১০ সেপ্টেম্বর ২০১৭, রবিবার, ১০:১৯

এবার বিপাকে পড়েছে মওসুমি ব্যবসায়ীরা

চামড়ায় লবণ লাগিয়ে বেচতে হবে, বিক্রির টাকা অর্ধেক বাকি রাখতে হবে আড়তদারদের এমন আবদারের কারণে চামড়া নিয়ে বিপাকে পড়েছেন মওসুমি ব্যবসায়ীরা। এছাড়া হাজারিবাগের ট্যানারিগুলো সাভারে স্থানান্তরের প্রক্রিয়ায় থাকায় অনেক প্রতিষ্ঠান চামড়া কিনতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। কারণ হিসেবে তারা বলছেন রফতানি অর্ডার বাতিল হওয়াতে অনেক চামড়া এখনও অবিক্রীত রয়ে গেছে। পুঁজির অভাবে নতুন চামড়া বেশি কেনাও যাচ্ছে না। বকেয়া পরিশোধ না করলে নতুন করে বাকিতে চামড়া কেনাও যাচ্ছে না। এতে করে বিপাকে পড়েছে মওসুমী চামড়ার ব্যবসায়ীরা। সব কিছু হারিয়ে পথে বসার উপক্রম তাদের।
জানা গেছে, প্রতি কুরবানির ঈদে চামড়া সংগ্রহ করে থাকেন সারা দেতশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এতিম খানা/লিল্লাহ বোডিং অথবা কাওমী মাদরাসাগুলো। এ বছর তারা কুরবানির চামড়া সংগ্রহ করেছে। সংরক্ষণের জন্য তারা চামড়ায় লবনও দিয়েছেন। লবনযুক্ত এসব চামড়া তারা বিক্রির জন্য নিয়ে গেছেন পোস্তায়। অনেকে নিয়ে গেছেন হাজারিবাগে আবার কেউ নিয়ে গেছেন সাভারের ট্যানারি পল্লিতে। কিন্তু তাতে তাদের দুর্ভোগ আরও বেড়েছে।
অপেশাদার এসব লোকেরা পড়েছে মহা বিপদে। না তারা চামড়া বিক্রি করতে পারছে না তারা পালিয়ে যেতে পারছে। কারন প্রতিটি চামড়ায় তাদের লবনযুক্ত করতে ব্যয় হয়েছে ১৫০-২০০ টাকা পর্যন্ত। তার সাথে যুক্ত হয়েছে ট্রাক ভাড়া। এতে প্রতিটি চামড়ায় তাদের(ক্রয় ছাড়াই)ব্যয় হয়েছে ৩৫০-৪০০ টাকা। মাদরাসাগুলোর সারা বছর চলা তো দুরের কথা তাদের লোকসান হচ্ছে কয়েক গুন। তাহলে সারা বছর তারা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করবেন কি করে।
গত দুই দিন ধরে রাজধানীর অলিগলি গিয়ে চামড়া কিনে আনার পর এখন পর্যন্ত সেগুলো বিক্রি করতে পারেননি মওসুমি চামড়া ব্যবসায়ীরা। আর সময়মতো চামড়া বিক্রি করতে না পারলে তাতে পচন ধরবে। অপরদিকে, আড়তদারদের শর্ত মেনে চামড়া বিক্রির করলে লোকসানের মুখে পড়তে হবে তাদের।
ঢাকার হাজারীবাগে গিয়ে দেখা যায়, গরুর চামড়া সরকার নির্ধারিত দামে প্রতি বর্গফুট ৫০ থেকে ৫৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে ছাগলের চামড়া ফুট হিসেবে বিক্রি না করে আকার ভেদে ৩০ থেকে ৪৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অবস্থা এমন যে ছাগলের চামড়া যেন চামড়াই মনে হয় না। অনেকে ছাগলের চামড়া ফেলে যেতে বাধ্য হচ্ছে। গত বছরও প্রতিফুট ছাগলের চামড়া বেচা কেনা হয়েছে ২০-২৫ টাকা দরে। সেহিসেবে এ বছর ছাগলের চামড়া কেনা হয়েছে ৬০-৭০ টাকায়। তা লবন মাখার পরে বিক্রি হচ্ছে মাত্র ২৫-৩০ টাকায়। প্রতিটি চামড়ায় লবনের জন্য ব্যয় হয় ৫ টাকা। সে হিসেবে একটি ছাগলের চামড়ায় লোকসান হচ্ছে প্রায় ৫০ টাকা।
