১০ সেপ্টেম্বর ২০১৭, রবিবার, ১০:২০

তীব্র খাদ্য সংকটের আশংকা

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে গতকাল শনিবার দেখা গেছে, দেশে খাদ্যশস্যের সরকারি গুদামজাতকৃত মোট মজুদ ৪ লাখ ৪৩ হাজার মেট্রিক টন। এর মধ্যে চাল ৩ লাখ ২১ হাজার মে. টন এবং গম ১ লাখ ২২ হাজার মে. টন। এছাড়া, বন্দরে ভাসমান অবস্থায় ১ লাখ ৬৮ হাজার মে. টন খাদ্যশস্য রয়েছে। অবশ্য এ তথ্য ৪ সেপ্টেম্বরের বলে উল্লেখ করা হয়েছে। হালনাগাদ তথ্য পাওয়া যায়নি।

এরই মধ্যে নির্মম নির্যাতনের শিকার রোহিঙ্গাদের লাশের ওপর দিয়েই খাদ্যমন্ত্রী এডভোকেট কামরুল ইসলাম সস্ত্রীক মিয়ানমারে গিয়ে ১০ লাখের বদলে ৩ লাখ টন চাল আমদানি করে দেশে ফিরেছেন। তার আগে গত ২৮ আগস্ট খোদ খাদ্যমন্ত্রী জানান, আগামী ৩১শে জানুয়ারি পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে সর্বোচ্চ ২০ লাখ টন খাদশস্য প্রয়োজন। যার পুরোটাই ঘাটতি বলে তিনি মন্ত্রিসভাকে জানান। এ ব্যাপারে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম সাংবাদিকদের বলেন, জানুয়ারির মধ্যে দেশের খাদ্য ঘাটতি মেটাতে কম্বোডিয়া ও থাইল্যান্ড থেকে ১৫ লাখ টন চাল এবং রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে ৫ লাখ টন গম আমদানি করা হবে বলেবৈঠকে খাদ্যমন্ত্রী জানান। আগামী ৫ বছর মেয়াদে সর্বোচ্চ ১০ লাখ টন চাল আমদানির জন্য কম্বোডিয়ার সঙ্গে জি-টু-জি পদ্ধতিতে একটি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। প্রয়োজন অনুসারে বছরে ২ থেকে ৩ লাখ টন চাল আমদানি করা যাবে। ভিয়েতনাম থেকে মোট আড়াই লাখ টন চাল আমদানির মধ্যে এক লাখ টন দেশে এসেছে। বাকি দেড় লাখ টন আমাদের সমুদ্র সীমার মধ্যে ঢুকে পড়েছে। ভারত থেকেও চাল আমদানি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এছাড়া শীঘ্রই তিন লাখ টন গম আমদানির টেন্ডার আহ্বান করা হবে। এর মধ্যে রাশিয়া থেকে দুই লাখ টন আমদানি করা হবে।
বর্তমান খাদ্য মজুদ পরিস্থিতির জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর অসংলগ্ন তথ্যকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞমহল। একই সাথে তারা ভয়াবহ খাদ্য সংকটের আশংকা করে বলছেন, নীতিনির্ধারনীমহল থেকে মজুদ পরিস্থিতি নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করা হলেও বাস্তবে দেশে নীরব দুর্ভিক্ষ বিরাজ করছে। বন্যা, ভূমিধস ইত্যাদি দূর্যোগের শিকার কোটি কোটি মানুষকে অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটাতে হচ্ছে। চালের মজুদ না থাকায় এবার ঈদে ৮৮ লাখ ভিজিএফ কার্ডধারীকেও খাদ্য সহায়তা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।
