১০ সেপ্টেম্বর ২০১৭, রবিবার, ৮:৫৭

রাখাইনে সামরিক অভিযান এবং ভারতের সামরিক অভিযানের মিল অমিল

গত ৮ জানুয়ারি শুক্রবারের পত্রপত্রিকায় ফলাও করে খবর বেরিয়েছে যে মিয়ানমার সফরকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বার্মার জাতিগত নিধন বা নির্মূল নীতির প্রতি পূর্ণ সমর্থন দিয়েছেন। রোহিঙ্গা মুসলমানদের রক্তচোষক দানবী পররাষ্ট্রমন্ত্রী অং সান সূচির সাথে আলোচনার পর নরেন্দ্র মোদি এই নিঃশর্ত সমর্থন ব্যক্ত করেছেন। ঢাকার প্রায় সবগুলো কাগজে এ সম্পর্কে বিস্তারিত বেরিয়েছে। তাই এ সম্পর্কে আর বিস্তারিত কিছু বললাম না। তার বক্তব্যের সংক্ষিপ্ত সার হচ্ছে-
(১) যত দোষ তা সব ঐ নন্দ ঘোষের। রাখাইন রাজ্যে আজ যে গণহত্যা চলছে এর জন্য দায়ী ঐ রোহিঙ্গা মুসলমানরা। আর বর্মী মিলিটারি যে শত শত মানুষকে হত্যা করছে, হাজার হাজার বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিচ্ছে, হাজার হাজার নারীকে ধর্ষণ করছে , অসংখ্য শিশুকে নদী ও সমুদ্রে নিক্ষেপ করছে, সেটি তারা করছে তাদের জাতীয় নিরাপত্তার কারণে।
(২) রোহিঙ্গা মুসলমানরা হলো সন্ত্রাসী। তারা বর্মী পুলিশ ও সেনাবাহিনীর ওপর আক্রমণ করছে। তখন পাল্টা আক্রমণ হিসাবে বর্মী বাহিনী ঐ সব তথাকথিত সন্ত্রাসীকে নির্মূল করতে গিয়ে পাল্টা ব্যবস্থা নিচ্ছে।

(৩) রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপরে যে আকাশ থেকে গুলি করা হচ্ছে, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে, নির্বিচারে ধর্ষণ করা হচ্ছে এবং শিশুদেরকে পানিতে ফেলে দেয়া হচ্ছে সে সম্পর্কে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি।
(৪) বিশাল ভারতের জনসংখ্যা ১২০ কোটি। সেখানে মাত্র ৪০ হাজার রোহিঙ্গা ভারতের এখানে ওখানে অনুপ্রবেশ করেছে। সেই ৪০ হাজার রোহিঙ্গাকেও ভারত থেকে বের করে দেয়ার অঙ্গীকার করেছেন নরেন্দ্র মোদি।
(৫) ১২০ কোটি লোকের কাঁধে ৪০ হাজার মানুষ নাকি বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিšুÍ ১৯৭১ সালে ভারতের জনসংখ্যা ছিল যখন ৮০ কোটি তখন বাংলাদেশের এক কোটি মানুষ ভারতের ওপর কোনোই বোঝা হয়নি।
(৬) ১৯৭১ সালে পাকবাহিনী বাংলাদেশীদের ওপরে যে ক্র্যাকডাউন করেছিল সেটিকে ভারত বলেছিল জেনোসাইড বা গণহত্যা। শুধুমাত্র ভারত কেন, বিশ্ব সম্প্রদায় সাধারণভাবে তাই বলেছিল। সেই বলাটা সঠিক ছিল।
(৭) কিন্তু আজ যখন রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর বর্মী বৌদ্ধ হানাদার বাহিনী প্রচন্ড ক্র্যাকডাউন করেছে, শুধু বিগত ১৩ দিনে ১ হাজার মানুষকে হত্যা করেছে, সেটিকে ভারত গণহত্যা বা জেনোসাইড বলা তো দূরের কথা, বরং ভারত নির্লজ্জভাবে গণহত্যাকে সমর্থন করেছে।

