১০ সেপ্টেম্বর ২০১৭, রবিবার, ১০:২১

খাবারের জন্যে হাহাকার ॥ নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে শিশুরা

সারাদিন বৃষ্টিতে ভিজে আর স্যাতে স্যাতে কাদামাটির উপরে ঘুমিয়ে কোনরকম দিনপার করেছে বার্মা সরকারের নির্যাতনে পালিয়ে আসা অসহায় রোহিঙ্গারা । এভাবে খোলা আকাশের নীচে বৃষ্টিতে ভিজে দিনের পর দিন অতিবাহিত করতে গিয়ে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে রোহিঙ্গা শিশুরা। এরমধ্যে বেশ কয়েকজন শিশু মারা যাওয়ার খবরও নিশ্চিত হওয়া গেছে। এছাড়া গতকালও বার্মা থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের সীমান্তে আশ্রয় নিতে দেখা গেছে। এ কারণে আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থাগুলো ধারণা করছে, শরণার্থীর সংখ্যা তিন লাখ ছাড়িয়ে যেতে পারে। এদের আশ্রয় বা খাবার জোগাড়ে প্রশাসন হিমশিম খাচ্ছে।

এই রোহিঙ্গাদের বেশির ভাগই রাস্তার ধারে বা খোলা আকাশের নিচে অবস্থান করছে। বাংলাদেশ সরকার নতুন করে আশ্রীত এই রোহিঙ্গাদের তালিকা নিবন্ধনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যাতে তারা দেশের অন্যত্রে ছড়িয়ে না পড়ে।
রোহিঙ্গাদের এই ¯্রােত কোথায় গিয়ে ঠেকবে, তা নিয়ে স্থানীয় সচেতন মহলের মাঝে ব্যাপক উদ্বেগ ও উৎকন্ঠার দেখা দিয়েছে। তবে সীমান্ত পরিস্থিতি এবং রোহিঙ্গাদের আশ্রয়ের ধারা পর্যালোচনা করে জাতিসংঘ, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি এবং রেড ক্রসসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও আশঙ্কা প্রকাশ করেছে, এই দফায় শরণার্থীর সংখ্যা তিন লাখ ছাড়িয়ে যেতে পারে।
হাজার হাজার রোহিঙ্গার আশ্রয় এবং খাদ্য সাহায্যের ব্যবস্থাপনা নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে।
কুতুপালং এবং নোয়াপাড়ায় শরণার্থী শিবিরগুলোতে নতুন আশ্রীত রোহিঙ্গাদের একটা অংশকে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু মানুষের গাদাগাদি অবস্থায় শিবিরগুলোতেও আর জায়গা নেই।
বালুখালী শরণার্থী শিবির এলাকার ইউনিয়ন পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নুরুল আফসার চৌধুরী বলেন, কুতুপালং এবং বালুখালী শিবিরের বাইরে খোলা জায়গা রাস্তাঘাট সবজায়গায় শুধু মানুষ আর মানুষ। তাদের একটা নিয়ম বা পদ্ধতির মাধ্যমে খাদ্য বা মানবিক সাহায্য দেওয়ার ব্যবস্থা এখনও হয়নি।
তিনি আরো বলেন, পথে-ঘাটে, স্কুল মাদ্রাসা বা পরিত্যক্ত জায়গায় রোহিঙ্গারা যে যেভাবে পেরেছে আশ্রয় নিয়েছে। এমন অবস্থা হয়েছে যে রাস্তা-ঘাটসহ সর্বত্র শুধু রোহিঙ্গা আর রোহিঙ্গা। তাদের খাবারের বেশ কষ্ট হচ্ছে। নিয়মিত খাবার কেউ দিচ্ছে না এবং পাচ্ছেও না। স্থানীয় লোকজন অনেক সময় খাবার এনে দিলে তারা সেটা খাচ্ছে। রোহিঙ্গাদের অনেকে স্থানীয় বাসিন্দাদের বাড়ি ঘরে গিয়ে খাবার চেয়ে নিচ্ছে।