সূত্র বলছে, টানা বর্ষণ আর বন্যায় তলিয়ে গিয়েছিল উত্তরাঞ্চলের ২১ জেলা। বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা, আর ব্যাপক হারে নষ্ট হয় ফসল। দেশের এমন পরিস্থিতিতে প্রায় তলানিতে পৌঁছেছে দুর্যোগকালীন খাদ্য মজুদ। বন্যা ছাড়াও খাদ্য সংকটের অন্যতম কারণ হচ্ছে দাতা সংস্থার উন্নয়ন সহযোগী দেশগুলো থেকে প্রত্যাশা অনুযায়ী খাদ্য (গম) সহায়তা না পাওয়া। নীতি ও কৌশল পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশে খাদ্য সহায়তা কমিয়ে দিয়েছে তারা।
বন্যায় ধান নষ্ট, উৎপাদন কম হওয়ায় বাজারে চালের দাম বেড়ে যায়। এতে কৃষক পর্যায় থেকে ধান-চাল আশানুরূপ সংগ্রহ করতে পারেনি সরকার। সরকার এ বছর ৭ লাখ টন ধান ও ৮ লাখ টন চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে। এখন পর্যন্ত সংগ্রহ হয়েছে মাত্র এক লাখ ৯০ হাজার টন। সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী সাড়ে ৯ থেকে ১০ লাখ টন পর্যন্ত সরকারের ঘরে আসেনি। ধান ও চাল সংগ্রহ না হওয়ায় খাদ্য নিরাপদ মজুদ কমে আসে।
সূত্র জানায়, চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের শুরুতে সরকারি পর্যায়ে চালের মজুদের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ২৩ হাজার মে. টন। আর গম ছিল ২ লাখ ৫৬ হাজার মে. টন। যা ২০১৬-১৭ অর্থবছরের শুরুতে চালের মজুদ ছিল ৪ লাখ ৫৮ হাজার মে. টন। আর গম ছিল ৩ লাখ ৯৮ হাজার মে. টন। এই হিসেবে গত অর্থ বছরের তুলনায় অর্ধেকে নেমে এসেছে সরকারি মজুদ। বর্তমান মোট মজুদ ৪ লাখ ৪৩ হাজার মেট্রিক টন। গত বছর এ সময়ে মোট মজুদ ছিল ৮ লাখ ৬৮ হাজার টন। সরকারি হিসাবে চলতি বছর হাওরে আগাম বন্যা এবং ধানে ব্লাস্ট রোগে চালের উৎপাদন ১২ লাখ মে. টন কম হয়েছে। পাশাপাশি গম ফলনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি। বেসরকারি হিসাবে উৎপাদন ঘাটতির পরিমাণ প্রায় ৪০ লাখ মে. টন।
এই খাদ্য সংকট মোকাবিলায় সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে বলে জানান সংশিষ্টরা। এজন্য বেসরকারি পর্যায়ে চাল আমদানি বাড়াতে শুল্ক দুই দফা কমিয়ে করা হয়েছে দুই শতাংশ। সরকারের ‘খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ’ কমিটিরবৈঠকে দ্রুত নিরাপদ মজুদ গড়ে তুলতে জরুরি ভিত্তিতে ২০ লাখ টন খাদ্য আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। পাশাপাশি ভবিষ্যৎ নিরাপদ নিশ্চিত করতে খাদ্যের নিরাপত্তা মজুদের সিলিং সাত লাখ টন থেকে বাড়িয়ে ১১ লাখ টনে উন্নীত করারও সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটির সর্বশেষবৈঠকের কার্যবিবরণী থেকে জানা গেছে, ২০১৬ সালের মার্চের শুরুতে সরকারি ভান্ডারে ১০ লাখ ৬২ হাজার ৯৭২ টন খাদ্য মজুদ ছিল। চলতি বছরের জুলাইয়ে সরকারি ভান্ডারে চাল-গমের মজুদের পরিমাণ তিন লাখ ৬৭ হাজার ৮১৯ টন। খাদ্য পরিকল্পনা কমিটিরবৈঠক থেকে আরও জানা গেছে, বর্তমান মজুদ গত সাত বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে।
