৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭, শনিবার, ৮:১৯

চামড়াশিল্পে বিপর্যয়ের শঙ্কা

দেশের মোট চাহিদার ৪০ শতাংশ চামড়াই সংগ্রহ হয়ে থাকে কোরবানির ঈদ মৌসুমে। বাকি ৬০ শতাংশ সংগ্রহ হয় বছরজুড়ে। কিন্তু এ বছর বিপর্যয়ের শঙ্কা দেখা দিয়েছে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানি খাত চামড়া শিল্পে। কোরবানির ঈদ মৌসুমে কাঁচা চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হচ্ছে না। এ ছাড়া দাম কম হওয়ায় চামড়া পার্শ্ববর্তী দেশে পাচারের ঝুঁকি আরো বেড়েছে।
চামড়াশিল্প-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ বছর কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৪০ শতাংশ কম হতে পারে। এ ক্ষেত্রে তাঁরা বেশ কিছু কারণ উল্লেখ করেছেন। চলতি বছরে কোরবানির পশুর চামড়া মজুদদার ও পাচারকারীদের হাতে চলে যাওয়া, সাভারের ট্যানারি স্থানান্তর নিয়ে টানাপড়েন, বিদেশি ক্রেতাদের আস্থাহীনতায় গোটা চামড়াশিল্পে বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন তাঁরা।
সরকার বরাবরের মতোই এবারও ঈদুল আজহায় কোরবানির পশুর চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দেয়। কিন্তু তা গড়পড়তা বাজারদরের চেয়েও কম। এর ওপর ট্যানারি মালিকরা একজোট হয়ে সেই দাম আরো কমিয়ে আনে।
আর এই সুযোগে মজুদদার ও এক শ্রেণির মৌসুমি ব্যবসায়ী কিছুটা বাড়তি দামে কাঁচা চামড়া সংগ্রহে তত্পর হয়ে ওঠে। আর মৌসুমি খুদে ব্যবসায়ীরাও কিছুটা লাভের আশায় ঝুঁকে পড়েছে তাদের দিকে। কোরবানির দিনই ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলার প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা এভাবে মাঠপর্যায়ের বেশির ভাগ কাঁচা চামড়া কিনে নেন। এরই মধ্যে বেশির ভাগ চামড়া মজুদদার ও পাচারকারীদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। খুদে মজুদদারদের কাছ থেকে চামড়া সংগ্রহে তাদের তত্পরতা এখনো অব্যাহত রয়েছে।
ওদিকে ট্যানারিগুলো পর্যাপ্ত ব্যাংকঋণ না পেয়ে নগদ অর্থে অধিক দামে চামড়া কিনতে পারছে না। এ অবস্থায় সংগৃহীত চামড়া অজানা স্থানে মজুদ করছে ব্যবসায়ীরা। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এসব কাঁচা চামড়া নগদে একটু বাড়তি দামে প্রতিবেশী দেশ ভারতে পাচার হয়ে যেতে পারে।

সংশ্লিষ্টরা বলছে, প্রতিবেশী দেশের বাজারে চামড়ার মূল্য বাংলাদেশের তুলনায় অনেক বেশি। ফলে সংগৃহীত চামড়ার বড় অংশই সে দেশে পাচার হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আর এই আশঙ্কা সত্যি হলে দেশের চামড়াশিল্পে বিপর্যয় নেমে আসবে। দেশও বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা থেকে বঞ্চিত হবে।

এ বছর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ৪০ শতাংশ চামড়া কম সংগ্রহ হতে পারে বলে আশঙ্কা ব্যক্ত করেন বাংলাদেশ হাইড স্কিন অ্যান্ড রিটেল ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক লোকমান মৃধা। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, বাংলাদেশে কোরবানির পশুর চামড়া উন্নত মানের হওয়ায় প্রতিবছরই এর উল্লেখযোগ্য অংশ পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার হয়ে যায়। ভারতে বিশেষ করে ‘এ’ থেকে ‘ডি’ গ্রেডের চামড়ার বেশ চাহিদা রয়েছে। তিনি আরো বলেন, সাভারের হেমায়েতপুরে চামড়াপল্লীতে যাওয়া ট্যানারির বেশির ভাগ এখনো কাজ শেষ করে উঠতে পারেনি। এ অবস্থায় বাংলাদেশের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের মান এবং রপ্তানির সক্ষমতা নিয়ে বিদেশি ক্রেতাদের মধ্যে এক ধরনের আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। ফলে ওই সব ক্রেতা বর্তমানে ভারত থেকে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য সংগ্রহ করছে। গোটা চামড়াশিল্পেই এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

ঢাকা জেলা চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পদক রবিউল আলম বলেন, ‘দাম কম পাওয়ার আশঙ্কায় এ বছর কোরবানির পশুর চামড়ার অধিকাংশই মজুদদার, আড়তদার ও পাচারকারীদের হাতে চলে গেছে। ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলার প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে কম দামে কিনে নিয়েছেন মাঠপর্যায়ের বেশির ভাগ চামড়া। তারা স্থানীয় বাজারে চামড়া না তুলে নিজস্ব কায়দায় তা সংরক্ষণ করছেন। এই চামড়া বাংলাদেশে রাখা সম্ভব হবে কি না তা নিয়েও যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। কারণ ভারতে বাংলাদেশের চামড়ার কদর ও দাম অনেক বেশি। ফলে চোরাকারবারিরা চামড়া পাচারের চেষ্টা করবেই। ’
রবিউল আরো বলেন, ট্যানারি মালিকরা সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ বেশি দামে কাঁচা চামড়া কেনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তবে ওই দামে কিনলেও মৌসুমি ব্যবসায়ীদের ৫ শতাংশ লোকসান হবে। কেননা লবণ, কারিগর, ঘরভাড়া, পরিবহন খরচ, আড়তদারদের কমিশনসহ এমনিতেই সরকারি দরের চেয়ে ২০ শতাংশ খরচ বেড়ে যায়। ব্যবসায়ী সমিতির এই নেতা বলেন, ‘ব্যাংকঋণ না পাওয়ায় ট্যানারির মালিকরা এ বছর চামড়া কিনতে চাইবেন বাকিতে। ট্যানারি রপ্তানিমুখী না হওয়া পর্যন্ত সেই বকেয়া তাঁরা পরিশোধ করতে পারবেন না। আর মালিকদের এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে পাচারকারী চক্র আরো সক্রিয় হয়ে উঠবে। পাচারের উদ্দেশ্য সামনে রেখে তারা তুলনামূলক বেশি দামে চামড়া কিনবে। ’

 

http://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2017/09/09/540564