১০ সেপ্টেম্বর ২০১৭, রবিবার, ১০:০৩

জীবন যেন কচুরিপানা

তার ভাষায়, রোহিঙ্গাদের জীবন যেন 'দইজ্যার ফেনা'- বলেই চোখে চোখ রাখলেন আবদুল মতলব। জানতে চাইলেন, বুঝতে পেরেছি কি-না? না-বাচক উত্তর পেয়ে নিজেই বুঝিয়ে দিলেন দইজ্যা মানে দরিয়া, মানে সাগর। কিন্তু ফেনার প্রতিশব্দ খুঁজে না পেয়ে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিলেন। স্বল্প আলোর বৈদ্যুতিক বাতিতে তার চোখেমুখে যে অভিব্যক্তির প্রকাশ দেখতে পাই, তেমনটা রোহিঙ্গাদের আর পাঁচজনের মধ্যে খুঁজে পাওয়া কঠিন। অভিব্যক্তি দিয়ে তিনি কোনো কথা না বলেই অনেক কথা বোঝাতে পারেন বলে মনে হলো। তাকে এদিক-ওদিক তাকাতে দেখে জিজ্ঞাসা করি, 'ফেনা মানে কি কচুরিপানার কথা বলছেন?' মাথা নেড়ে জানালেন, উত্তর ঠিক হয়েছে। তারপর বলেন, রোহিঙ্গারা হলো কচুরিপানা। মাটিতে যার শিকড় পেঁৗছাতে পারে না। ঢেউয়ের তালে একবার এদিক, আরেকবার ওদিক ভাসে। যাদের নিজ দেশে নাগরিকত্ব নেই। নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত দেশহীন আর কোনো জাতি নেই।

আবদুল মতলব বাংলাটা ভালোই বুঝতে পারেন। কারণ শরণার্থী হয়ে বাংলাদেশে এসেছেন ১৪ বছর আগে, ২০০৩ সালে। তখন তার বয়স ছিল ৫৩ বছর। পেছনে রেখে এসেছিলেন চার ছেলে ও স্ত্রীকে। এতকাল তার ছেলেদের একজন ছাড়া বাকিরা মিয়ানমারেই ছিলেন। বড় ছেলে আয়াজ করনি ২০১২ সালের সহিংসতার সময় সাগরপাড়ি দিয়ে চলে যান মালয়েশিয়ায়। গত ২৪ আগস্টের পর মিয়ানমারে সেনা অভিযান শুরু হলে পরিবারের বাকি সদস্যরা সেখানে টিকে থাকতে না পেরে চলে এসেছেন বাংলাদেশে।

সম্পন্ন কৃষক পরিবারের ছেলে মতলব পড়াশোনা করেছিলেন মংডু ও বুচিডংয়ে। তবে পড়াশোনা শেষে ফিরে আসেন নিজ গ্রামে। মংডু টাউনশিপ থেকে ২০ কিলোমিটার দূরের গ্রাম উদংয়ে ফিরে আয় রোজগারের জন্য করেন চিড়িংঘের। পৈতৃক কৃষিকাজ তো ছিলই। এই সবের ফাঁকে জড়িয়ে পড়েন অং সান সু চির রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) সঙ্গে। তখনও ১৯৮২ সালের বিতর্কিত বর্ণবাদী নাগরিকত্ব আইন হয়নি, যে আইনে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব অস্বীকার করা হয়। মতলবের স্বপ্ন ছিল পশ্চাৎপদ রোহিঙ্গা সমাজের এগিয়ে যাওয়ায় ভূমিকা রাখবেন। কিছুই হলো না। বরং ২০০১ সালে আকিয়াবে রাখাইনদের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের সংঘাতের ঘটনায় জেলে যেতে হয় মতলবকে। মিয়ানমারে তখন সামরিক শাসন চলছে। সু চি অন্তরীণ। ২০০৩ সালে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে মতলব চলে আসেন বাংলাদেশে। তখন তার ছোট ছেলে মোহম্মদ জাবেরের বয়স ছিল সাত বছর।

