১০ সেপ্টেম্বর ২০১৭, রবিবার, ১০:১৪

তিন কারণে বিপর্যয় ধান-চাল সংগ্রহে

অর্জিত হয়নি লক্ষ্যমাত্রার ৮৩ শতাংশ * পরিস্থিতি সামাল দিতে সাড়ে ৫ লাখ টন চাল আমদানির চুক্তি

এবারের বোরো মৌসুমে ধান-চাল সংগ্রহে দেখা দিয়েছে মহাবিপর্যয়। লক্ষ্যমাত্রার ৮৩ শতাংশই অর্জিত হয়নি। আগাম বন্যা, ব্লাস্ট রোগ ও অস্বাভাবিক চালের মূল্য বৃদ্ধি- এ তিন কারণেই এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এতে খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মধ্যে পড়বে বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের। তবে পরিস্থিতি সামাল দিতে জরুরি ভিত্তিতে ১৫ লাখ টন চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এরই অংশ হিসেবে সাড়ে ৫ লাখ টন চাল আমদানি করতে দুই দেশের সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছে। এছাড়া আরও দেড় লাখ টন চাল আমদানি করতে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র এবং খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটির সর্বশেষ বৈঠকের কার্যবিবরণী থেকে জানা গেছে এসব তথ্য।
গত মাসে অনুষ্ঠিত খাদ্য পরিধারণ কমিটির সর্বশেষ বৈঠকের পর খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেছিলেন, হাওর অঞ্চলে অকাল বন্যা এবং ব্লাস্ট রোগের কারণে এ বছর ফসলের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। যার পরিমাণ প্রায় ২০ লাখ টন। তাই আগাম সতর্কতা অবলম্বনের জন্য এ বছর ১৫ লাখ টন চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। মন্ত্রী জানান, ভিয়েতনাম থেকে আড়াই লাখ টন চাল আসবে। এরই মধ্যে ৫০ লাখ টন চাল দেশে এসেছে।
এদিকে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, আরও তিন লাখ টন চাল আমদানি করতে সম্প্রতি মিয়ানমারের সঙ্গে একটি চুক্তি হয়েছে। জানতে চাইলে সরকারি গবেষণা সংস্থা বিআইডিএসের সাবেক মহাপরিচালক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. এমকে মুজেরী যুগান্তরকে বলেন, বিভিন্ন কারণে কয়েক বছর ধরে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হচ্ছে না। এ বছর বেশি মাত্রায় লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হয়নি। এতে চালের দামও বেড়েছে। পাশাপাশি সরকারের নিরাপত্তা মজুদ হুমকির মধ্যে পড়েছে। তিনি বলেন, এখন দ্রুত চাল আমদানি করে নিরাপদ মজুদ গড়ে তুলতে হবে। কারণ এর বিকল্প কিছু নেই। সরকার এক্ষেত্রে শুধু বেসরকারি ব্যবসায়ীদের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে বিভিন্ন দেশ থেকে চাল আমদানির লক্ষ্যে সরকার টু সরকার চুক্তি করছে। তবে চুক্তির স্বচ্ছতা এবং নির্বিঘেœ যেন আমদানি হয়, সেদিকে লক্ষ রাখার পরামর্শ দিয়েছেন এই অর্থনীতিবিদ।
খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, চলতি বোরো মৌসুমে ১৫ লাখ টন খাদ্যশস্য সংগ্রহের লক্ষ্য স্থির করে সরকার। এর মধ্যে ৭ লাখ টন ধান ও ৮ লাখ টন চাল রয়েছে। চালের মধ্যে ৭ লাখ টন সিদ্ধ ও এক লাখ টন হচ্ছে আতপ। প্রতি কেজি ধানের মূল্য ২৪ টাকা ও সিদ্ধ চাল ৩৪ টাকা এবং আতপ ৩৩ টাকা নির্ধারণ করা হয়। ২ মে থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত মেয়াদে এ ধান-চাল সংগ্রহের সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়। সর্বশেষ তথ্যমতে, ২ লাখ ৫৬ হাজার ৫৪১ টন খাদ্যশস্য সংগ্রহ করা হয়েছে। এর মধ্যে ২ লাখ ৫২ হাজার ৪৫৯ টন ধান এবং ৪ হাজার ৮২ টন চাল রয়েছে। অর্থাৎ মোট লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ১৭ দশমিক ১০ শতাংশ সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে, যা এ যাবৎকালে বড় ধরনের বিপর্যয়। খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটির ওই বৈঠকের কার্যবিবরণী থেকে জানা গেছে, খাদ্য সংগ্রহের বিপর্যয়ের পেছনে তিনটি কারণ চিহ্নিত করা হয়। গত এপ্রিলে সিলেট হাওর অঞ্চলের বন্যায় বোরো ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়। পাশাপাশি বোরোতে ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত ও মৌসুমি বন্যাজনিত ক্ষতির কারণে ৫ শতাংশ বা প্রায় ১০ লাখ টন বোরো উৎপাদন কম হয়। এ পরিস্থিতিতে একই মাসের শেষদিকে ধান-চালের বাজার অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বমুখী হয়। আরও জানা গেছে, ২০১৬ সালের মার্চের তুলনায় গত মে মাসে পাইকারি বাজারে ১৩ শতাংশ মূল্য বৃদ্ধি পায় চালের। পরে জুনে আরও ৪ শতাংশ দাম বাড়ে। স্বাভাবিক নিয়ম অনুযায়ী, এ সময় ৬ শতাংশ মূল্য হ্রাস পাওয়ার কথা ছিল। এসব কারণে কৃষক ও মিলাররা সাড়া দেননি সরকারের ধান-চাল সংগ্রহ কর্মসূচিতে। ওই কার্যবিবরণীতে উল্লেখ করা হয়, সরকারের সংগৃহীত ধান ও চালের মূল্যের সঙ্গে অসামঞ্জস্য সৃষ্টি হয়েছে। কারণ সরকারের কেনা ধান দিয়ে চাল তৈরির পর প্রতি কেজির মূল্য দাঁড়াচ্ছে ৩৮ টাকা ৭০ পয়সা, যা ওই সময়ে বাজারমূল্য থেকে বেশি ছিল। এতে চালের বাজারে বিরূপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। যে কারণে শুধু বরিশাল বিভাগ ছাড়া বাকি ছয়টি বিভাগে ধান সংগ্রহ কার্যক্রম বন্ধ করে দেয় খাদ্য অধিদফতর। এছাড়া হাওর অঞ্চলে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে বর্ধিত হারে ত্রাণ বিতরণ করা হয়। পাশাপাশি বোরো ফসল থেকে লক্ষ্যমাত্রার ৬ লাখ টন চাল সংগ্রহ সম্ভব হয়নি। যে কারণে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের শুরুতে খাদ্যশস্যের সরকারি মজুদ আশঙ্কাজনক হারে হ্রাস পায়। ৪ সেপ্টেম্বরের হিসাবে সরকারি গুদামে মোট মজুদ হচ্ছে ৪ লাখ ৪৩ হাজার টন। এর মধ্যে চাল হচ্ছে ৩ লাখ ২১ হাজার টন এবং গম ১ লাখ ২২ হাজার টন। সাধারণত আপৎকালীন খাদ্য মজুদ কমবেশি সাত লাখ টন রাখা হয়। মজুদ পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে সরকারি পর্যায় ছাড়াও চাল আমদানিতে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করা হয়েছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ৯ এপ্রিল ২৯ শতাংশ থেকে শুল্ক কমিয়ে ১০ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়। পরে সেটি ২ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়।

https://www.jugantor.com/last-page/2017/09/10/154174/