মিয়ানমার বাহিনীর বর্বরতার শিকার এই শিশুটির দুই চোখই বলে দিচ্ছে তার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত : নয়া দিগন্ত
১০ সেপ্টেম্বর ২০১৭, রবিবার, ১০:১৮

উগ্রপন্থীরা মুখে কাপড় পেঁচিয়ে রোহিঙ্গাদের ঘরে আগুন দিচ্ছে

নাফ নদীতে রোহিঙ্গাদের নৌকায় সৈন্যদের গুলি; টেকনাফে ৫ রোহিঙ্গার লাশ উদ্ধার

নাফ নদীর ওপারে মংডুর সীমান্তঘেঁষা গ্রাম রাইম্মার বিলে মিয়ানমারের সেনাদের উপস্থিতিতে দেশটির উগ্রপন্থী বৌদ্ধরা রোহিঙ্গাদের বাড়িঘরে আগুন দিয়েছে। শুক্রবার বিকেলে মুখে ওড়না পেঁচিয়ে ‘রোহিঙ্গা মুসলমান’ সেজে বসতঘরে আগুন দেয় উগ্রপন্থীরা। মুসলমানরা নিজেরাই নিজেদের ঘরে আগুন দিয়েছেÑ এমনটি বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে তুলে ধরতেই এ কাজ করছে মিয়ানমারের প্রশাসন। আর আগুন দেয়ার এই দৃশ্য ভিডিও করছে সেনারা। এভাবে প্রতিদিন রোহিঙ্গা অধ্যুষিত কোনো-না-কোনো গ্রামে আগুনের লেলিহান শিখা দেখা যাচ্ছে। শত শত ঘরবাড়ি পুড়ে ছাই হচ্ছে। প্রাণ বাঁচাতে রোহিঙ্গারা খাল বিল নদী পার হয়ে বাংলাদেশে চলে আসছেন। নাফ নদী পার হওয়ার সময় মিয়ানমারের সৈন্যরা স্পিডবোটে এসে রোহিঙ্গাদের নৌকা লক্ষ্য করে গুলি করছে। এ দিকে গত শুক্রবার বিকেলে বঙ্গোপসাগর থেকে আরো পাঁচ রোহিঙ্গা নারী ও শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।
বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা জানিয়েছেন, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী নয়, বরং রোহিঙ্গারা নিজেরাই নিজেদের বসতঘরে আগুন দিচ্ছে, বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে এমনটা প্রচারে কৌশল নিয়েেেছ। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মতে, আরাকানে রোহিঙ্গা গণহত্যার প্রতিবাদে সারা বিশ্ব সোচ্চার হয়ে ওঠায় বেকায়দায় পড়েছে অং সান সু চির সরকার। এর আগে গত বুধবার আরাকানে মংডুর ৬ নম্বর ইউনিয়নের রোহিঙ্গা গ্রামের রোহিঙ্গাদের ডেকে সভা করেছিল সেনারা। ওই সভায় সেনারা উপস্থিত রোহিঙ্গাদের বলেছিল, আমরা তোমাদের আর হত্যা, নির্যাতন করব না, বাড়িঘরেও আগুন দেয়া হবে না। তোমরা আগের মতো এখানে বসবাস করতে পারবে। তবে তোমাদের নিজেদের বসতঘরে তোমরাই আগুন লাগিয়ে দেবে এবং তা ভিডিও করে আমাদেরকে দেবে। কেউ আগুন না দিলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও হুমকি দেয়া হয়।
গত শুক্রবার বিকেলে বঙ্গোপসাগর থেকে আরো পাঁচ রোহিঙ্গা নারী ও শিশুর লাশ উদ্ধার করার বিষয়ে টেকনাফ মডেল থানার ওসি মাইন উদ্দিন খান জানান, টেকনাফের বাহারছড়া পয়েন্টে আরো দু’টি ও সকালে উখিয়ার মনখালীতে তিন রোহিঙ্গার লাশ উদ্ধার হয়েছে। সব ক’টি লাশই নারী ও শিশুর। এ নিয়ে গত এক সপ্তাহে কক্সবাজারে অন্তত ৯৫ জন রোহিঙ্গার লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।
মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের দেশ ছাড়তে বাধ্য করতে সীমান্ত এলাকায় তাদের গুলি ও নির্যাতন করে হত্যার পর লাশ ফেলে দিচ্ছে বঙ্গোপসাগর ও নাফ নদীতে। গত কয়েক দিনে বঙ্গোপসাগর ও নাফ নদী থেকে যাদের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে তাদের প্রত্যেকের শরীরে গুলি এবং আঘাতের চিহ্ন রয়েছে বলে জানিয়েছেন উদ্ধারকারী স্থানীয়রা।
গত শুক্রবার উখিয়া কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গেলে সেখানে আশ্রয় নেয়া মংডুর বলিবাজারের বোগীরচর থেকে পালিয়ে আসা আবু বক্করের ছেলে সৈয়দ আহমদ বলেন, আমরা নাফ নদীর তীরে পৌঁছার পর চারটি নৌকা আমাদের নদী পার করছিল। দু’টি মিয়ানমার তীরের কাছে এবং একটি নদীর মধ্যে ও অন্যটি বাংলাদেশের কাছে পৌঁছে। এমন সময় মিয়ানমারের সেনারা চারটি স্পিডবোটে এসে গুলি করতে থাকে। তখন নদীর মধ্যে থাকা নৌকাটি ডুবে যায়। এ নৌকার একজন সাঁতার কেটে মিয়ানমারে ও চারজন বাংলাদেশে গিয়ে উঠতে পারলেও মারা গেছে ২০ যাত্রী। আর আমাদের নৌকা থেকে নামার সময় মারা গেছে বোগীরচরের ইউনুচের শিশুপুত্র আমিন (৮) এবং আবু তাহেরের ছেলে মোহাম্মদ আলম (৯)।
মংডুর খোয়াইসং এলাকার মমতাজ উল্লাহ জানিয়েছেন, সেনা ও নাডালা বাহিনীর বর্বরতা থেকে প্রাণে বাঁচতে স্ত্রী ও দুই যমজ সন্তানসহ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বুধবার রাতে দেশ ছাড়েন। নাফ নদী পাড়ি দিয়ে আসার সময় কোস্টগার্ডের বাধার মুখে পড়ে মিয়ানমারে জলসীমানা নাইক্ষ্যংদিয়া অবস্থানকালে নৌকায় ১৫ শিশু, ১৫ নারী ও ৯ পুরুষসহ ৩৯ জন রোহিঙ্গা নাগরিক ও একজন বাংলাদেশী নৌকার মাঝি ছিলেন। সাগরে প্রবল ঢেউয়ের কবলে পড়ে নৌকাটি উল্টে ডুবে যায়। সাঁতরে স্ত্রী স্ত্রী নছিমা খাতুন ও তিনি কূলে উঠতে পারলেও যমজ দুই ছেলে মো: হাসান ও মো: হোসেন ডুবে যায়। পরে শাহপরীর দ্বীপ মাঝেরপাড়া সৈকতের দু’টি এলাকা থেকে তাদের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। একই এলাকার আরেক রোহিঙ্গা রহিম উল্লাহ টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ মাঝেরপাড়া সাগর উপকূলে সৈকতে দুই বছরের মেয়ে খালেদা ও স্ত্রী আরেফা বেগমকে খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন।
গত শুক্রবার উখিয়ার সীমান্ত এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে রোহিঙ্গাদের বিরামহীন স্রোত। বয়স্করা মাথায় তল্পিতল্পা নিয়ে আর নারীরা শিশুদের কোলে নিয়ে হেঁটে আসছেন আশ্রয়ের সন্ধানে। এদের মধ্যে অনেকেই অসুস্থ। কেউবা আহত, গুলিবিদ্ধ। এদের কেউবা ঠাঁই নিচ্ছেন রাস্তার ধারে অথবা অন্যের বাড়ির বারান্দায়। কেউ কেউ বাঁশ ও পলিথিন জোগাড় করে বনাঞ্চলে ও রাস্তার ধারে ধারে তৈরি করছেন ঝুপড়িঘর। এভাবে কোনোমতে মাথা গোঁজার ঠাঁই হলেও সেখানেই বিনা চিকিৎসায় কাতরাতে দেখা গেছে অনেক তরুণ ও শিশুকে।