মতলবের স্ত্রী উম্মে সেলিমা স্বামীর রেখে আসা সহায়-সম্পত্তির ওপর নির্ভর করে সংসার পরিচালনা শুরু করেছিলেন। তবে চলার পথটা যে কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না, সেটা এবার মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশ থেকে উদ্বাস্তু হয়ে আসা এই মানুষগুলোর সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারা গেছে। মতলব যে চিড়িংঘের করেছিলেন সেটা বেদখল হয়ে যায়, তিনি দেশ ছেড়ে আসার পরপরই। জমিজমাও রক্ষা করতে পারেননি।

মতলবের ছোট ছেলে জাবের এখন কুড়ি বছরের যুবক। শুক্রবার রাতে লেদা ক্যাম্পে তাদের সঙ্গে যখন আলাপ হয়, তখনও আতঙ্কঘোর কাটেনি জাবেরের। ২৫ আগস্ট সকালেই তারা বুঝতে পারেন, কিছু একটা গড়বড় হয়ে গেছে। প্রতিবেশী রাখাইনরা এসে হুমকি-ধমকি দিতে শুরু করে। তারপরও জাবেররা মাটি কামড়ে আরও দু'দিন বাড়িতেই থেকে যান। পরের তিন দিন ছিলেন বাড়ির কাছে বন-জঙ্গলে লুকিয়ে। সঙ্গে ছিল জাবেরদের ভাইয়ের স্ত্রী মানিরা ও তার তিন বছরের মেয়ে খমস্তা। ২৫ আগস্টের দু'দিন পর গ্রাম ছাড়ার সময়কার অবস্থা তুলে ধরে জাবের বলেন, 'দুই দিন বাদে আঁরার গ্রামর দালালেরা আই হরে মেরেটেরি অকরে এক্সপেল গইজে হইয়ে।' তার এই কথার বাংলা করলে দাঁড়ায়, দুই দিন পর এলাকার দালালরা এসে জানান তাদের গ্রামটাকে সেনাবাহিনী এক্সপেল করেছে। এক্সপেল শব্দটা দুর্বোধ্যই রয়ে গেল। পরে মতলব যা বোঝালেন, তা থেকে বোঝা গেল এক্সপেল দিয়ে গ্রামটিকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করার কথা বলছেন জাবের।

শুধু উদং রাখাইন প্রদেশের রোহিঙ্গা অধ্যুষিত গ্রামগুলোর সবই পরিত্যক্ত ঘোষিত হয়েছে। জাবেররা পরে নাইক্ষ্যংদিয়া এসে আর কিছুদিন কাটিয়েছেন পাহাড় ও প্যারাবনে। পরে উত্তাল বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে শাহপরীর দ্বীপ হয়ে বৃহস্পতিবার রাতে পেঁৗছেছেন টেকনাফের লেদা ক্যাম্পে। এখানেই বাবার সঙ্গে গাদাগাদি করে থাকছেন।

জাবেররা সৌভাগ্যবান। যখন লাখ লাখ রোহিঙ্গা ঘরহীন হয়ে কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়া এবং বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িতে ভেসে বেড়াচ্ছে, ভাতের জন্য মরণাপন্ন, ক্ষুধার জ্বালায় পেছনে ফেলে আসা স্বজনের লাশ নিয়ে শোক প্রকাশের ভাষাও ভুলে গেছে, তখন জাবের এবং তার মা, ভাই, ভাবি ও ভাতিজির আছে মাথা গোঁজার ঠাঁই।

শুক্রবার রাত ১১টার দিকে লেদা ক্যাম্প থেকে ফেরার পথে টেকনাফ রোডের আট কিলোমিটারের দু'ধারে ক্লান্ত হয়ে রোহিঙ্গাদের ঘুমিয়ে থাকতে দেখা গেছে। ভাগ্যবানরা স্থান পেয়েছে আবাসিক হোস্টেল হিলটপের পাশে নির্মীয়মান ভবনের ছাদে। ছেড়া সংসারের এলোমেলো কিছু সামগ্রীর মাঝে কাদামাটি মাখা মানুষের দল গাদাগাদি ঘুমাচ্ছিল।

