছেই।

এ অবস্থায় ব্যাংক বিশ্লেষকদের দাবির মুখে এক বছর আগে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ব্যাংকিং খাতের আমূল সংস্কারে স্বাধীন কমিশন গঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। জানিয়েছিলেন মহাপরিকল্পনার কথা। কিন্তু আজও আলোর মুখ দেখেনি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, খবরদারি কমে যাওয়ার ভয়ে কমিশন গঠনের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হয়নি। এক্ষেত্রে পরিকল্পনার ‘পরী’ উড়ে গেছে, পড়ে আছে শুধুই কল্পনা।

এদিকে অর্থ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটিও এখন ক্লান্ত। ব্যাংকিং খাতের অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধে তাদের সুপারিশ এখন বিশাল স্তূপাকার ধারণ করেছে। কিন্তু বাস্তবায়ন হয়নি। সংসদীয় কমিটি পরিণত হয়েছে ঠুঁটো জগন্নাথে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এ দুরবস্থা উত্তরণে কমিশন গঠনে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। না হলে ভবিষ্যতে ব্যাংকিং খাতের জন্য আরও খারাপ সংবাদ অপেক্ষা করছে। তাদের মতে, দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যাংকগুলো পুঁজি হারিয়ে ধসে পড়লে দেশের অর্থনীতিতে বিপর্যয় নেমে আসবে। সাধারণ আমানতকারীরা বিপাকে পড়বেন। তাই সবার আগে ঋণখেলাপিদের দ্রুত শাস্তির আওতায় আনাসহ ঋণ জালিয়াতি ও অর্থ পাচারের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের প্রত্যেককে আইনের আওতায় আনতে হবে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ যুগান্তরকে বলেন, ব্যাংকিং খাতে একটি স্বাধীন কমিশন গঠনের দাবি বহু পুরনো। দেশের প্রায় সব অর্থনীতিবিদ এ দাবি করে আসছেন। সম্ভবত খোদ অর্থ মন্ত্রণালয়ই কমিশন গঠন করতে চাইছে না। কারণ কমিশন গঠন করলে সরকারি ব্যাংকের টাকা-পয়সা লুটপাট করা যাবে না। এ ছাড়া দলীয় লোকজন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে অর্থের অপব্যবহার করুক, সেটাই তারা বেশি চায়। খেলাপি ঋণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বেসরকারি ব্যাংকে খেলাপি ঋণ পাঁচ শতাংশের সামান্য বেশি।

অথচ সরকারি ব্যাংকে ৩০ শতাংশ ছাড়িয়েছে। এতে বোঝা যায়, সরকারি ব্যাংক খুবই অপেশাদারভাবে পরিচালিত হচ্ছে। সেটার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয় বা অর্থমন্ত্রীই দায়ী। কারণ সরকারি ব্যাংকে পরিচালনা পর্ষদসহ এমডি, চেয়ারম্যান ও ডিএমডিদের নিয়োগ দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। তারা সঠিক লোক নিয়োগ দিচ্ছে না বলে সরকারি ব্যাংক সঠিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে না। এসব খারাপ লোক বছরের পর বছর কাজ করে মন্দমানের খেলাপি ঋণের পাহাড় গড়েছে। অথচ তাদের বিরুদ্ধে অর্থ মন্ত্রণালয় প্রশাসনিকভাবে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়নি।

আর এখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্ষমতা খর্ব করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের বোর্ড, চেয়ারম্যান, এমডি ও ডিএমডির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না। সরকারি-বেসরকারি সব ব্যাংকের কাজ যেহেতু অভিন্ন, তাই সব ব্যাংকের নিয়ন্ত্রক সংস্থাও একই হওয়া উচিত। সরকারি ব্যাংককেও ব্যাংক কোম্পানি আইনের ৪৬ ধারার আওতায় আনতে হবে। বর্তমানে এ ধারার আওতায় শুধু বেসরকারি ব্যাংক রয়েছে। ব্যাংকের এমডি, ডিএমডি এবং বোর্ডসহ চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে কোনো গুরুতর অপরাধ প্রমাণিত হলে তখন ৪৬ ধারা প্রয়োগ করে তাদের অপসারণ করা হয়। এটি বাস্তবায়ন করা গেলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের কোনো প্রয়োজন হবে না। কারণ বিভাগটি হওয়ার পর থেকে সরকারি ব্যাংকের অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে। এসব ব্যাংকে খেলাপি ঋণের পাহাড় গড়ে উঠেছে। তাই বলা যেতে পারে, বিভাগটি পুরোপুরি অকার্যকর। এ ছাড়া বিভাগটি থাকলে ব্যাংকিং খাতে এক ধরনের দ্বৈত শাসন চালু থাকে। তিনি বলেন, দ্বৈত শাসনের ফল কখনও ভালো হয় না। সে কারণে সরকারি-বেসরকারি সব ব্যাংকের ক্ষেত্রে একই আইন জরুরি। তা না হলে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়।

