১১ সেপ্টেম্বর ২০১৭, সোমবার, ১০:৫৩

ছোট প্রকল্পে বড় দুর্নীতি

ফগ লাইট কেনার নামে ভয়াবহ জালিয়াতি!

জড়িত বর্তমান ও সাবেক চেয়ারম্যান প্রকল্প পরিচালকসহ ক্রয় সংশ্লিষ্টরা

রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্পোরেশনের (বিআইডব্লিউটিসি) ‘সার্চ ও ফগ লাইট’ কেনার নামে চাঞ্চল্যকর অনিয়ম ও জালিয়াতির তথ্য পাওয়া গেছে। ঘন কুয়াশা ও ভারি বৃষ্টির মধ্যেও ফেরি চলাচলের জন্য মূলত ১০ সেট ‘সার্চ ও ফগ লাইট’ কেনার উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু বাস্তবে কেনা হয়েছে শুধু সার্চ লাইট। ফগ লাইটগুলোর মানও ভালো নয়। এছাড়া পাইলট প্রকল্প হিসেবে ৬ সেট ফগ লাইট কেনার কথা থাকলেও তা বাড়িয়ে ১০ সেট করা হয়। এতে সরকারের ৬ কোটি টাকা গচ্চা গেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এসব লাইট শিমুলিয়া (মাওয়া)-কাঠালবাড়ি এবং পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া রুটে চলাচলকারী ১০টি ফেরিতে লাগানো হয়েছে। এসব লাইট ব্যবহার করে ঘন কুয়াশায় এক ঘণ্টাও ফেরি চলাচল করতে পারেনি। এসব লাইট কেনায় দুরভিসন্ধি, অদক্ষতা ও দুর্নীতি ছিল বলে পর্যবেক্ষণ দিয়েছে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়।

জানা গেছে, ফগ লাইট কেনার প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংস্থাটির সাবেক চেয়ারম্যান মো. মিজানুর রহমান, বর্তমান চেয়ারম্যান প্রকৌশলী ড. জ্ঞান রঞ্জন শীল, ক্রয়ের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা জিএম (মেরিন) ক্যাপ্টেন শওকত আলী সরদারসহ সংশ্লিষ্টরা জড়িত ছিলেন। ক্রয় প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ১৫ দিনের সময় বেঁধে দিয়ে সম্প্রতি নির্দেশ দিয়েছে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়। কিন্তু নানা অজুহাতে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি সংস্থাটি। প্রকৃত দোষীদের বাঁচাতে চলছে নানা তৎপরতা। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোতে পাওয়া গেছে উপরোক্ত সব তথ্য।

এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে বিআইডব্লিউটিসির চেয়ারম্যান প্রকৌশলী ড. জ্ঞান রঞ্জন শীল যুগান্তরকে বলেন, ফগ লাইট কেনার ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে মন্ত্রণালয়ের চিঠি পেয়েছি। ওই চিঠি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়ার লক্ষ্যে সংশ্লিষ্টদের নোটিশ দেয়া হয়েছে। এটি চলমান প্রক্রিয়া। ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘...ফগ অ্যান্ড সার্চ লাইট ক্রয়ের মূল উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়েছে এবং এই ক্রয়ে সরকারের যে অর্থ ব্যয় হয়েছে তা সম্পূর্ণরূপে অপচয়- যা আর্থিক বিধি-বিধানের পরিপন্থী। এবং এই ক্রয় বিআইডব্লিউটিসির দুরভিসন্ধি, অদক্ষতা, দুর্নীতি ও অসদাচরণের আওতাভুক্ত’। এতে আরও বলা হয়েছে, এ ক্রয়ের দায়-দায়িত্ব তৎকালীন দফতর প্রধান (সাবেক চেয়ারম্যান মো. মিজানুর রহমান), প্রকল্প পরিচালক এবং টেকনিক্যাল শাখা ও সংশ্লিষ্ট অন্যরা কোনোমতে এড়াতে পারেন না।
নথিপত্র পর্যালোচনা ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, ঘন কুয়াশার মধ্যে ১০ কিলোমিটার নৌপথ দেখা যাবে এমন যুক্তি দেখিয়ে বিআইডব্লিউটিসি ফগ অ্যান্ড সার্চ লাইট কেনার অনুমতি নেয়। কিন্তু সংস্থাটি ফগ লাইটের পরিবর্তে শুধু সার্চ লাইট কিনেছে। লাইটের গায়ে, এ্যাডাপটার ও কন্ট্রোল সুইচ সবখানে স্পষ্ট সার্চ লাইট লেখা রয়েছে। তবুও সেগুলো ফগ অ্যান্ড সার্চ লাইট হিসেবে দেখিয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে ৬ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে, যার পুরোটাই গচ্চা গেছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, যার (চেয়ারম্যান) বিরুদ্ধে অভিযোগ তাকেই চিঠি দিয়ে ব্যবস্থা নিতে বলেছে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়। তিনি বলেন, এসব লাইট যখন কেনা হয়, তখন সংস্থাটির চেয়ারম্যান হিসেবে মো. মিজানুর রহমান এবং তৎকালীন পরিচালক (কারিগরি) ছিলেন প্রকৌশলী ড. জ্ঞান রঞ্জন শীল। তারা দু’জনই ক্রয় প্রক্রিয়ার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। ফগ লাইট কেনার বিষয়ে এ দু’জন কর্মকর্তাসহ চারজন প্রি-শিপমেন্ট ইন্সপেকশন (পিএসআই) করতে আমেরিকা গিয়েছিলেন। তারা ফিরে এসব লাইট স্থানীয়ভাবে টেস্ট করে সন্তোষজনক পাওয়া যায় মর্মে প্রতিবেদন দেন। ওই প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রণালয়ে ৬ সেট ফগ লাইট কেনার সিদ্ধান্ত পাল্টিয়ে ১০ সেট কেনার অনুমতি দেয়। ওই কমিটিতে বাকি দু’জন সদস্য হলেন- নৌ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব পংকজ কুমার পাল (তখন উপ-সচিব ছিলেন) ও প্রকল্পের পরিচালক জিএম (মেরিন) ক্যাপ্টেন শওকত সরদার। এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে সংস্থাটির বর্তমান চেয়ারম্যান প্রকৌশলী ড. জ্ঞান রঞ্জন শীল বলেন, আমেরিকায় আমরা যেসব মাল দেখেছিলাম তা আসেনি বলে তদন্ত প্রতিবেদনে দেখছি। কিভাবে এমন হল তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। পুরো বিষয়টির দায় রিসিভ কমিটির ওপর বর্তায়।

ফগ লাইট রিসিভ কমিটির প্রধান ছিলেন প্রকল্পের পরিচালক জিএম (মেরিন) ক্যাপ্টেন শওকত সরদার। এ বিষয়ে তার কাছে জানতে চাওয়া হলে সরাসরি কোনো উত্তর না দিয়ে মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটির সদস্যদের যোগ্যতা নিয়ে পাল্টা প্রশ্ন তোলেন তিনি। ক্যাপ্টেন শওকত সরদার বলেন, মন্ত্রণালয়ের তিন সদস্যের কমিটি তদন্ত করেছে, যাদের কোনো মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের জ্ঞান নেই, তারা নন-টেকনিক্যাল ও ক্যাডার সার্ভিসের লোক। উনারা সব কিছু বুঝেন না। তিনি আরও দাবি করেন, এসব ফগ লাইটের কাছ থেকে অতিরিক্ত পারফরম্যান্স আশা করা হয়েছিল, যা ভুল। এগুলো কেনার প্রতিটি ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নেয়া হয়েছে। এ কমিটিতে সদস্য ছিলেন জিএম (হিসাব) মো. নুরুল হুদা, ডিজিএম শেখ মো. নাসিম, এজিএম (ইঞ্জিনিয়ার) মো. এনামুল হক ও ম্যানেজার (মেরিন) মো. আবদুস সোবহান।

বিআইডব্লিউটিসির এক কর্মকর্তা নাম গোপন রাখার শর্তে বলেন, এসব লাইট কেনার ক্ষেত্রে পদে পদে ক্রয়নীতির লঙ্ঘন করা হয়েছে। এ প্রকল্পটি সংস্থার বার্ষিক উন্নয়ন প্রকল্পে (এডিপি) ছিল না। সংস্থাটির কর্মসূচির আওতায় কেনা হয়েছে। ফলে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের তদারকি ছিল না। নৌ মন্ত্রণালয়ের প্ল্যানিং সেল তদারকি করলেও সেখানে গাফিলতি ছিল। এছাড়া এসব লাইট সংস্থার ক্রয় বিভাগ থেকে কেনার কথা থাকলেও তা কিনেছে মেরিন বিভাগ। তিনি অভিযোগ করেন, মন্ত্রণালয়ের প্ল্যানিং সেলের কয়েকজন কর্মকর্তা বছরের পর বছর সেখানে চাকরিরত থাকায় বিভিন্ন প্রকল্পের পরিচালকদের সঙ্গে তাদের বিশেষ সখ্যও রয়েছে।

https://www.jugantor.com/last-page/2017/09/11/154478