চাল উৎপাদন ও ভোগের তথ্যে গোলমালের বিষয়টি ধরা পড়েছে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণায়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কৃষি মন্ত্রণালয় খাদ্য উৎপাদন বাড়িয়ে দেখাচ্ছে, ভোগও দেখাচ্ছে কম। প্রকৃতপক্ষে ঘোষণার তুলনায় উৎপাদন কম, ভোগ বেশি। আবার খাদ্য মন্ত্রণালয় উৎপাদনের প্রকৃত তথ্য জেনেও উদ্বৃত্ত খাদ্য বেশি দেখিয়ে চাল রফতানিকে সমর্থন দিয়েছে।
উক্ত গবেষণায় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস), কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর (ডিএই) ও মহাকাশ গবেষণা সংস্থা (স্পারসো) ধানের উৎপাদন সম্পর্কে যে তথ্য দেয়, তার অসঙ্গতি তুলে ধরা হয়েছে। আর খাদ্য নিরাপত্তায় সঠিক পদক্ষেপ কী হতে পারে, তার একটি ধারণাও দেয়া হয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, সরকারি সংস্থাগুলো চালের উৎপাদন ৫ থেকে ৮ শতাংশ বাড়িয়ে দেখায়। তারা মাথাপিছু খাদ্যের যে ভোগ দেখায়, তাতেও ১৫ শতাংশ কমিয়ে দেখানো হয়। খাদ্য উৎপাদন ও ভোগ মিলিয়ে যে হিসাব দাঁড়ায়, তাতে কমপক্ষে ২০ শতাংশ চালের উৎপাদন ও ভোগের হিসাবে গরমিল রয়ে যায়।
বিআইডিএস বলছে, সরকারের খাদ্য পরিধারণ ও মূল্যায়ন ইউনিট (এফপিএমইউ) ও বিবিএস মাথাপিছু চাল ও আটা ভোগের হিসাব কম দেখায়। আর এফপিএমইউর মাথাপিছু খাদ্য ভোগের হিসাব বাস্তবভিত্তিক গবেষণার আলোকে করা হয় না। অথচ এ তথ্যই নীতিনির্ধারক ও গবেষকেরা সব সময় ব্যবহার করে চলেছেন। দেশের খাদ্যবিষয়ক সরকারের নীতি ও গবেষণা সংস্থা এফপিএমইউ মাথাপিছু ৪৬৪ গ্রাম চাল-গম ভোগ দেখায়। আরেক সরকারি সংস্থা বিবিএসদৈনিক গড়ে ৪৯০ গ্রাম চাল-গম ভোগ করা হয় বলে দেখায়। এই দুটি হিসাবকে আমলে নিয়েই সরকারের খাদ্যবিষয়ক পরিকল্পনা নেয়া হয়।
বিআইডিএস বলছে, এই হিসাব সমস্যাযুক্ত। বাংলাদেশের মানুষ মাথাপিছু দৈনিক কী পরিমাণ চাল-গম খায়, তার প্রকৃত চিত্র এর মাধ্যমে উঠে আসছে না। কারণ, বিআইডিএসের জরিপে দেখা গেছে, দেশেদৈনিক মাথাপিছু চাল ও আটার ভোগ ৫০৬ গ্রাম। অর্থাৎ একজন দিনে গড়ে ওই পরিমাণ চাল ও গম খায়। এর মধ্যে ৪৬৩ গ্রাম চাল ও ৪৬ গ্রাম আটা রয়েছে। আবার বিবিএস ২০১০ সালে খানা জরিপ করে মানুষ ঘরের বাইরে খায় এমন ১২ ধরনের খাবারকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। কিন্তু বিআইডিএসের হিসাবে মোট ৩৬ ধরনের খাবার মানুষ ঘরের বাইরে খায়।
গবেষণায় আরও দেখা গেছে, ধান চাষের আবাদি জমির পরিমাণেও গরমিল রয়েছে। যেমন: ২০০৮ সালে আমন ধান চাষের এলাকার হিসাব বিষয়ে বিবিএসের নমুনা জরিপ ও কৃষিশুমারির মধ্যে পার্থক্য ৬০ শতাংশ। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর কৃষক তার নিজের জমির যে হিসাব দেন, তার ভিত্তিতে মোট চাষের জমির হিসাব করে। কিন্তু বিআইডিএসের গবেষণা দল কৃষকের দাবি করা চাষের জমি আমিন দিয়ে মাপজোখ করে দেখেছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে জমির হিসাব কমপক্ষে ২ শতাংশ বাড়িয়ে দেখানো হয়। আর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের কর্মকর্তারা কাগজে-কলমে জমির হিসাব আরও ৫ শতাংশ বেশি