মনজুর আলম (১৬) নামের এক গুলিবিদ্ধ শিশু রাচিদং অঞ্চলের ধুমছে এলাকা থেকে পরিবারের সাথে এসে আশ্রয় নিয়েছে কুতুপালং শরণার্থী শিবিরের ক্যাম্প ইনচার্জের পরিত্যক্ত কার্যালয়ের বারান্দায়। একটি গুলি শিশুটির ডান কানের পাশ দিয়ে ঢুকে মুখমণ্ডলের বাম পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেছে। তার কাঁধের বাম অংশেও গুলির চিহ্ন রয়েছে। শিশুটির বাবা আবদুস সালাম জানান, ধুমছে এলাকার রোহিঙ্গারা ভেবেছিল তাদের এলাকায় যেহেতু গণ্ডগোল হয়নি, তাই সেনাবাহিনী ও মগেরা তাদের ওপর আক্রমণ করবে না। কিন্তু ঈদের দুই দিন আগে সন্ধ্যায় সেনাবাহিনী ও মগেরা এসে গুলিবর্ষণ ও বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করে। এ সময় অনেকেই নিহত হন। তিনিসহ বেঁচে যাওয়া অন্যরা পালিয়ে বনজঙ্গলে আশ্রয় নেন এবং পরে হেঁটে কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে পৌঁছান।
উখিয়ার পালংখালী সীমান্তে দেখা গেল মংডুতে সেনাদের নির্যাতনের শিকার আসমাকে অন্যের সাহায্যে সীমান্ত অতিক্রম করতে। তার সাথে গুলিবিদ্ধ পাঁচ মাস বয়সী শিশু। বর্বর বাহিনী বাড়িতে ঢুকে তাকে পাশবিক নির্যাতন করে। এতে আসমার স্বামী বাধা দেয়ায় স্বামীকে হাত-পা বেঁধে নিয়ে যায়। যাওয়ার সময় আসমার কোলে থাকা ৫ মাস বয়সী শিশু ছিল। এ সময় তাদেরকে গুলি করলে শিশুর কোমরে গুলি লাগে। আর আসমার পায়ে গুলি এক দিকে ঢুকে অন্য দিকে বের হয়ে যায়। আসমা জানেন না তার স্বামী জীবনে বেঁচে আছেন কি না। সীমান্ত অতিক্রম করার সময় আসমা ও তার শিশুসন্তানের আহাজারিতে স্থানীয়রাও চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি। পরে তাকে কুতুপালং এমএসএফ হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়া হয়।
কুতুপালং শরণার্থী শিবিরের মেডিক্যাল সেন্টারের চিকিৎসক ডা: মারুফ জানান, নতুন আসা রোহিঙ্গাদের কারণে চিকিৎসাপ্রার্থী মানুষের এখন খুব ভিড়। অসুস্থদের মধ্যে জখমপ্রাপ্ত ও গুলিবিদ্ধ রোগীও রয়েছে। এ চিকিৎসাকেন্দ্র ছাড়াও কুতুপালং এমএসএফ হল্যান্ড ক্লিনিকেও গুলিবিদ্ধ রোগীদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়। পরে কক্সবাজার বা চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাদের পাঠানো হয়। ইতোমধ্যে দুই শতাধিক গুলিবিদ্ধ রোহিঙ্গা এসব হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন, এখনো নিচ্ছেন। এদের মধ্যে অনেকেই মারা গেছেন।
নতুন আসা রোহিঙ্গাদের এখন খাদ্যের চেয়ে চিকিৎসাসেবা বেশি প্রয়োজন বলে মনে করেন স্থানীয় এনজিওকর্মী নুরুল ইসলাম। একই বক্তব্য বালুখালী গ্রামের বাসিন্দা মোহাম্মদ ইসলামের। তার মতে, নতুন আসা রোহিঙ্গাদের কারণে এখানে রোগব্যাধির বিস্তার ঘটতে পারে। তাই এখনই সরকারি পর্যায়ে বা এনজিওর মাধ্যমে জরুরি ভিত্তিতে মেডিক্যাল টিম গঠন করা প্রয়োজন।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো: আলী হোসেন জানান, নতুন আসা রোহিঙ্গাদেরকে মানবিক সাহায্য করা হচ্ছে। তাদেরকে খাবার, চিকিৎসাসেবা দেয়া হচ্ছে। স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসন তাদেরকে মানবিক সহযোগিতা দিচ্ছে।
টেকনাফের পাহাড় থেকে ৩২ রোহিঙ্গা উদ্ধার
টাকার জন্য পাহাড়ে পণবন্দী করে রাখা ৩২ রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করেছে বিজিবি। শুক্রবার বিকেলে টেকনাফ উপজেলার বাহারছড়া ইউনিয়নের উত্তর শীলখালী গ্রামের পূর্বে নুরারধারি পাহাড় থেকে বিজিবি ৩২ জন রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ-শিশুকে উদ্ধার করে। এদের মধ্যে সাতজন পুরুষ, ১৫ জন নারী ও ১০টি শিশু।
