৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭, শনিবার, ৮:১৭

এনবিআরের উদাসীনতা

ভেস্তে যাচ্ছে গ্রিন ট্যাক্স আদায়ের উদ্যোগ

নির্ধারিত কোডে কোনো টাকা জমা পড়েনি * হালনাগাদ হচ্ছে না দূষণকারী প্রতিষ্ঠানের তালিকা

জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবেলায় ৩ বছর আগে পরিবেশ সুরক্ষা সারচার্জ বা গ্রিন ট্যাক্স আরোপ করে সরকার। উদ্দেশ্য ছিল দূষণকারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে অর্থ আদায় করে পরিবেশের উন্নয়নে ব্যয় করা। অথচ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) অধীনস্ত ভ্যাট কমিশনারেটগুলোর এ সারচার্জ আদায়ে একেবারেই আগ্রহ নেই। আদায় করা অর্থ এনবিআর নিজেদের কোষাগারে জমা দেখাতে পারে না এবং এটি এনবিআরবহির্ভূত কর হিসেবে বিবেচিত হয় বলেই এ অনাগ্রহ। মূলত এনবিআরের গড়িমসির কারণেই সরকারের উদ্যোগটি ভেস্তে যেতে বসেছে। এদিকে বিষয়টি নিয়ে পরিবেশ অধিদফতরেরও সাড়া-শব্দ নেই। একবার দূষণকারী প্রতিষ্ঠানে তালিকা তৈরি করেই সব দায়িত্ব যেন শেষ। দূষণকারী প্রতিষ্ঠানের তালিকা হালনাগাদ করার কথা থাকলেও সেটি হচ্ছে না।

২০১৪-১৫ সালের বাজেটে অর্থ বিলের মাধ্যমে পরিবেশ সুরক্ষা সারচার্জ আরোপ করা হয়। ওই বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘অর্থনৈতিক বিকাশের ক্ষেত্রে দেশীয় শিল্প খাতের উন্নয়নের বিকল্প নেই। কিন্তু শিল্পোন্নয়নের প্রতিক্রিয়ায় মাটি, বায়ু ও পানি দূষণের বিষয়টি উপেক্ষণীয় নয়।’ তাই দেশীয় শিল্পের যে সব খাত পরিবেশ দূষণের ক্ষেত্রে অতিমাত্রায় সংবেদনশীল, সে সব শিল্প মালিকদের বর্জ্য শোধনাগার (ইটিপি) স্থাপনে উৎসাহিত করা, পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন করার প্রয়াস হিসেবে হানিকর শিল্প প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত সব ধরনের পণ্যের ওপর মূল্যভিত্তিক ১ শতাংশ হারে পরিবেশ সুরক্ষা সারচার্জ বা গ্রিন ট্যাক্স আরোপের প্রস্তাব করেন তিনি। পরে সংসদে প্রস্তাবটি আইন আকারে পাস হয়। সে সময় সরকারের এ পদক্ষেপের প্রসংসা করে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো।

এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৪ সালের ৩০ জুন এনবিআর সারচার্জ আদায় বিধিমালা জারি করে। এরপর পরিবেশ দূষণকারী প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করতে অধিদফতর ও এনবিআরের মধ্যে বহু চিঠি চালাচালি হয়। ২১ অক্টোবর সারচার্জ জমা নেয়ার অর্থনৈতিক কোড বরাদ্দ দেয়। পরে ২০১৫ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি পরিবেশ দূষণকারী ৭৫৭টি প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়, যার মধ্যে একটিও স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান নেই। অথচ হরহামেশাই অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে পরিবেশ অধিদফতর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করছে। এরপর ২১ নভেম্বর নতুন করে উন্নয়ন সারচার্জ ও লেভি (আরোপ ও আদায়) আইন করে সরকার। ওই আইনের আওতায় পরবর্তীতে চলতি বছরের ২০ জুন নতুন বিধিমালা জারি করা হয়।

যুগান্তরের অনুসন্ধানে জানা গেছে, এনবিআর থেকে পরিবেশ উন্নয়ন সারচার্জ জমা দেয়ার যে অর্থনৈতিক কোড (১-১১০৩-০০০১-২২১৩) বরাদ্দ দেয়া হয়েছে তাতে এক টাকাও জমা হয়নি। তবে এনবিআরেরই অন্য আরেকটি কোডে (১-১১০৩-০০০০-২২১৩) সারচার্জের কিছু টাকা জমা হয়েছে। এতেই এনবিআরের উদাসীনতার প্রমাণ পাওয়া যায়। হিসাব মহানিয়ন্ত্রকের (সিজিএ) কার্যালয়ের আইবাস প্লাস সিস্টেমের তথ্য মতে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ১১ লাখ ৮৯ হাজার টাকা জমা হয়েছে। এ টাকা জমা দেয়া হয়েছে সিলেট, বগুড়া, রংপুর ও ঢাকা ভ্যাট কমিশনারেট থেকে। আর ২০১৬-১৭ অর্থবছরে জমা পড়েছে ৯৯ লাখ ৮৫ হাজার টাকা।