প্রসঙ্গত, ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় একটি ব্যাংকিং কমিশন গঠনের কথা বলেছিলেন অর্থমন্ত্রী। কিন্তু সেই কথা রাখেননি তিনি। এর কিছু দিন পর এক অনুষ্ঠানে ‘ব্যাংকিং কমিশন করার কোনো ইচ্ছা নেই’ বলেও ঘোষণা দেন অর্থমন্ত্রী। তবে গত জানুয়ারিতে সোনালী ব্যাংকের এক অনুষ্ঠানে তিনি ফের বলেন, এ সরকারের শেষ সময়ে ব্যাংকিং কমিশন গঠন করা হবে।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, সদিচ্ছা না থাকলে কমিশন গঠন করেও লাভ হবে না। কারণ এর আগে পুঁজিবাজার কেলেঙ্কারির ঘটনায় খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের রিপোর্ট এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনায় ড. মোহাম্মদ ফরাস উদ্দিনের রিপোর্ট আলোর মুখ দেখেনি। তাহলে শুধু কমিশনে কাজ হবে না।

বরং উচ্চপর্যায়ের রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি দরকার।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, সরকারি ব্যাংকের পরিচালনায় মৌলিক কোনো পরিবর্তন না এলে সমস্যা কাটবে না। মূলত খেলাপি ঋণ ব্যাংকিং খাতের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।

অর্থনীতিবিদরা আরও বলছেন, জালিয়াতির মাধ্যমে ব্যাংকের টাকা যাচ্ছে দুর্বৃত্তদের পকেটে। ফলে লাগামহীনভাবে বাড়ছে খেলাপি ঋণ। এসব ঋণের মেয়াদ পাঁচ বছর পূর্ণ হলেই তা অবলোপন (রাইট অফ) করা হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, এসব কাজে সহায়তা করছেন ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী ও পরিচালনায় জড়িতরা। আর মূলধন ঘাটতির মাধ্যমে ব্যাংকগুলো দিনের পর দিন পঙ্গুত্বের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে এসব ব্যাংককে বাঁচাতে প্রতিবছরই বাজেট থেকে হাজার হাজার কোটি মূলধন সহায়তা দেয়া হচ্ছে। সরকারি সংস্থার প্রতিবেদনেও এ তথ্য উঠে এসেছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক এর দায়ভার নিচ্ছে না। কারণ এ ব্যাংকগুলোর নিয়ন্ত্রণ অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের হাতে।

জানা গেছে, ২০০৩-২০০৪ সালে ব্যাংকিং খাত সংস্কারের জন্য একটি কমিটি গঠন করে সরকার। ওই কমিটির বেশিরভাগ সুপারিশই বাস্তবায়ন হয়নি। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানিত ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য যুগান্তরকে বলেন, সরকারি ব্যাংকে ঋণের নামে জনগণের করের হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে। সেই ঋণ আদায় না করে, বাজেট থেকে আবারও মূলধন দেয়া হচ্ছে। এটি নৈতিকভাবে অন্যায়। অর্থনীতির কোনো নীতিমালার মধ্যে পড়ে না। তিনি বলেন, ‘ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধনের জন্য ২০০৩-০৪ সালে ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। কমিটিতে আমিও ছিলাম। ওই সময় কমিটির সুপারিশে যেসব কথা বলেছিলাম তার বেশিরভাগই বাস্তবায়ন হয়নি। এ কারণে ব্যাংকের আজকের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।’ তিনি বলেন, সরকারি ব্যাংকে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা ও লুটপাটের জন্য ঋণের টাকা ফেরত নেয় না।