জানা যায়, জনপ্রতি ১০ হাজার টাকার দাবিতে বাহারছড়া ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের একটি রাজনৈতিক দলের সভাপতি ছৈয়দুল্লাহ তার ট্রলারে করে আনা ৩২ রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ-শিশুকে আটকে রাখেন। এ খবর জানাজানি হলে ট্রলার মালিক ছৈয়দুল্লাহ গত তিন দিনে তিনটি বাড়িতে স্থান পরিবর্তন করে শেষে এদেরকে পাহাড়ে নিয়ে রাখেন। টেকনাফ-২ বিজিবির উপ-অধিনায়ক জানান, দাবি মতে টাকা দিতে না পারায় রোহিঙ্গাদের আটকে রাখার কথা জানতে পেরে তাৎক্ষণিক বিজিবির দল অভিযান চালিয়ে তাদেরকে উদ্ধার করে। উপজেলার বিভিন্ন পয়েন্টে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। খবর পাওয়ার সাথে সাথে বিজিবি অভিযান চালিয়ে উদ্ধার করে আনছে।
বাহারছড়া ইউপি চেয়ারম্যান আলহাজ মাওলানা আজিজ উদ্দিন জানান, টাকার জন্য আটকে রাখা ৩২ রোহিঙ্গাকে বিজিবি উদ্ধার করার বিষয়টি শুনেছি। উদ্ধারকৃত রোহিঙ্গাদের বাহারছড়া তাফহীমুল কুরআন দাখিল মাদরাসার সুপার মাওলানা মোস্তাক আহমদ ও বাহারছড়া ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মো: আতিক উল্লাহ আতিক মানবিক সহায়তা দিয়ে শামলাপুরে পৌঁছে দিয়েছেন।
এক প্যাকেট ভাতে ৭ জনের ক্ষুধা নিবারণ
রহিম উল্লাহ। বয়স প্রায় ৪০। মিয়ানমার থেকে পালিয়ে স্ত্রী ও ছয় সন্তান নিয়ে উখিয়ার কুতুপালং পাহাড়ে আশ্রয় নিয়েছেন। দুই দিন ধরে অভুক্ত। স্ত্রী অসুস্থ। ক্ষুধার যন্ত্রণায় হাউমাউ করছে সন্তানেরা। অবশেষে শনিবার বেলা ২টার দিকে হাতে পেল কোস্ট ট্রাস্টের পক্ষ থেকে এক প্যাকেট ভাত। ছুটে গেলেন অস্থায়ী ঝুপড়ি বাসায় অপেক্ষারত অভুক্ত স্ত্রী-সন্তানদের কাছে। বাবার হাতে ভাতের প্যাকেট দেখে হাত বাড়িয়ে দিলো সন্তানেরা। রহিম উল্লাহ নিজ হাতে সন্তানদের পাতে তুলে দিলেন দুই মুঠো করে ভাত। অল্প হলেও পরিবার সবাই খেলো। কিন্তু অভুক্ত রয়ে গেলেন রহিম উল্লাহ। তাও বুঝতে দেননি স্ত্রী ও সন্তানদের। এটি ছিল শুধু রহিম উল্লাহর একটি পরিবারের চিত্র। এ রকম হাজারো রোহিঙ্গা পরিবার এখন খাবারের জন্য হাহাকার করছে। গাড়ি দেখলেই ছুটছে পেছনে।
রহিম উল্লাহ বলেন, আমাদের বাড়ি মিয়ানমারের রাসিদং দক্ষিণ শীলখালী এলাকায়। আমাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে সৈন্যরা। গুলি করে ও পুড়িয়ে মেরেছে স্বজনদের। প্রাণ বাঁচাতে ১৫ দিন আগে দেশ ছেড়েছি। দীর্ঘ পাহাড়-জঙ্গল পেরিয়ে দুই দিন আগে এখানে এসেছি। আসার পর থেকে কোনো খাবার ও পানি পাইনি। কিনে খাবার টাকাও নেই। পরিবার নিয়ে করুণ দিন কাটছে।
কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফজুড়ে এখন শুধু রোহিঙ্গা আর রোহিঙ্গা। যে দিকে চোখ পড়ছে সে দিকে কেবল রোহিঙ্গার ঢল। সীমান্তবর্তী এ দুই উপজেলা রোহিঙ্গায় ছেয়ে গেছে। গ্রাম, রাস্তা, পাহাড় এবং নদীর পাড় রোহিঙ্গাদের দখলে গেছে। এ দুই উপজেলায় এখন স্থানীয় বাসিন্দাদের চেয়ে রোহিঙ্গার সংখ্যা বেশি।
অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপে কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কে যানজট এখন নিত্যদিনের ঘটনায় পরিণত হয়েছে। বাজারে বেড়ে গেছে জিনিসপত্রের দাম। কক্সবাজার মালিক গ্র“পের সভাপতি রফিকুল ইসলাম বলেন, রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ এখানকার জনজীবনে মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। হাটবাজার এবং সড়ক রোহিঙ্গাদের দখলে চলে গেছে। শহীদ এ টি এম জাফর সড়ক (কক্সবাজার-টেকনাফ সড়ক) ও মেরিন ড্রাইভে রোহিঙ্গাদের ঢল নেমেছে।
এ দিকে রোহিঙ্গাদের নির্দিষ্ট স্থানে রাখার দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা। টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো: মাইন উদ্দিন খান জানান, রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের কারণে এখানকার আইনশৃঙ্খলা এবং ধর্মীয় সম্প্রীতি যেন নষ্ট না হয়, সে জন্য পুলিশের বিশেষ টিম দিনরাত কাজ করছে। হোয়াইক্ষ্যং ইউপি চেয়ারম্যান নুর আহমদ আনোয়ারী বলেন, রোহিঙ্গারা যেন ছড়িয়ে ছিটিয়ে না যেতে পারে সে জন্য তাদের আপাতত বিজিবির তত্ত্বাবধানে হোয়াইক্যং ইউনিয়নের রইক্ষ্যং এলাকার অস্থায়ী ক্যাম্পে রাখা হচ্ছে। টেকনাফ উপজেলা চেয়ারম্যান জাফর আহমদ জানান, এখনো স্রোতের মতো রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ অব্যাহত রয়েছে।
এ দিকে কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কে হাঁটার জায়গাটুকুও নেই। সর্বত্র রোহিঙ্গা আর রোহিঙ্গা। ইতোমধ্যে কক্সবাজার শহরের সমিতিপাড়া, নাজিরারটেক, কলাতলী ঝরঝরিকুয়া ও বিসিক এলাকায় আশ্রয় নিয়েছে কয়েক হাজার রোহিঙ্গা। এমনকি মহেশখালী, কুতুবদিয়া হয়ে পেকুয়া ও পটিয়া পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছে রোহিঙ্গারা। এ ছাড়া রামুর খুনিয়াপালং, দক্ষিণ মিঠাছড়ি, টেকনাফের বাহারছড়া ও শামলাপুরেও বনাঞ্চলে ঘর তুলছে।
উখিয়া-টেকনাফের সাবেক এমপি শাহজাহান চৌধুরী রোহিঙ্গাদের একটি নির্দিষ্ট স্থানে এবং সড়কের পাশের এলাকা থেকে দূরে রাখার দাবি জানিয়েছেন। কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো: আলী হোসেন বলেন, নতুন আসা রোহিঙ্গারা যাতে শহরে ও আশপাশে অবস্থান করতে না পারে, সে জন্য অনেক চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। এরপরও কেউ অবস্থান নিয়ে থাকলে তাদের আটক করে বালুখালী এলাকায় পাঠানো হবে।
কক্সবাজার-টেকনাফে রোহিঙ্গা শিশু আহত
কক্সবাজার-টেকনাফে ডাম্পারের ধাক্কায় তিন বছরের এক রোহিঙ্গা শিশু গুরুতর আহত হয়েছে। সে মংডুর হাইচ্ছুরাতা গ্রামের মো: ইয়াছিনের মেয়ে কাউছার বিবি। শিশুটির ডান পায়ের হাঁটু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। শুক্রবার বিকেলে টেকনাফ পৌরসভার পুরনো ট্রাক ট্রান্সপোর্টের সামনে এ দুর্ঘটনা ঘটে। টেকনাফ মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ মাঈন উদ্দিন খান দুর্ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, ডাম্পার গাড়িটি খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনা হবে।