২০১৬-১৭ অর্থবছরের আদায়কে ভিত্তি ধরে হিসাব করলে দেখা যাবে, ১ শতাংশ হারে সারচার্জ আদায় করে মোট রাজস্ব প্রাপ্তি প্রায় ১ কোটি টাকা। অর্থাৎ দূষণকারী ৭৫৭টি প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক টার্নওভার ১০০ কোটি টাকা। সে হিসাবে গড়ে প্রতিষ্ঠানের টার্নওভার দাঁড়ায় মাত্র ১৩ লাখ ২১ হাজার টাকা, যা বিশ্বাসযোগ্য নয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ভ্যাট কমিশনার যুগান্তরকে বলেন, ‘পরিবেশ সুরক্ষা সারচার্জ এনবিআরবহির্ভূত কর হওয়ায় তাতে মনিটরিংয়ে আগ্রহ কম থাকে। কারণ একজন কমিশনারের সাফল্য হিসেবে শুধু তার ওপর অর্পিত রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জনকেই ধরা হয়। এর বাইরে অন্য কর্মকাণ্ড আমলে নেয়া হয় না। শুধু রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা আদায়ের ওপর ভর করে কমিশনারদের এসিআর (বার্ষিক অনুবেদনীয় প্রতিবেদন) নম্বর দেয়া হয়। যেহেতু পরিবেশ সারচার্জ এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের মধ্যে পড়ে না, তাই এ নিয়ে কারও মাথা ব্যথা নেই। প্রতিষ্ঠানগুলো স্বপ্রণোদিত হয়ে যা জমা দেয় তা-ই নেয়া হয়। এ বিষয়ে আলাদা মনিটরিং করা হয় না।’

প্রতি বছর দূষণকারী প্রতিষ্ঠানের তালিকা হালনাগাদ করার কথা প্ররিবেশ অধিদফতরের। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে ২০১৫ সালের পর আর নতুন তালিকা তৈরি করা হয়নি। এমনকি এ সারচার্জের অর্থের বিষয়ে সরকারকে কোনো সুপারিশও করেনি।

এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কাজী সারওয়ার ইমতিয়াজ হাশমী যুগান্তরকে বলেন, ‘পরিবেশ সুরক্ষা সারচার্জের অর্থ কিভাবে ব্যয় করা হচ্ছে তা জানা নেই। এনবিআর আমাদের কাছ থেকে শুধু একবার পরিবেশ দূষণকারী প্রতিষ্ঠানের তালিকা নিয়েছিল। এরপর আর নতুন তালিকা চেয়েছে বলে আমার জানা নেই।’

জানতে চাইলে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) মহাসচিব ড. এমএ মতিন বলেন, ‘পরিবেশ অধিদফতরের তালিকা অনুযায়ী ৭৫৭টি প্রতিষ্ঠানকে পরিবেশ দূষণকারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে দেশে যতো শিল্প-কারখানা আছে কয়েকটি ছাড়া সব কারখানাই পরিবেশ দূষণ করে। এমনকি সরকারি কলকারখানাও পরিবেশ দূষণ করছে।’ তিনি বলেন, ‘শুধু সারচার্জ আরোপ করে পরিবেশ দূষণ বন্ধ করা যাবে না। দেখা যাবে, যে সব কারখানা সারচার্জ দেয় তারা উৎপাদিত পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। অর্থাৎ সারচার্জের টাকা শেষ পর্যন্ত জনগণের পকেট থেকে নিয়ে নিচ্ছে তারা।’

এমএ মতিন আরও বলেন, ‘সারচার্জ আরোপ করার কারণ কি? তা খুঁজতে হবে। আসলে সরকার কি প্রকৃতপক্ষেই পরিবেশ দূষণ বন্ধ করতে চায়, নাকি দূষণকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে বাড়তি কর আদায় করতে চায়? যদি উদ্দেশ্য হয় বাড়তি কর আদায়, তাহলে পরিবেশ দূষণ কখনও বন্ধ হবে না। আর উদ্দেশ্য যদি দূষণ বন্ধ করা হয় তাহলে আইনের বাস্তবায়নে আরও কঠোর হতে হবে। এক্ষেত্রে প্রথম ও দ্বিতীয় বছর যে সব প্রতিষ্ঠান সারচার্জ দেবে তারা তৃতীয় বছর পরিবেশ দূষণ করলে তাদের জেল-জরিমানা এমনকি প্রতিষ্ঠান বন্ধ করার মতো উদ্যোগ নিতে হবে। তাহলেই পরিবেশ দূষণ কমবে।’

https://www.jugantor.com/last-page/2017/09/09/153841