(৮) সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গা মুসলমানদের সংখ্যা ১১ লাখ। এর আগে ২ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। এবার বিগত ১৪ দিনে পালিয়ে এসেছে আরো ২ লাখ। সাধারণ হিসাবেই মোট ৪ লাখ। একটি জনগোষ্ঠীর প্রায় অর্ধেক নিজের দেশ ছেড়ে শরণার্থী হয়ে বাংলাদেশে এসেছে। সেটির নিন্দা করা তো দূরের কথা, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বরং লাখ লাখ মুসলমানদের এই বিতাড়নকে নগ্নভাবে সমর্থন করেছেন।
কেন তারা রোহিঙ্গা নামক একটি আস্ত জাতি-গোষ্ঠীকে নির্মূল বা নিধন করার সহযোগী বনেছে? উত্তরটি অত্যন্ত সোজা। ভারতের শত বছরের ইতিহাস ঘাঁটার প্রয়োজন নাই। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর ভারত এই উপমহাদেশেই হানাদারের ভূমিকা গ্রহণ করেছে। তারা বড়দা হিসাবে লাঠিয়াল সেজে একটির পর একটি রাজ্য দখল করেছে। বর্তমান প্রজন্ম ভারতের সাম্রাজ্যবাদী হিং¯্র রূপ সম্পর্কে অবগত নয়। তাদের অবগতির জন্য নিচে ভারতীয় সেনাবাহিনীর দখলদারিত্বের কয়েকটি কাহিনী তুলে ধরছি।
॥দুই॥
(১) গোয়া : মনোহর পারিকর বর্তমানে ভারতের অন্যতম রাজ্য গোয়ার মুখ্যমন্ত্রী। কয়েক দিন আগে তিনি ছিলেন ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী। কিন্তু এই গোয়া তো ভারতের রাজ্য ছিল না। ১৯৬১ সালের ১৮ই ডিসেম্বর পর্যন্ত গোয়া ছিল ভারতের একটি দেশীয় রাজ্য। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর গোয়া স্বাধীন থাকতে চেয়েছিলো। কিন্তু ১৯৬১ সালের ১৯ ডিসেম্বর ভারতীয় বাহিনী গোয়া আক্রমণ করে, দখল করে এবং গোয়াকে ভারতের সাথে সংযুক্ত করে।

(২) দমন : আর একটি দেশীয় রাজ্যভুক্ত শহর ছিলো দমন। এই ক্ষুদ্র এলাকাটিও স্বাধীন থাকতে চেয়েছিল। ১৯৬১ সালের সামরিক অভিযানের সময় গোয়ার সাথে সাথে ভারত দমনও দখল করে নেয় এবং ভারতের সাথে সংযুক্ত করে।
(৩) দিউ : দিউ ছিল আর একটি ক্ষুদ্র এলাকা। গোয়া এবং দমন দখল করার সময় ভারতীয় হানাদার বাহিনী দিউও দখল করে নেয়।
(৪) জুনাগড় : একই পরিণতি বরণ করে জুনাগড়। ভারত বিভক্তির আগে জুনাগড় প্রথমে ছিল সৌরাষ্ট্রে। পরে বোম্বের সাথে অন্তর্ভুক্ত হয়। ভারতের প্রশাসনিক কাঠামোর পুনর্বিন্যাসের সময় জুনাগড়কে গুজরাটের সাথে সংযুক্ত করা হয়। এই জুনাগড়ের মালিকানা নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে একটি সংক্ষিপ্ত সীমিত যুদ্ধ হয়। ১৯৪৭ সালের ৯ নভেম্বর ৭ লাখ অধিবাসী অধ্যুষিত জুনাগড়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী সামরিক অভিযান চালায় এবং জুনাগড় দখল করে নেয়।