দেখান। ফলে উৎপাদনও বাড়িয়ে দেখানো হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চাল ও গম উৎপাদনের যে তথ্য কৃষি মন্ত্রণালয় ও পরিসংখ্যান ব্যুরো দেয়, তা আমলে নিলে দেশে কোনো খাদ্য ঘাটতির কথা থাকে না; বরং ২৫ থেকে ৩৩ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত থাকে। কাজেই অর্থনীতির চিরায়ত সূত্র অনুযায়ী, বাজারে খাদ্য তথা চালের দাম না বেড়ে কমার কথা। কিন্তু বাস্তবতা উল্টো। রাষ্টায়ত্ত বাণিজ্যিক সংস্থা ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) এর তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে প্রতি কেজি মোটা চালের দামই ৪৩ থেকে ৪৫ টাকা।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের দেওয়া খাদ্যশস্যের উৎপাদনের হিসাব সঠিক হলে দেশে ৩৩ লাখ ৩৫ হাজার ৩৭০ টন খাদ্যশস্য উদ্বৃত্ত থাকার কথা। কাজেই আমদানি তো নয়ই বরং বাংলাদেশ খাদ্য রফতানি করতে পারে। আর বাজারে দাম বাড়ারও কারণ নেই। সাম্প্রতিক বছরে সরকারের পক্ষ থেকে ধান ও গম মিলিয়ে সাড়ে ৩ কোটিরও বেশি মে. টন খাদ্যশস্য উৎপাদনের কথা বেশ তৃপ্তির সাথে বলা হচ্ছিল।
অনুসন্ধানে জানা যায়, কৃৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের গ্রাম পর্যায়ের অফিসগুলোর উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তার (ব্লক সুপারভাইজার) মাধ্যমে সরকার খাদ্যশস্যের তথ্য সংগ্রহ করে। কৃষক কতটুকু জমিতে কী ফসল চাষ করছে, উৎপাদন কেমন হতে পারে এবং ফসল কাটার সময় প্রকৃত উৎপাদন কেমন হলোÑসে হিসাব দিয়ে থাকেন তারা। অভিযোগ রয়েছে, এসব কর্মকর্তা কৃষকের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করেন না। জরিপের জন্য সর্বজনস্বীকৃত কোনো পন্থাও তাঁরা ব্যবহার করেন না। বড় একটি আবাদি মাঠের পাশে গিয়ে সেখানে কতটুকু জমি আছে লোকজনের কাছে শুনে এর ওপর ভিত্তি করে একটি আনুমানিক উৎপাদনের হিসাব দেন। অথবা আগে থেকে সংগ্রহ করা তথ্যের ওপর ভিত্তি করে অফিসে বসেই একটি কাল্পনিক তথ্য সরকারকে দেন, যার ওপর ভিত্তি করে খাদ্য পরিকল্পনা করা হয়।
সাধারণত কৃষি মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যানের সঙ্গে পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যের মিল থাকে না। এ নিয়ে সব সরকারের সময়ই প্রশ্ন উঠেছে। গত চারদলীয় জোট সরকারের সময় অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান পরিসংখ্যানের অমিল দূর করার জন্য অনেকবৈঠক করেন। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে পরিসংখ্যানগত অমিল দূর করার জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে কমিটি গঠন করা হয়। সেই কমিটিও তাদের রিপোর্টে বিভিন্ন পরিসংখ্যানগত অমিলের জন্য খাদ্যমূল্য সংকটসহ নানা সংকট সৃষ্টির কথা তুলে ধরে। বর্তমান মহাজোট সরকারের কৃষিমন্ত্রীও পরিসংখ্যান ব্যুরোর কর্মকর্তাদের ভর্ৎসনা করেন।

http://www.dailysangram.com/post/299146-