পথে ঘুরে দেখার সময় খবর পাওয়া গেল টেকনাফ হাসপাতালে গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত চার রোহিঙ্গাকে ভর্তি করা হয়েছে। আহত চারজনের মধ্যে ইমাম শরিফ (২০) ছাড়া কারোর কথা বলার অবস্থা ছিল না। বাকি তিনজন জামিরা খাতুন (২৫), আবদুল করিম (২২) ও মোহম্মদ সোহেল (৮)। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিল ইমাম শরিফের। তবু যেটুকু বললেন, তা থেকে জানা গেল, আহত এই চারজনেরই গ্রাম মংডুর থুবুপাড়া। ১০ দিন আগে তাদের গ্রামে আগুন দেওয়া হয়। আগুন দেওয়ার পর গ্রাম ছেড়ে পালানোর সময় সেনাবাহিনী গুলি করে। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পাহাড়ে লুকিয়ে লুকিয়ে সীমান্তে আসতেই প্রাণশক্তি ক্ষয় হয়ে গেছে। গুলিবিদ্ধ হওয়ার পুরো ১০ দিন পর শুক্রবার রাতে টেকনাফ হাসপাতালে পেঁৗছান। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার পর তাদের কক্সবাজার হাসপাতালে পাঠানো হয়।

গতকাল শনিবারও শরণার্থীদের দীর্ঘ সারিতে কমবেশি আহত অনেক মানুষ দেখা গেছে। ক্ষত ঢেকে পথচলা মায়ের কোলে অনাহারী শিশুর কান্নায় বিচলিত কোনো কোনো মানুষ যে যার সাধ্যমতো সহযোগিতা নিয়ে এগিয়ে আসছেন। এমনই একটি দলের সঙ্গে দেখা হলো মৌচনি এলাকায়, তারা এসেছেন কক্সবাজারের পেকুয়া থেকে। তাদের একজন জামাল উদ্দিন বলেন, একেবারে নিজেদের টাকায় সামান্য কিছু কাপড়-চোপড় এবং শুকনো খাবার নিয়ে এসেছেন তারা। এই সামান্য সাহায্য পেয়েই অসামান্য হাসি ফুটল শরণার্থীদের মুখে, যারা পেছনে ফেলে এসেছে দগ্ধ গ্রাম, সহায়সম্পদ।

গতকাল সন্ধ্যার পর জানা গেল, রাখাইনের রাশিদং এলাকার চারটি গ্রাম চাঁনঙ্গানা, জোপালং, ফিংদং ও পালিপাড়ার দেড় হাজারের বেশি ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। পালিপাড়া থেকে সদ্য বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থী আবদুল্লাহ এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, শনিবার ভোরবেলায় আগুন লাগিয়ে দেওয়ার পর তার ভাই ইসমাইল গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে প্রায় ২০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে চলে এসেছেন ওপাড়ের সমুদ্রসৈকতে। সেখান থেকে বাংলাদেশি এক মাঝির মোবাইল ফোনে জানিয়েছেন, তিনি এখন গ্রামের আরও লোকজনের জন্য অপেক্ষা করছেন।

গত চার দিন ধরে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২৪ আগস্টের পর শুরু হওয়া সেনা অভিযানে প্রথমে মংডু ও বুচিডং টাউনশিপ এলাকা থেকে রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদ করা হয়েছে। এখন উচ্ছেদ শুরু হয়েছে রাশিদং টাউনশিপ এলাকায়। লেদা রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য মো. রশিদ বলেন, রাশিদং টাউনশিপের ২৯টি রোহিঙ্গা গ্রামে লাখখানেক রোহিঙ্গা রয়েছে। ২৪ আগস্টের পর থেকে ইতিমধ্যে রাশিদং থেকে ২০ হাজারের মতো রোহিঙ্গা চলে এসেছে। গতকালের আগুনের পর আরও অন্তত ৩০ হাজার বাংলাদেশের দিকে রওনা করেছে।

এদিকে গতকাল দুপুরে টেকনাফের নিবন্ধিত নয়াপাড়া ক্যাম্প পরিদর্শন করেছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া। এ সময় তিনি সদ্য মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের খোঁজখবর নেন। এ সময় তিনি বলেন, রাখাইন প্রদেশে সহিংসতার পর প্রাণে বাঁচতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের একত্র করে নিবন্ধন করা হবে। এই জন্য একটি জায়গাও খোঁজা হচ্ছে।

http://www.samakal.com/whole-country/article/1709454/