হাত কেটে নেয়া রোহিঙ্গা যুবক চমেক হাসপাতালে ভর্তি -যুগান্তর
১০ সেপ্টেম্বর ২০১৭, রবিবার, ১০:১৩

চমেক হাসপাতালে আহত রোহিঙ্গাদের আর্তনাদ

দু’সপ্তাহে ভর্তি ৭০ ২ জনের মৃত্যু * অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক

ষোলো বছর বয়সী রোহিঙ্গা কিশোর মোহাম্মদ জুনায়েদ। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সেনারা তার মাথায় গুলি করে। পালিয়ে আসার পর তাকে ভর্তি করা হয় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (চমেক)। যন্ত্রণায় ছটফট করছে সে। চোখেমুখে চরম আতঙ্কের ছাপ। ছোট্ট শরীরে এত ধকল কিছুতেই সইতে পারছে না। শুধু জুনায়েদই নয়, প্রায় ৭০ জন আহত রোহিঙ্গার আর্তনাদে ভারি হাসপাতালটি। আহত অনেকের পাশে নেই কোনো স্বজনও। এর মধ্যে চিকিৎসাধীন অবস্থায় এক শিশুসহ দু’জনের মৃত্যু হয়েছে। আহতরা শিশু, বৃদ্ধ, নারীসহ বিভিন্ন বয়সের। এদের প্রায় সবাই গুলি-বোমার আঘাতে আহত হন। অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক। দুই সপ্তাহ ধরে সেনাদের বর্বর নির্যাতনের মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন তারা।


শনিবার সরেজমিন চমেক হাসপাতালে দেখা গেছে, পঞ্চম তলার ২৫ নম্বর সার্জারি ওয়ার্ডের বারান্দার একটি বেডে শুয়ে আছেন ৮০ বছর বয়সী বৃদ্ধ মো. সাহাব মিয়া। তিনি মিয়ানমারের মংডু থানার হাচুয়া গ্রামের মো. তৈয়বের ছেলে। তার মুখের বাম পাশে ও ঘাড়ে গুলি লেগেছে। গুরুতর আহত সাহাব মিয়াকে দেয়া হচ্ছে রক্ত। গত বুধবার রাতে তাকে হাসপাতালে নিয়ে আসেন স্বজনরা। ওই দিন সকালে মিয়ানমার সীমান্ত পাড়ি দিয়ে স্বজনদের সাহায্যে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন।

কর্তব্যরত নার্স জানান, তার অবস্থা এখনও সংকটাপন্ন। গুলি লেগে তার শরীর থেকে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। তাকে রক্ত দেয়া হচ্ছে। আরও রক্ত প্রয়োজন। আহত হওয়ার পর থেকে সাহাব মিয়া কথা বলতে পারছেন না।

টেকনাফের লামবাবিল সড়কে রোহিঙ্গাদের একটি দলে শিশুরা -যুগান্তর
হাসপাতালে তার সঙ্গে থাকা ছেলে মো. হাসেম যুগান্তরকে জানান, ২৫ আগস্ট দুপুরে জুমার নামাজের পর তাদের গ্রামে হঠাৎ আক্রমণ করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। পাড়ার চারদিক ঘিরে ঘরে ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়। তার বৃদ্ধ বাবাও জীবন বাঁচাতে লাঠিতে ভর করে পালানোর চেষ্টা করেন। এমন সময় মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ছোড়া গুলি এসে লাগে তার বাবার শরীরে। গুলিতে তার চোয়াল ও ঘাড়ের একাংশ উড়ে গেছে। এরপর ১১ দিন আহত বাবাকে তার আরেক ভাইসহ কাঁধে করে মাইলের পর মাইল হেঁটে বাংলাদেশে পাড়ি জমান। হাসেম বলেন, ‘আমরা ৪ ভাই ও ২ বোন। সবাই বাংলাদেশে চলে এসেছি। বাড়িতে হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল ও কৃষিজমি রয়েছে। সবকিছু পেছনে ফেলে জীবন বাঁচাতে বাংলাদেশে চলে এসেছি।’

হাসপাতালের পঞ্চম তলার ৩৫ নম্বর ওয়র্ডে চিকিৎসাধীন ১৪ বছরের রোহিঙ্গা শিশু মো. হারেছ। সে মিয়ানমারের মংডু থানার তৎবাজার গ্রামের সোনা মিয়ার ছেলে। তার বাম পায়ের ঊরুতে গুলি লেগেছে। বড় ভাই মো. রফিক তাকে মঙ্গলবার চমেক হাসপাতালে নিয়ে এসেছে। আহত শিশু হারেছ যুগান্তরকে জানায়, সেনাবাহিনীর ছোড়া গুলিতে সে আহত হয়। এর আগে তাদের বসতঘরটিও আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে সেনাবাহিনী। সে আরও বলেছে, ‘আমার চোখের সামনে দেখেছি অন্তত ৮-১০ জন গুলি খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আছে। পলায়নপর কয়েকজনের শরীরে আগুনও লাগিয়ে দেয় সেনারা। ভয়াবহ এ নির্যাতন নিজের চোখে না দেখলে কেউ বিশ্বাসও করতে পারবে না।’ আহত হারেছের বড় ভাই রফিক বলেন, ‘আমরা ৫ ভাই ২ বোন। এলাকায় আমাদের একটি চায়ের দোকান ছিল। বাবা কৃষিকাজ করতেন। ঘটনার পরপরই ভাইকে ভারে নিয়ে হাঁটা দেই। ১০ দিন পর বাংলাদেশে প্রবেশ করি।’