সরকার ছাগলের চামড়ার জন্য প্রতি বর্গফুট ২০ টাকা দাম নির্ধারণ করে দেওয়ায় প্রতিটি চামড়ার জন্য ১০০ থেকে ১২০ টাকা পাওয়ার কথা। কিন্তু ট্যানারি মালিকরা পুরো চামড়ার জন্য ৩০ থেকে ৫০ টাকার বেশি দিতে চাইছেন না।
জানা গেছে সারা দেশে প্রায় ৮০-৮৫ লাখ ছাগল কুরবানি হয়েছে। এসব চামড়া কিনেছে মওসুমি ব্যবসাযীরা। এ চামড়া কিনে তারা এখন বিপাকে। যদি এ চামড়ার কোম মূল্য না ই থাকতো তাহলে কেন মূল্য নির্ধারন করা হলো।
মওসুমি বিক্রেতারা বলছেন, হাজারীবাগের ট্যানারি মালিকরা এবার চামড়া কিনতে খুব একটা আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। আর এ কারনে তারা বকেয়া টাকাও পরিশোধ করছেন না।
এদিকে হাজারীবাগ থেকে সাভারে স্থানান্তর জটিলতায় পর্যাপ্ত চামড়া সংগ্রহ করতে পারেনি অনেক ট্যানারি। আগের মজুদ করা চামড়া অবিক্রিত থাকায় বিপাকেও পড়েছেন তারা। এদিকে পরিবেশবান্ধব আধুনিক চামড়া শিল্পনগরী এখনো পুরোপুরি প্রস্তুত না হওয়ায় বিরূপ প্রভাব পড়ছে তাদের ব্যবসায়। ভাঙ্গাচোরা রাস্তা ঘাট, আর স্যুয়ারেজের ময়লা আবর্জনা ভোগান্তিতে ফেলছে মালিকদের।
কোরবানি ঈদের দিন থেকেই শুরু ব্যস্ততা। কারণ ট্যানারির সারা বছরের রসদ, কাঁচা চামড়ার বড় অংশই সংগ্রহ করা হয় এসময়। তবে এবার কিছুটা বেগ হয়েছে ট্যানারি মালিকদের। এপ্রিলের পর থেকে হাজারিবাগে সব ধরনের কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অবিক্রিত রয়ে গেছে আগের অনেক চামড়া। তার ওপর ট্যানারি স্থানান্তরের জটিলতা প্রভাব ফেলেছে তাদের ব্যবসায়।
তবে মড়ার ওপর খাড়ার ঘা হিসেবে, চরম ভোগান্তি নিয়ে এসেছে পরিবেশ বান্ধব চামড়া শিল্পনগরীর রাস্তাঘাট। একেতো ভাঙ্গা চোরা, তার ওপর ময়লা পানি আর দুর্গন্ধ চলা চলের অযোগ্য করে দিয়েছে এগুলো।
সাভারের এই আধুনিক শিল্পনগরীতে প্লট বরাদ্দ পেয়েছে আড়াইশোর মতো ট্যানারি। তবে এখনো পুরোপুরি কাজ শুরু করতে পেরেছে ৫০টিরও কম কারখানা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, সবগুলো ট্যানারি পুরো পুরি চালু হতে এখনো বছরের বেশি সময় লেগে যেতে পারে।
মোহাম্মদপুরের এক মাদরাসা শিক্ষক চামড়া বিক্রি করতে গিয়ে পড়েছেন বিপাকে। তিনি জানান, যারা কোরবানি দেন তারা গরুর চামড়া নিজেরা বিক্রি করে দিলেও অনেকে ছাগলের চামড়া মাদরাসা বা এতিমখানায় দান করেন। এর বাইরে মাদরাসা এতিমখানার লোকজন নিজেরাও চামড়া সংগ্রহ করে। সংগ্রহ করা চামড়ার সঙ্গে দানের চামড়া মিলিয়ে বিক্রি করছেন বলে শেষ পর্যন্ত হয়ত লোকসান হবে না, কিন্তু তেমন কোনো লাভও থাকবে না।
তবে আবহাওয়া ভালো থাকায় গতবারের তুলনায় এবার দেশে কোরবানির পশুর চামড়ার মান ভালো বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