(৫) মানভাদাড় : ১৯৪৭ সালে ১৪ ই অগাস্ট ভারত বিভক্ত হলে ২৫ সেপ্টেম্বর মানভাদাড় পাকিস্তানে যোগদান করে। কিন্তু ভারত এই যোগদান মেনে নিতে পারেনি। তারা বলে যে, মানভাদাড় জুনাগড়ের আশ্রিত রাজ্য। সুতরাং সে পাকিস্তানে যোগ দিতে পারে না। এই অজুহাতে ভারতীয় সেনাবাহিনী জুনাগড়েও অভিযান চালায় এবং সেটি দখল করে নেয়।
(৬) হায়দারাবাদ : ভারতীয় দখলদারিত্ব নিয়ে সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয় হায়দারাবাদে। হায়দারাবাদের শাসক ছিলেন নিজাম। হায়দারাবাদ দখলের কাহিনী দীর্ঘ এবং হৃদয়বিদারক। শতবর্ষ ধরে হায়দারাবাদ স্বাধীন রাজ্য হিসাবে তার অবস্থান বজায় রাখে। ভারত বিভক্ত হলে ঐতিহ্য অনুযায়ী হায়দারাবাদ স্বাধীন থাকতে চায়। হায়দারাবাদের নিজামের নিয়মিত সেনাবাহিনীও ছিল। তবে সেটি ছিল ক্ষুদ্্র। আর ছিল আধা-সামরিক বাহিনী। এই আধা-সামরিক বাহিনীর অধিনায়ক ছিলেন কাশেম রিজভী। নিজাম ঘোষণা করেন যে তার রাজ্য ভারতেও যাবে না, পাকিস্তানেও যাবেন না। পাকিস্তান এই অবস্থান মেনে নেয়। কিন্তু ভারত সেটি মেনে নেয়নি। তখন অর্থাৎ ১৯৪৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ‘অপারেশন পোলো’ নাম দিয়ে ভারত হায়দারাবাদে হামলা চালায়। নিজামের বাহিনীও ভারতীয় বাহিনীকে রুখে দাঁড়ায়। ৫ দিনব্যাপী চলা এই রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে নিজামের ৪০ হাজার মুসলমান সৈন্যকে হত্যা করে ভারত হায়দারাবাদে ভারতীয় পতাকা উত্তোলন করে। হায়দারাবাদ যুদ্ধের তদন্ত করার জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওহর লাল নেহরু সুন্দর লালের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করেন। সুন্দর লাল কমিটির রিপোর্ট মোতাবেক ভারতীয় হামলায় দুই ললা মানুষ নিহত হয়।

(৭) সিকিম : সিকিমের রাজা ছিলেন চোগিয়াল। এটি ছিল একটি দেশীয় রাজ্য। ১৯৪৭ সালের পরে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত একটি স্বতন্ত্র রাজ্য হিসাবে অবস্থান করে সিকিম। ১৯৭৫ সালে ভারতীয় বাহিনী সিকিমে প্রবেশ করে। ভারতীয় বাহিনীকে আহ্বান জানায় সিকিমের ভারতীয় এজেন্ট লেন্দুপ দর্জি। ১৯৭৫ সালে সামরিক অভিযানের মাধ্যমে ভারত সিকিমকে ভারতীয় ইউনিয়নে সংযুক্ত করে।

(৮) কাশ্মীর : ভারতের সা¤্রাজ্য লিপ্সার সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো কাশ্মীর। কাশ্মীরের ইতিহাস এই উপমহাদেশের সকলেই মোটামুটি জানেন। এটিও একটি দেশীয় রাজ্য। জম্মু ও কাশ্মীর নামক এই রাজ্যটির রাজা ছিলেন হরি সিং। কিন্তু রাজ্যের ৯০ শতাংশ মানুষ ছিলেন মুসলমান। ভারত বিভক্তির অন্যতম শর্ত ছিল এই যে কাশ্¥ীরের জনগণ যদি ভারতে যোগদান করতে চায় তাহলে কাশ্মীর ভারতের হবে, আর যদি পাকিস্তানে যোগদান করতে চায় তাহলে কাশ্মীর পাকিস্তানের হবে। কাশ্মীরের ৯০ শতাংশ মানুষ পাকিস্তানে যোগদানের পক্ষে ছিলেন। কিন্তু মহারাজা হরি সিং হিন্দু হওয়ার সুবাদে ভারতে যোগদানের ঘোষণা করলে কাশ্মীরের ৮০ লাখ মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। তখন ভারত কাশ্মীরে সেনা অভিযান চালায় এবং পাকিস্তানও সেটি প্রতিহত করার চেষ্টা করে। এটি ছিল প্রথম পাক-ভারত যুদ্ধ। এই যুদ্ধে কাশ্মীরের তিন ভাগের দুই ভাগ দখল করে নেয় ভারত। এক ভাগ থাকে পাকিস্তানের দখলে। কাশ্মীরের পাকিস্তানী অংশের নাম আজাদ কাশ্মীর। ভারতীয় অংশের নাম জম্মু ও কাশ্মীর। কাশ্মীরের ভারতীয় অংশে বিগত ৭০ বছর ধরে ভারতীয় গোলামীর শৃঙ্খলমুক্ত করার জন্য লড়ে যাচ্ছে কাশ্মীরী মুসলমানরা। এপর্যন্ত ১ লাখ কাশ্মীরী শহীদ হয়েছেন ভারতীয় বাহিনীর হাতে।