সরকারি কর্মকর্তারা বলছেন, এবার আশ্রীত রোহিঙ্গার সংখ্যা তাদের সব ধারণাকে ছাড়িয়ে গেছে। ফলে আশ্রয় বা খাদ্য সহায়তার ব্যবস্থাপনায় কিছুটা ঘাটতি হয়েছে বলে কর্মকর্তারা স্বীকার করেন এবং তাদের এক জায়গায় নেওয়ার কথাও বলছে প্রশাসন।
কিন্তু সেই জায়গা নির্বাচনের প্রক্রিয়াই এখনও শেষ হয়নি। এ প্রসঙ্গে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের সচিব মো: শাহ কামাল বলেছেন, কুতুপালং এবং বালুখালি শিবিরের পাশে দুটি জায়গা জরিপ করা হয়েছে। দু’একদিনের মধ্যে তারা জায়গাটি চূড়ান্ত করবেন।
এদিকে সরকারের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাদের তালিকা তৈরির কথা বলা হয়েছে। তবে সেই কাজ এখনও শুরু করা যায়নি। স্থানীয় কর্মকর্তারা বলছেন, সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গারা পালিয়ে আশ্রয় নিচ্ছে। ফলে পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে তালিকা করা বা অন্য বিষয় গুলোতে ঘাটতি হয়েছে।
তবে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার ড. ইকবাল হোসেন বলেছেন, “বায়োমেট্্িরক পদ্ধতিতে রোহিঙ্গাদের নিবন্ধনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। রোহিঙ্গাদের এক জায়গায় নিয়ে আগামী সপ্তাহে এই নিবন্ধনের কাজ শুরুর চেষ্টা করছি আমরা।”
সরেজমিন নতুন আসা রোহিঙ্গাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, মিয়ানমারে এখনো ৫ লাখের উপরে রোহিঙ্গা রয়েছে বাংলাদেশে প্রবেশের অপেক্ষায়। এর মধ্যে গত ৩ সেপ্টেম্বর থেকে ৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৩ দিনে ও রাতে সীমান্তবর্তী বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে অন্তত ১ লাখ রোহিঙ্গা।
জানা যায়, সীমান্তের অন্তত ১০টি পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গারা প্রবেশ করছে যা আগের চেয়ে বহুগুণে বেড়েছে বলে স্থানীয় জনসাধারণের দাবী। সীমান্ত পেরিয়ে আসা হাজার হাজার রোহিঙ্গা পরিবার হোয়াইক্যং থেকে উখিয়ার কুতুপালং পর্যন্ত রাস্তার দু,পাশ দিয়ে এসে কুতুপালং, বালুখালী, নতুন গড়ে উঠা বালুখালী ঢালার মুখ, থাইনখালী হাকিম পাড়া, পালংখালী তাজনিরমার খোলা, পালংখালীর বাঘঘোনা বস্তিতে প্রবেশ করছে। অচিন এলাকায় যে যেখানে পারছে সেখানেই মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিচ্ছে। ফলে উখিয়া-টেকনাফ সীমান্তের পাহাড়ি এলাকায় নতুন করে গড়ে উঠছে ঝুপড়ি ঘর।
স্থানীয় কুতুপালং, বালুখালী বস্তির লালু মাঝি ও শামশু মাঝি জানান, পুরাতন ছাড়াও নতুন গড়ে উঠা বস্তিতে বিপুল পরিমান রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে । এ সংখ্যা প্রায় আড়াই লাখের কম হবেনা। স্থানীয় সীমান্তবর্তী এলাকার বালুখালী গ্রামের জাফর ইকবাল জানান, ঈদের দিন থেকে যে হারে রোহিঙ্গার ¯্রােত আসছে তাতে এ সংখ্যা আড়াই লাখ ছাড়িয়ে যাবে।

 

http://www.dailysangram.com/post/299140-