মিয়ানমারে জাতিগত সংঘাতের পর সর্বপ্রথম ২৬ আগস্ট সকালে চমেক হাসপাতালে ভর্তি হন মো. মোক্তার মিয়া (২৭) ও মো. মুসা (২২) নামে দুই যুবক। তারা দু’জনই গুলিবিদ্ধ। এর মধ্যে মুসা চিকিৎসাধীন অবস্থায় সেদিন বেলা সাড়ে ১১টার দিকে মারা যান। এখনও হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন মোক্তার মিয়া। তার বাম হাতের বাহুতে গুলি লেগেছে। তিনি যুগান্তরকে বলেন, ‘২৪ আগস্ট বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে হঠাৎ করে চারদিকে গুলির শব্দ শুনতে পাই। এলাকার লোকজন ভয়ে এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করতে থাকে। হঠাৎ আর্মির একটি গাড়ি থেকে ছোড়া গুলি এসে লাগে আমার বাম হাতের বাহুতে।’

মিয়ানমারের মংডু জেলার জেদিন্না থানার মেহেদী এলাকার গুল মোহাম্মদের ছেলে মোক্তার। জাহানারা বেগম নামে তার এক খালা তাকে চিকিৎসার জন্য চমেক হাসপাতালে নিয়ে আসেন। চমেক হাসপাতালের পঞ্চম তলার ২৬ নম্বর ওয়ার্ডে তিনি চিকিৎসাধীন। মোক্তার মিয়া আরও বলেন, ‘ঘরে আমার এক বছরের শিশুপুত্র রহিম, স্ত্রী খালেদা বেগম, মা আনোয়ারা বেগম, বাবা গুল মোহাম্মদসহ দুই ভাই এবং দুই বোন রয়েছে। বড় দুই ভাই আকতার মিয়া, জরাইদ মিয়া, দুই বোন সমুদা বেগম ও নুরহাবা বেগম। তারা কেমন আছে, বেঁচে আছে নাকি তাদের মেরে ফেলেছে তা জানি না।’

চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে শনিবার মালয়েশিয়া থেকে আসা ত্রাণ হস্তান্তর -যুগান্তর
সর্বশেষ শুক্রবার ভোরে মিয়ানমারে আহত আরও তিন শিশুকে চমেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এরা হল : মংডু থানার নয়াপাড়ার জাহেদ হোসেনের ছেলে মো. ছাদেক (৪), মেরুলা পাড়ার সৈয়দ হোসেনের মেয়ে জোবাইরা (১০) ও শামসুল আলমের মেয়ে নূর ছাদেকা (৫)। মিয়ানমারের মংডু থানায় তাদের বহনকারী গাড়িকে সে দেশের সেনাবাহিনী ধাওয়া দিলে গাড়িটি দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। এতে এই তিন শিশু আহত হয়। এদের মধ্যে ছাদেক ও নূর ছাদেকা ১১-বি নম্বর ওয়ার্ডে এবং জোবাইরা ২৮ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন রয়েছে।

চমেক হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক ডা. অজয় কুমার দে যুগান্তরকে বলেন, তাদের চিকিৎসার যাতে কোনো ত্রুটি না হয়, যথাযথ চিকিৎসাসেবা পায় সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডে নির্দেশনা দেয়া আছে। তাছাড়া হাসপাতালে যেসব ওষুধ নেই সেসব ওষুধ রোগী কল্যাণ সমিতির ফান্ডের টাকায় ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

চমেক পুলিশ ক্যাম্পের সহকারী এএসআই আলাউদ্দিন তালুকদার যুগান্তরকে জানান, মিয়ানমারে সংঘর্ষে আহত লোকজন প্রতিদিনই হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। ২৬ আগস্ট থেকে শনিবার পর্যন্ত প্রায় ৭০ জন রোহিঙ্গা ভর্তি হয়েছে। এরা গুলি, বোমা ও সড়ক দুর্ঘটনায় আহত।

এদিকে এএফপির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৬ বছরের কিশোর জুনায়েদ চমেক হাসপাতালে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। তারা বাবা মোহাম্মদ নাবী জানান, তারা মিয়ানমারের মংদু এলাকার বাসিন্দা। ছয় সন্তানকে নিয়ে পালানোর সময় সেনারা গুলি ছোড়ে। একটি গুলি জুনায়েদের চোখের ঠিক ওপরে মাথায় এসে লাগে। বাশির উল্লাহ নামে ১৪ বছর বয়সী আরেক শিশু পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে সীমান্তের কাছে একটি ক্লিনিকে ভর্তি হয়। সে বলে, আমি ভাগ্যবান, কারণ আমার খুব বেশি রক্তক্ষরণ হয়নি। সে জানায়, তাদের গ্রামে সেনারা বহু বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে এবং কয়েক ডজন লোককে গুলি করে হত্যা করেছে।

 

https://www.jugantor.com/last-page/2017/09/10/154173/