(৯) পাঞ্জাব : সকলেই জানেন যে ভারত বিভক্তি বলতে বোঝায় পাঞ্জাব এবং বাংলার বিভক্তি এবং এই দুইটি প্রদেশ বিভক্ত হওয়ার ফলেই সংঘটিত দাঙ্গায় ৫ লাখ মানুষ নিহত হন। ভারত বিভক্তির সময় পাঞ্চাবের হিন্দু এবং শিখ সম্প্রদায় মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়। ফলে পাঞ্জাব বিভক্ত হয়ে এক অংশ পাকিস্তানে এবং আর এক অংশ ভারতে যায়। কিন্তু ভারত বিভক্তির কয়েক দশক পর শিখ জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে যে আন্দোলন গড়ে ওঠে তার নাম ছিল স্বাধীন খালিস্তান আন্দোলন। বর্তমান পাঞ্জাব এবং হরিয়ানা ও হিমাচল প্রদেশ স্বাধীন খালিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হবে বলে দাবি করা হয়। এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয় আকালিদল।

১৯৮০ সালে স¦াধীন খালিস্তান আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে। এর নেতৃত্ব দেন শিখ সন্ন্যাসী সন্ত জর্নাল সিং ভিন্দ্রেনওয়ালা। ভারতীয় সেনা বাহিনীর আক্রমণের মুখে ভিন্দ্রেনওয়ালা ৭৫০ জন অনুচরসহ শিখদের পবিত্রতম স্থান স্বর্ণমন্দিরে আশ্রয় নেন। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নির্দেশে স্বর্ণমন্দিরে ১৯৮৪ সালে ‘অপারেশন ব্লু স্টার’ নামক সামরিক অভিযান পরিচালিত হয়। এই অভিযানে ৭৫০ জন অনুগামীসহ ভিন্দ্রেনওয়ালা নিহত হন।
এই ম্যাসাকারের মাত্র চার মাস পর ১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর দুইজন শিখ দেহরক্ষীর গুলিতে ইন্দিরা গান্ধী নিহত হন। এই দুইজন দেহরক্ষীর নাম ছিল সতবন্ত সিং ও বিয়ান্ত সিং।
ওপরের এই আলোচনা থেকে দেখা যাচ্ছে যে ভারতের উপরোক্ত রাজ্য ও কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল সামরিক বাহিনীর বল প্রয়োগের মাধ্যমে ভারতভুক্ত হয়েছে এবং আজও ভারভুক্ত আছে। এসব অঞ্চলে যদি গণভোট দেয়া হয়, যদি জনগণকে স্বাধীনভাবে তাদের মতামত প্রকাশ করার স্বাধীনতা দেয়া হয়, তাহলে ভারতের মানচিত্র অক্ষত থাকবে কিনা, সন্দেহ আছে।
সেই ভারত যে অং সান সু চি তথা মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর গণহত্যা, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ এবং নারীদের গণধর্ষণকে অন্ধভাবে সমর্থন করবে তাতে আর বিস্মিত হওয়ার কিছু নাই।

http://www.dailysangram.com/post/299138