অভিযোগ রয়েছে, চামড়াব্যবসায়ী ও ট্যানারি মালিকরা যৌথভাবে বাজারে নৈরাজ্য সৃষ্টি করেছেন। নামমাত্র মূল্যে তারা চামড়া কেনার উদ্দেশ্যেই মাঠে নেমেছেন। এ কারণে এসব শর্ত জুড়ে দিচ্ছেন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে নির্ধারিত দামের সঙ্গে লবণ মেখে দেওয়ার কোনও শর্ত ছিল না। কাঁচা চামড়ায় লবণ মাখাবেন পোস্তার ব্যবসায়ী বা আড়তদাররা। এরপরই তারা ট্যানারি মালিকদের কাছে লবণযুক্ত চামড়া বিক্রি করবেন।
বাকিতে চামড়া কিনতে চাওয়া প্রসঙ্গে পোস্তার কাঁচা চামড়ার আড়তদার জহিরুল ইসলাম বলেন, গত বছর ট্যানারি মালিকদের কাছে যে চামড়া বিক্রি করেছি, তার মূল্য এখনও পাইনি। সেখানে অনেক ব্যবসায়ীর টাকা আটকে আছে। নগদ টাকায় চামড়া কেনার মূলধন এখন পাবো কোথায়?
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ লেদার অ্যান্ড লেদার গুডস ম্যানুফ্যাকচারার্স কো-অপারেটিভ সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক মো. আরিফ বলেন, হাজারিবাগের ট্যানারিগুলো সাভারে স্থানান্তরের প্রক্রিয়ায় থাকায় এবার চামড়া কেনার চাহিদা কমে গেছে। ছোট ট্যানারিগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ছাগল বা ভেড়ার চামড়া ও গরুর মাথার চামড়া প্রক্রিয়া করার ব্যবস্থা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে হাজারিবাগে। ফলে চাহিদা নেই।
হাজারিবাগের এক ব্যবসায়ী জানান, হাজারীবাগে ছোট বড় প্রায় চারশ ট্যানারি ছিল। সেগুলো বন্ধ হয়ে সাভারে চালু হয়েছে মাত্র অর্ধশতাধিক ট্যানারি। এর মধ্যে মাত্র চার-পাঁচটি ট্যানারি আছে, যারা গরুর মাথার চামড়া ও ছাগলের চামড়া প্রক্রিয়াজাত করতে পারে। হাজারীবাগের ছোট ট্যানারিগুলো স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়েছে গেছে।
তিনি জানান, গত বছর তিনি নিজে দুই হাজার পিস চামড়া কিনেছিলেন। এবার কিনেছেন মাত্র ৮০০ পিস।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, অনেক ট্যানারির কাছে গতবছরের চামড়াও জমা আছে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারেও চামড়ার দাম কম। আর কাঁচা চামড়া সংরক্ষণে লবণ লাগে। এবার লবণের দাম ছিল অনেক বেশি। চামড়া সংগ্রহের মওসুমে এসবের প্রভাব পড়েছে।
বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক এম সাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, গতবছর লক্ষমাত্রার চেয়ে ১০ শতাংশ বেশি চামড়া সংগ্রহ হয়েছিল। এবার লক্ষ্য পূরণ না হলেও কাছাকাছি পৌঁছাবে বলে তারা মনে করছেন। এবার গরুর ৫০ লাখ, মহিষের ৫ লাখসহ ছাগল-ভেড়া মিলিয়ে ৮০ লাখ পিস চামড়া সংগ্রহ হবে বলে আশা করছেন তিনি।
ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ বছরে থেকে ২২ কোটি বর্গফুট চামড়া পাওয়া যায়। এর মধ্যে ৬৪ দশমিক ৮৩ শতাংশ গরুর চামড়া, ৩১ দশমিক ৮২ শতাংশ ছাগলের, ২ দশমিক ২৫ শতাংশ মহিষের এবং ১ দশমিক ২ শতাংশ ভেড়ার চামড়া। এর অর্ধেকের বেশি আসে কোরবানির ঈদের সময়।

 

http://www.dailysangram.com/post/299172-