এটি দিয়ে বোঝা যাচ্ছে, এ অর্থনীতিতে ক্ষমতাসীনরা শক্তিশালী, প্রভাবশালী অর্থনৈতিক ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও দলীয় শক্তি কাজ করে।

সূত্র বলছে, রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যাংকের চেয়ারম্যান, পরিচালক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নিয়োগ দেয়া হয়। এতে সেক্টরটিতে ব্যাপকভাবে দুর্নীতি-লুটপাট হয়। ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল ছিল ব্যাংকিং খাতের ‘অন্ধকার যুগ’ বা দুর্দশাগ্রস্ত সময়। এ সময় হলমার্ক কেলেঙ্কারি, বিসমিল্লাহ গ্রুপের ঋণ জালিয়াতি, বেসিক ব্যাংকে ব্যাপক হারে লুটপাট হয়। এ ছাড়া বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকে ঋণ অনিয়ম ও রূপালী ব্যাংকেও ঘটে ঋণ জালিয়াতির ঘটনা। এতে ঋণ শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ায় প্রতিবছর সম্পদ আটকে যাচ্ছে ব্যাংকগুলোর। আদায় না হওয়ায় খেলাপি ঋণের পাহাড় জমছে। ঋণ অনাদায়ী থাকায় ব্যাংকগুলোর আয় কমছে।

জানা গেছে, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোয় সবচেয়ে বড় সমস্যা খেলাপি ঋণ। বর্তমানে ৬ ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৩২ হাজার কোটি টাকা, যা ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের ২৭ শতাংশ। আগের বছর যা ছিল ২০ শতাংশের নিচে। অর্থাৎ প্রতিবছরই খেলাপি ঋণের হার বাড়ছে। এর মধ্যে বর্তমানে সোনালী ব্যাংকেই খেলাপি ঋণ ১০ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। এ ছাড়াও রূপালী ব্যাংকে ৪ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা, বেসিক ব্যাংকে ৭ হাজার ২৩০ কোটি ও বিডিবিএলের ৭১৬ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ রয়েছে। এ ছাড়া অবলোপন করা হয়েছে আরও ২০ হাজার কোটি টাকা। আর এসব খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি বাড়ছে। বর্তমানে ৬ ব্যাংকের প্রভিশন (নিরাপত্তা সঞ্চিতি) ঘাটতি ৭ হাজার ৩৬০ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুসারে চলতি বছরের জুন শেষে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ৩১৮ কোটি টাকা। এ ছাড়া সোনালী ব্যাংকের ঘাটতি ২ হাজার ৬১৯ কোটি টাকা, বেসিক ব্যাংকের ঘাটতি ২ হাজার ২১০ কোটি, রূপালী ব্যাংকের ৭৪১ কোটি ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের ৭১০ কোটি টাকা। আর এসব ঘাটতি মেটাতে চলতি বছরের শুরুতে সরকারের কাছে সাড়ে ১৪ হাজার কোটি টাকা চেয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো।

কারণ ঘাটতিতে থাকায় এসব ব্যাংক দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যবসা করতে পারছে না। তাই এ সারির ব্যাংকগুলোকে বাঁচাতে প্রতিবছরই সহায়তা দেয়া হচ্ছে। এর মধ্যে সরকার মূলধন সহায়তা হিসেবে ২০১১-১২ অর্থবছরে বরাদ্দ দেয় ৩৪১ কোটি টাকা, ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৫৪১ কোটি, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৫ হাজার কোটি, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৫ হাজার ৬৮ কোটি টাকা। এছাড়া সরকার ২০১৫-১৬ অর্থবছরে মূলধন জোগান দেয় ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা ও ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দিয়েছে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা। তবে ব্যাংকগুলো চেয়েছিল সাড়ে ১৪ হাজার কোটি টাকা। আবার চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটেও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর জন্য দুই হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।

 

https://www.jugantor.com/online/economics/2017/09/11/57596