রোহিঙ্গা বস্তি স্থাপনে সহায়তায় বন বিভাগের মামলা
কক্সবাজারের উখিয়া রেঞ্জের সরকারি বনভূমি দখল করে রোহিঙ্গাদের বস্তি নির্মাণে সহায়তা করার অভিযোগে উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের ইউপি সদস্য জয়নাল আবেদীন ও নুরুল আমিনসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে বন বিভাগ। ৬ সেপ্টেম্বর উখিয়া রেঞ্জের ভারপ্রাপ্ত রেঞ্জ কর্মকর্তা ফেরদাউস আহমদ বাদি হয়ে উখিয়া থানায় এ মামলা করেন। মামলায় অজ্ঞাত আরো ৫০-৬০ জনকে আসামি করেছে বন বিভাগ।
তবে অভিযোগ সত্য নয় দাবি করে ইউপি সদস্য নুরুল আমিন জানান, মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের বনভূমিতে ঘর নির্মাণে সহায়তা করা হয়েছে। উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (তদন্ত) মো: কায় কিসলু মামলার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।
দক্ষিণ চট্টগ্রামে আসা রোহিঙ্গাদের মানবেতর জীবন
দক্ষিণ চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলায় আশ্রয় নেয়া শত শত রোহিঙ্গা নারী পুরুষ ও শিশুরা মানবেতর জীবনযাপন করছে। গত দু’দিনে চন্দনাইশের বিভিন্ন এলাকায় আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা জানিয়েছেন, তাদের দুর্দশার কথা। অনেক আগে থেকে আশ্রয় নেয়া দুই সন্তানের মা নুর বেগম বলেন, ঈদের দু’দিন পর মংডুর মগনামা থেকে পরিবারের নারীশিশুসহ তারা ৯ জন আশ্রয় নেন টেকনাফের পাহাড়ি এলাকায়। সেখানে তারা অনাহারে অর্ধহারে মানবেতর জীবনযাপন করছিল। তাই তিনি এদের টেকনাফের দু’টি বিজিবি চেকপোস্ট ফাঁকি দিয়ে এখানে নিয়ে এসেছেন। পালিয়ে আসা পাঁচটি ছোট ছোট সন্তানের মা লালু বেগম (৩০) বলেন, জীবন বাঁচাতে এক কাপড়ে এখানে এসে আশ্রয় নিয়েছি। আমার আত্মীয় আশ্রয়দাতা নূর বেগমের অবস্থাও ভালো না। গত আড়াই বছর ধরে তার স্বামী মালয়েশিয়া গিয়ে আর ফিরে আসেনি। এমতাবস্থায় সে তার দুই সন্তান নিয়ে মানষের বাড়িতে ও জমিতে কাজ করে কোনোভাবে বেঁচে আছে। আমাদের বিপদের কথা জানতে পেরে টেকনাফ থেকে এখানে নিয়ে এসেছে। এ সময় তারা আকুতি জানিয়ে বলেন, আমাদের ধরিয়ে দেবেন না। আমরা আপনাদের মা-ভাইবোনের মতো।
গত শুক্রবার বিকেলে দোহাজারী বাজারে প্রায় ১৫ জন রোহিঙ্গা মুসলিম নরনারী ও শিশুর অপর একটি দলের সাথে দেখা হয়। এ সময় ওই দলে থাকা ইদ্রিচ (২৬), হান্নান (২৪) ও জমিলা (৩০) জানান, মিয়ানমারের সৈন্যরা সেখানে গুলি করে তাদের মারছে। অনাহারে অর্ধহারে, বিনা চিকিৎসায় বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়ায় এখানে পালিয়ে এসেছি। পরে তারা টেকনাফের জালিয়া পাড়া হয়ে বান্দরবানের পাহাড়ের ভেতর দিয়ে হেঁটে দোহাজারীতে এসেছেন। আসার পথে তাদের দুরবস্থা দেখে অনেককেই খাবার ও অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করেন বলে তারা জানিয়েছেন।

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/250480